সম্পত্তিজনিত বিষয়ে অশান্তি বৃদ্ধির আশঙ্কা। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। শেয়ার, ফাটকা, লটারিতে অর্থাগম, কর্মক্ষেত্রে গোলযোগের ... বিশদ
একটা প্রবাদ আছে যে খাবারের স্বাদই বলে দেয় তার ভিতরে পুডিং আছে কি না। প্রকাশ করার ১২ দিন বাদেও কংগ্রেসের ইস্তাহার ‘টক অফ দ্য টাউন’ রয়ে গিয়েছে। কংগ্রেসের ইস্তাহারের এক বা একাধিক বিষয়ের উল্লেখ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটা ভাষণও সম্পূর্ণ করতে পারছেন না। তিনি কংগ্রেসের ইস্তাহার পড়তে অস্বীকার করেছেন, এই বিষয়ে কোনও পরামর্শও নেবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এবং মিথ্যাভাষণেও তিনি লজ্জিত নন। আমার আশা, বিজেপির ভিতর কোনও একজন সাহস করে কংগ্রেসের ইস্তাহারটি অথবা গত ৮ এপ্রিল প্রকাশিত আমার লেখা বিশেষ নিবন্ধটি (জাতীয় কংগ্রেসের ইস্তাহার বিজেপিকে এবার লড়াইতে টেনে এনেছে) প্রধানমন্ত্রীকে পড়াবেন।
বিজেপির দম্ভোক্তি
বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশের একদিন বাদেই আলোচিত হওয়ার প্রাসঙ্গিকতা হারাল। তর্জমার ভুল এবং মুদ্রণপ্রমাদ বাদ দেওয়া যায় কিন্তু ইস্তাহারজুড়ে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতার পরিচয় রয়েছে তা একজন রেয়াত করেন কী করে?
দম্ভোক্তিগুলোর তালিকা দেওয়া যাক:
১. পঞ্চাশ কোটি ভারতবাসী স্বাস্থ্য বিমার সুবিধা পেয়েছেন, ‘আয়ুষ্মান ভারত’কে ধন্যবাদ (বাস্তবটা হল: আয়ুষ্মান ভারত কেবলমাত্র হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসার সুবিধাটা দেয় এবং যত দূর সম্ভব, গত ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ১০ লক্ষ ৫৯ হাজার ৬৯৩ জনের কাছে এই সুবিধা পৌঁছেছে)।
২. অসংগঠিত ক্ষেত্রের চল্লিশ কোটির বেশি মানুষ এখন পেনশন কভারেজ পেতে পারেন (বাস্তবটা হল: মাত্র ২৮ লক্ষ ৮৬ হাজার ৬৫৯ জন এই প্রকল্পে তাঁদের নাম নথিভুক্ত করেছেন। প্রথম দফার পরিশোধের (পেআউট) সময় আসবে ২০৩৯ সাল। এখনই অথবা অদূর ভবিষ্যতে কেউই এই স্কিমের সুবিধা কিছু পাবেন না)।
৩. শৌচালয় নির্মাণের প্রায় ৯৯ শতাংশ করে ফেলা গিয়েছে (বাস্তবটা হল: ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত আছে যে তড়িঘিড় বানানো বিরাট সংখ্যক শৌচাগার অব্যবহৃত অবস্থা পড়ে রয়েছে মানুষের অনভ্যাসের কারণে অথবা জলের অভাবে সেগুলো ব্যবহারযোগ্য করে তোলা যায়নি বলে)। পাশাপাশি বেজওয়াডা উইলসনকে জিজ্ঞাসা করুন তিনি আপনাকে বলে দেবেন যে স্কিমটার গোড়ায় কতখানি গলদ।
৪. ‘মুদ্রা যোজনা’কে ধন্যবাদ যে ছোট ছোট শহরের যুবক-যুবতীদের শিল্প-বাণিজ্য উদ্যোগী হওয়ার সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে (কিন্তু বাস্তবটা হল: মুদ্রা ঋণের গড়পড়তা চেহারাটা মোটেই ভালো নয়— মাত্র ৪৭,৫৭৫ টাকার ঋণ মেলে এবং এটা একটা বড় বিস্ময়কর ব্যাপার হবে যদি ওই এক-একটা ঋণ থেকে একটা করে কর্মসংস্থানও সম্ভব হয়)।
৫. উত্তর-পূর্ব ভারত নানা ভাবে এখন জাতীয় মূলস্রোতের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে (বাস্তবটা হল: দ্য ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস বা এনআরসি প্রয়োগ এবং নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিকে আলাদাভাবে কাঁদাচ্ছে, পরিণামে দেশের বাকি অংশের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে এবং সবচেয়ে অবিশ্বাসের পরিবেশ রচনা করেছে, যা অতীতে হয়নি)।
৬. বিমুদ্রাকরণ, জিএসটি, ... প্রভৃতি হল আমাদের সরকারের কয়েকটি ঐতিহাসিক সাফল্য (বাস্তবটা হল: ডিমনিটাইজেশন ভারতীয় অর্থনীতিটাকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে এবং এই ত্রুটিপূর্ণ জিএসটি ব্যবসা-বাণিজ্য (বিশেষত মাঝারি, ছোট ও খুব ছোট শিল্প বা এমএসএমই-কে) ধ্বংস করে দিয়েছে)।
ব্যক্তি-নির্দিষ্ট বনাম মানুষের চাহিদা ভিত্তি
