শেষমেশ মুখ খুললেন আদবানিজি। লালকৃষ্ণ আদবানি কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। অটলবিহারী বাজপেয়ির এনডিএ মন্ত্রিসভায় তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং উপপ্রধানমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব সামলেছেন। আবার বিজেপি যখন দেশের প্রধান বিরোধী দল তখন সংসদে বিরোধী দলনেতার নাম এল কে আদবানি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) রাজনৈতিক শাখা বিজেপিকে ভারত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করার পিছনে তাঁর অবদান অপরিমেয়। দলে ‘লৌহপুরুষ’ নামে পরিচিত সেই রাজনীতিক এতদিনে বললেন, ‘‘আমাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে সহমত না-হলেই কেউ শত্রু হয়ে যায় না।’’
তাঁর স্বয়ং সেবক হয়ে ওঠার সময় থেকে ধরলে জনসঙ্ঘ আর বিজেপি মিলিয়ে আদবানিজির রাজনৈতিক জীবন সুদীর্ঘ—৭৭ বছরের বেশি। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি অবধি নরেন্দ্র মোদির বিস্ময়কর উত্থানের নেপথ্যে আদবানিজির আশীর্বাদ ছিল বোধহয় সবচেয়ে বেশি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক জীবনে আদবানিজিকে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষাও সইতে হয়েছে মোদি-জমানায়। শুধুমাত্র বার্ধক্যের অজুহাতে তাঁর প্রতি এই অবহেলা দলের একাংশ অবশ্যই ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। এর পিছনে নরেন্দ্র মোদির অসহিষ্ণু মনোভাবের প্রতিফলন দেখেছেন কেউ কেউ। মোদিজিকে সমালোচনা করে বলা হয়—যে অসহিষ্ণুতার শিকার রাজনৈতিক বিরোধীরাও। এই প্রশ্নে মোদিজিকে সবার আগে বাক্যবাণে বিঁধেছেন বিজেপির দুই প্রাক্তন মন্ত্রী যশোবন্ত সিনহা এবং শত্রুঘ্ন সিনহা। তাঁরা ইতিমধ্যেই বিজেপি-বিরোধী শিবিরে ভিড়ে গিয়েছেন। দলে থেকেও মোদিজিকে ক্রমাগত কটাক্ষ করে চলেন তাঁর মন্ত্রী এবং দলের প্রাক্তন সভাপতি নীতিন গাদকারি। নরেন্দ্র মোদির সুউচ্চ ব্যক্তিত্বের ছায়ায় সেসব ঢাকাই পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু, এবার পরোক্ষে মোদিজিকে নিশানা করে যে বাক্যবাণ উড়ে এসেছে তা নিক্ষেপ করেছেন তাঁরই রাজনৈতিক গুরু লালকৃষ্ণ আদবানি। আদবানিজি তাঁর ব্লগে দীর্ঘ নিবন্ধ লিখে তাতেই রাজনীতি আর গণতন্ত্রের এই পাঠ দিয়েছেন। আদবানিজির বক্তব্য, রাজনৈতিকভাবে আমার দলের আদর্শে কেউ একমত হলেন না আর তৎক্ষণাৎ তাঁকে ‘দেশদ্রোহী’ তকমা দিয়ে দেওয়া হল—এটা বিজেপির কালচার নয়। আমাদের দল এতটাই উদার যে দেশবাসীর যে-কেউ তাঁর পছন্দসই মতামত গ্রহণ ও পালন করতে পারেন। ইন্দিরা-জমানায় ‘জরুরি অবস্থা’র কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আদবানিজি দাবি করেছেন, বিজেপি বরাবরই স্বাধীনতার পক্ষে—সে মিডিয়া, সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সকলের। আমাদের পার্টির মধ্যে এবং পার্টির বাইরে গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং গণতন্ত্রকে রক্ষা করা আমাদের নীতি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের বিকাশ আমাদের দলের প্রধান স্তম্ভ। সত্য, রাষ্ট্রনিষ্ঠা এবং গণতন্ত্রই আমাদের দলের চালিকা শক্তি। আদবানিজি আরও মনে করিয়ে দিয়েছেন, ভোট নিছক কোনও জয়-পরাজয়ের হাতিয়ার নয়। এটি সকলের আত্মসমীক্ষার ক্ষেত্র। ব্লগে তাঁর এই বিতর্কিত নিবন্ধের শিরোনামটিও তাৎপর্যপূর্ণ—‘অতীতের দিকে, আগামী দিনের দিকে আর সর্বোপরি নিজের অন্দরের দিকে তাকিয়ে দেখুন’।
নীতি কথা শোনানো সহজ। কিন্তু, তা পালন করা কতটা কঠিন তা উপলব্ধি করার জন্য আদবানিজির নিরপেক্ষ জীবনীটাই যথেষ্ট নয় কি? অনেকেই বিশ্বাস করেন, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যায় বিতর্কিত সৌধ ধ্বংস হতো না—আদবানিজি যদি সেদিন এই গণতান্ত্রিক চেতনার বিন্দুমাত্র দেখাতে পারতেন। তাই এই উক্তিগুলিকে আমরা তাঁর আত্মসমীক্ষা এবং আক্ষেপ হিসেবেও দেখতে পারি। ভুল করার পরেই অবশ্য কিছু মানুষ তা স্বীকার করার সাহস দেখান অথবা আক্ষেপ করে থাকেন। উত্তর প্রজন্ম তা থেকে কিছু শিক্ষা নেয়, সতর্ক হয়, পথ চলার নতুন দিগ্‌঩নির্দেশ পায়। সেই দিক থেকে আদবানিজির এই নিবন্ধের গুরুত্ব বিরাট। বিজেপির আজকের নেতৃত্ব তো বটেই, সব রাজনৈতিক দলই এর থেকে শিক্ষা নিতে পারে। তবে, কে কতটা শিক্ষা নিল তার প্রথম পরীক্ষাটা আর ক’দিনের মধ্যেই হয়ে যাবে—এবারের লোকসভা ভোটের ময়দানে। ভোটযুদ্ধ যদি পুরোপুরি রক্তপাতহীন এবং সব রাজনৈতিক দলের তরফে গণতন্ত্রকে আরও উন্নত এবং শক্তিশালী করে তোলার অনুশীলন হয়ে ওঠে, তবেই ভারতীয় রাজনীতি এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল বলে গণ্য করা যাবে। অন্যথায় আমরা সেই পুরনো পাঁক ঘাঁটার ক্লান্তিই বয়ে বেড়াব। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের মিথ্যে আস্ফালন দেখে কোনও দেশই আমাদের দুয়ো দিতে ছাড়বে না।