উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
যীশু একদিন স্বর্ণলোভী ইহুদী পুরোহিত সম্প্রদায়ের অর্থসর্বস্ব মন্দির জীবন ছেড়ে মরুভূমিতে চলে গিয়েছিলেন ঈশ্বরের স্বর্গরাজ্যকে(Kingdom of God)অধিকার করার জন্য। সিদ্ধার্থ গৌতম একদিন নেপালের কপিলাবস্তুর রাজপ্রাসাদের ভোগ ঐশ্বর্য পরিত্যাগ করে ভারতের বুদ্ধ গয়ায় নির্বাণের তপস্যায় ডুবে গিয়েছিলেন। একই পথে পাশ্চাত্যের ভোগমুখী সভ্যতার পীঠস্থান কলকাতা ছেড়ে দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গাতীরের কালীমন্দির আর জঙ্গলাকীর্ণ পঞ্চবটীতে চলে গেলেন যুবক গদাধর। দূরত্ব সামান্যই। কিন্তু ঐতিহাসিক দূরত্ব অনেকখানি।
পিতার মৃত্যুর পর সংসার চালানোর জন্য রামকুমার কলকাতায় ঝামাপুকুরে চতুষ্পাঠী খুললেন। তিন বৎসরের পরিশ্রমে ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াতে সতেরো বছরের অনুজ গদাধরকে রামকুমার কলকাতায় নিয়ে এলেন। কিছুদিন পরেই কৈবর্ত্যবংশীয় রাণী রাসমণি কর্ত্তৃক নব প্রতিষ্ঠিত কালী ও রাধাকান্ত মন্দিরে যখন গোঁড়া ব্রাহ্মণেরা পূজা করতে অস্বীকার করলেন, রামকুমার পূজা করতে স্বীকৃত হলেন। গদাধর কিন্তু অগ্রজের কৈবর্তের মন্দিরে কর্মগ্রহণে খুশী হলেন না। দক্ষিণেশ্বরে মন্দিরে এসেও গদাধর শূদ্রের অন্নগ্রহণ না করে ঝামাপুকুরে ফিরে গেলেন। শেষ পর্যন্ত রামকুমার অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে অনুজ গদাধরকে প্রথমে বিষ্ণুমন্দিরের এবং পরে কালী মন্দিরের পূজক হিসেবে রাজী করালেন। শূদ্র কৈবর্তের মন্দিরে এলেন ব্রাহ্মণ গদাধর। ইতিহাসের নতুন অধ্যায় রচিত হল গদাধরের এই ঐতিহাসিক আগমনে।
শাক্ত দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে না এলে শক্তিপূজায় অধিকার হয় না। দক্ষিণেশ্বর দেবালয়েই শুভদিনে গদাধরের শক্তিসাধনায় দীক্ষানুষ্ঠান সম্পন্ন হল। দীক্ষা দান করলেন তৎকালীন প্রবীণ শক্তিসাধক কেনারাম ভট্টাচার্য। রামকুমারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল, দক্ষিণেশ্বরে রাসমণির বাগানেও তিনি আসতেন। শোনা যায়, গদাধর নিজেই এঁর কাছে দীক্ষা নিতে মনস্থ করেন। শক্তি-সাধক গুরু শিষ্যের কর্ণে যে মুহূর্তে দীক্ষামন্ত্র দিলেন, সেই মুহূর্তেই ভাবাবেশে অভিভূত হলেন শিষ্য। শিষ্যের অসাধারণ ভাবভক্তি দর্শনে গুরু চমৎকৃত; মুগ্ধচিত্তে আশীর্বাদ করলেন— “তোমার ইষ্টলাভ হোক।” এইবার শুরু হল এক অসাধারণ দিব্যোন্মাদ জীবনে মূর্তিপূজার ইতিহাস।
শিববক্ষে দণ্ডায়য়মান কৃষ্ণকায় কালী হিন্দুদের প্রাচীন দেবতা। হাতে তাঁর অসুরের ছিন্নমস্তক অশুভ শক্তির পরাজয়সূচক। কণ্ঠে মুণ্ডমালা, কটিতে করমালা। এই করমালা আমাদের সমুদয় কর্মফলের প্রতীক। খণ্ডিত করমালা মা পরিধান করেছেন। কর সমস্ত কর্মের উৎস, তাই মা আমাদের সর্বকর্মনাশা। প্রলম্বিত দীর্ঘ জিহ্বায় জীবনের পূর্ণ রজঃশক্তি। তা সংহত করে আছেন শ্বেত শুভ্র বিকশিত দন্ত দিয়ে। যা রজোগুণকে সংযত করে তা সাত্ত্বিক আধ্যাত্মিক আনন্দের পরিচায়ক। পঞ্চাশটি নরমুণ্ড সমন্বিত মুণ্ডমালা পঞ্চাশটি বর্ণমালা যা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমগ্র জ্ঞানের পরিচায়ক। মা আমাদের কালো, কারণ কৃষ্ণ গহ্বরের গভীর অন্ধকারে তিনি এই বিশ্ব জগতের সৃষ্টি ও লয় ঘটান, যেখানে স্থান ও কালের বোধ চলে যায়। শিববক্ষোপরি দণ্ডায়মান আমাদের মা, কারণ সকল কারণের কারণ দেবাদিদেব শিব সৃষ্টির মূলের চৈতন্য। মা কালী সেই চৈতন্য শক্তির অভিব্যক্ত রূপ।
প্রাচীন ক্রীদেশে কৃষ্ণকায় এই দেবতাকে বলা হতো ‘কালী’ বা ‘ক্রোনীয়া’, যিনি তাঁর স্বামী কালের দেবতা ‘ক্রোনাসকে’ নিধন করে কালজয়ী হয়েছিলেন। আয়ারল্যাণ্ডে এঁরই নাম ‘ক্যালিয়োচ’(Callioch)। মেক্সিকোতে আজটেক্ দেবীর নাম ‘কোয়াথলিক্’(Coathlique), যিনি সৃষ্টি ও সংহারের দেবী। ফিনল্যাণ্ডে এই দেবীকেই বলা হতো ‘কালমা’ বা ‘কালীমা’। জিপ্সিদের মধ্যে ইনি ‘সারাকালী’ বলে পরিচিত। সারাকালী হলেন সৃষ্টির মূল বীজ।
স্বামী জিতাত্মানন্দের ‘শ্রীরামকৃষ্ণদর্শন’ থেকে