আগের ওই উদাহরণগুলোই যথেষ্ট। ইস্তাহার প্রস্তুত প্রক্রিয়ার দিকে তাকানো যাক। ইস্তাহার কমিটির শীর্ষকর্তা রাজনাথ সিং দাবি করেছেন যে, তাঁরা কোটি কোটি মানুষকে যুক্ত করেছেন এবং তাঁদের ইস্তাহারে মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন রয়েছে। ভূমিকার শেষ অনুচ্ছেদে দাবিটা এইভাবে খোলসা হয়েছে যে, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘ভিশন’-এর উপর ভিত্তি করেই উপরোক্ত সারসংক্ষেপ দেওয়া গেল।’’ কংগ্রেস এবং বিজেপির ইস্তাহারের তফাতটা এরই মধ্যে এবং পার্থক্যটা প্রকট হয় যখন আমরা এই দুই দলের প্রতিশ্রুতিগুলি ভালো করে খেয়াল করি।
জাতীয় নিরাপত্তা এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দিকটা এবার দেখা যাক। সশস্ত্র বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করার এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিজেপি। সব সরকার এটাই করেছে এবং ভবিষ্যতেও তাই করবে।
এর বাইরে একটি শব্দও উচ্চারিত হয়নি জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ (এনএসসি) অথবা জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শদাতা পর্ষদ (এনএসএবি) অথবা জাতীয় সন্ত্রাস মোকাবিলা কেন্দ্র (এনসিটিসি) অথবা জাতীয় ইন্টেলিজেন্স গ্রিড (ন্যাট-গ্রিড) সম্পর্কে। ডেটা সিকিউরিটি, সাইবার সিকিউরিটি, ফিনান্সিয়াল সিকিউরিটি, কমিউনিকেশন সিকিউরিটি অথবা ট্রেড রুটের সিকিউরিটিরও কোনও উল্লেখ নেই বিজেপির ইস্তাহারে।
এবার প্রসঙ্গ কৃষি। কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার না-রাখা কথাটি ফের বলেছে বিজেপি, কিন্তু লক্ষ্যপূরণের কোনও রোড ম্যাপ তারা দেয়নি। কৃষি ও কৃষকের প্রশ্নে কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতি রীতিমতো সাহসী—যেমন এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি (এপিএমসি) অ্যাক্ট প্রত্যাহার, ফার্মার্স মার্কেট প্রতিষ্ঠা, কৃষিপণ্য বিক্রির বন্দোবস্ত (রপ্তানি এবং আন্তঃরাজ্য বাণিজ্য সমেত), সমস্ত ধরনের নিয়ন্ত্রণমুক্ত।
এবার আসুন স্কুলশিক্ষার প্রসঙ্গে। এই বিষয়ে বিজেপি মোটামুটি একইরকম প্রতিশ্রুতি রেখেছে—গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে শিক্ষার মান, স্মার্ট ক্লাসরুম এবং কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় ও নবোদয় বিদ্যালয়ের উপর। কংগ্রেস প্রতিশ্রুতি দিয়েছে—স্কুলশিক্ষাকে রাজ্য তালিকায় স্থানান্তরিত করবে, শিক্ষার অধিকার আইনের রূপায়ণ ঘটবে, মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ শতাংশ পর্যন্ত শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করা হবে এবং নবম-দ্বাদশ শ্রেণীতে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি যুক্ত করা হবে।
গাণিতিক ধাঁধা
দুটি ইস্তাহারের পাতায় পাতায় এই যে তফাত তার কারণ হল—মোদি-কেন্দ্রিক ভাবনার সঙ্গে মানুষের চাহিদা ভিত্তির তফাত। বিজেপির ইস্তাহার মোদিজির চিন্তা-চেতনা আর প্রাজ্ঞ নর-নারীর কথা শোনায় অনীহার মধ্যেই সীমিত। গাণিতিক একটি ধাঁধা দিয়ে এই লেখায় ইতি টানব। কংগ্রেসের ‘ন্যায়’ (ন্যূনতম আয় যোজনা) প্রতিশ্রুতিকে আক্রমণ করল বিজেপি এবং বলল যে, যখন কর্মসূচির পুরো পাঁচ কোটি পরিবারকে টাকা দেওয়ার প্রয়োজন আসবে তখন বছরে ৩.৬ লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় যুক্তিপূর্ণ হবে না এবং এটা আর্থিক দিক থেকেও হবে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়। তবু, বিজেপি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দাবি করে যে তারা বিনিয়োগ করবে (পাঁচ বছরে) কৃষি ক্ষেত্রে ২৫ লক্ষ কোটি টাকা এবং পরিকাঠামো ক্ষেত্রে ১০০ লক্ষ কোটি টাকা। ২৫ লক্ষ কোটি টাকা + ১০০ লক্ষ কোটি টাকা = ১২৫ লক্ষ কোটি টাকা। এটাকে ৫ বছর দিয়ে ভাগ করলে হয় বছরে ২৫ লক্ষ কোটি টাকা। বছরে ৩.৬ লক্ষ কোটি টাকা এবং ২৫ লক্ষ কোটি টাকার মধ্যে কোন সংখ্যাটি বৃহত্তর?