সম্পত্তিজনিত বিষয়ে অশান্তি বৃদ্ধির আশঙ্কা। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। শেয়ার, ফাটকা, লটারিতে অর্থাগম, কর্মক্ষেত্রে গোলযোগের ... বিশদ
সাধারণভাবে ইস্তাহারগুলো হয় স্বল্পায়ু এবং তাকের কোণের কোথাও জায়গা পায়। ২ এপ্রিল কংগ্রেসের ইস্তাহার প্রকাশের মিনিট কয়েকের ভিতরেই সেটা খবরের শিরোনাম দখল করে নেয় এবং একটা করে ঘণ্টা পেরিয়েছে ঘটনাটা নতুন মাত্রা পেয়ে গিয়েছে। দিনের শেষে এবং নিশ্চিতভাবে ৫ এপ্রিল শেষের মুখে ইস্তাহারের প্রধান প্রতিশ্রুতিগুলো প্রত্যেকটা নগরে, শহরে এবং শহর-ঘেঁষা গ্রামগুলোতে পৌঁছে গিয়েছে। আমি নিশ্চিত যে টেলিভিশন এবং প্রচারকরা প্রধান প্রতিশ্রুতিগুলোর কথা দিন কয়েকের ভিতরে অন্যদের কাছে পৌঁছে দেবে। কংগ্রেসের ইস্তাহারের বার্তার জোর এতটাই যে বার্তাবাহকরা এগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে ধন্য হবে।
কংগ্রেসের এবারের ইস্তাহার কতটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ যে ঘণ্টা কয়েকের ভিতরেই ‘টক অফ দ্য টাউন’ (গ্রামেরও চর্চার বিষয়) হয়ে উঠল? এর উত্তরটা হল—কংগ্রেসের ইস্তাহারটা বস্তুত মানুষের কণ্ঠস্বর। আমি চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি যে এই ইস্তাহারে জায়গা পাওয়া প্রত্যেকটা আইডিয়া বা প্রতিশ্রুতি কোনও-না-কোনও নাগরিক দিয়েছেন—হয় লিখিতভাবে অথবা দেশজুড়ে ১৭৪টা পরামর্শদাতার কোনোটা মারফত। ইস্তাহার প্রস্তুতকারীরা ওই সমস্ত আইডিয়াগুলোকেই সহজ ভাষায় গুছিয়ে লিখেছেন মাত্র।
বিজেপি উত্ত্যক্ত
সাধারণভাবে বিরোধী দলগুলোই শাসক দলের ইস্তাহারের সমালোচনায় মুখর হয়। সাম্প্রতিক অতীতের একটা ঘটনার কথাও আমি মনে করতে পারি না যাতে খোদ শাসক দল একটা বিরোধী দলের ইস্তাহারের বিরুদ্ধে এইভাবে খড়্গহস্ত হয়েছে। এই ঘটনায় প্রশ্ন উঠছে—কেন? বিজেপির লোকরা এর মধ্যে কী এমন পেয়েছে?
আমার মাথায় কয়েকটা জিনিস আসছে সেগুলো বিজেপিকে অবশ্যই উত্ত্যক্ত করেছে। প্রথমটা হল চাকরির প্রতিশ্রুতি। ৪৫ বছরের মধ্যে বেকারত্বের সর্বোচ্চ হার ৬.১ শতাংশ। নিশ্চিত এবং সত্বর সমাধান ছিল কিন্তু, সেই নিশ্চয়তা উপেক্ষা করে, মোদিজি বছরে দুই কোটি চাকরির বন্দোবস্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসলেন। উল্টে ওই প্রতিশ্রুতিই বিজেপিকে ধাওয়া করে বেড়িয়েছে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার পরিবর্তে বিজেপির সরকার ডিমনিটাইজেশন এবং ত্রুটিপূর্ণ জিএসটি চালুর মাধ্যমে চাকরি ধ্বংসই করেছে। ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অফিসের (এনএসএসও) সরকারি রিপোর্টে ৪ কোটি ৭০ লক্ষ চাকরি খোওয়া যাওয়ার কথা লেখা হয়। কংগ্রেসের ইস্তাহার দেখিয়েছে দেশের বিশাল সংখ্যক বেকার যুবক-যুবতীদের নিশ্চিত কাজের ব্যবস্থা কী কী ভাবে করা সম্ভব। যেমন একটা সহজ পদক্ষেপ হল—সরকারি এবং আনুষিঙ্গক দপ্তরগুলোতে যত শূন্যপদ রয়েছে সেগুলো পূরণ করা, তাহলে এখনই ২৪ লক্ষ বেকারের চাকরি দেওয়া সম্ভব।
এরপর, ইস্তাহার সাহসী মনোভাব রেখেছে কৃষিক্ষেত্রের জন্য। এমনকী, কৃষিঋণ মকুবের সিদ্ধান্ত বিজেপি উপহাস করার পরেও, কংগ্রেসের ইস্তাহারে বকেয়া কৃষিঋণ মকুব করে দেওয়ার ঘোষণা রাখা হয়েছে। বিজেপির তরফে কয়েকটি দেউলিয়া কোম্পানির (৮৪,৫৮৫ কোটি টাকা) ঋণ মকুবের দৃষ্টান্ত টেনে কৃষিঋণ মকুবের যাথার্থ্য দেখিয়েছে কংগ্রেস। কংগ্রেসের ইস্তাহারের আরও দুটো প্রতিশ্রুতি কৃষকদের মন কেড়ে নিয়েছে: পৃথক ‘কিসান বাজেট’ এবং ঋণ খেলাপি কৃষকদের নামে আর কোনও ফৌজদারি (ক্রিমিনাল) মামলা নয়—কেননা যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ না-হওয়াটা হল একটা দেওয়ানি (সিভিল) সমস্যা। একদা বিখ্যাত এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন সার্ভিস ফিরিয়ে আনারও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে কংগ্রেসের ইস্তাহারে। কথা দেওয়া হয়েছে—এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট অ্যাক্ট প্রত্যাহার করা হবে, এসেনশিয়াল কমোডিটিজ অ্যাক্ট বদলানো হবে, এবং দেশের প্রতিটা জেলায় একটা করে কৃষি বিজ্ঞান কলেজ এবং একটা করে পশুস্বাস্থ্য বিজ্ঞান কলেজ স্থাপন করা হবে।
এড়িয়ে যাওয়া নয়
স্পর্শকাতর বিষয়গুলোর মুখোমুখি হতে ভয় পায়নি কংগ্রেসের ইস্তাহার। মহিলাদের জন্য ইস্তাহারে প্রতিশ্রিতি রয়েছে—মহিলা সংরক্ষণ বিলের পরিবর্তন এবং সমস্ত সরকারি পদের তিন ভাগের একভাগ মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ। তফসিলি জাতি (এসসি), তফসিলি জনজাতি (এসটি) এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর (ওবিসি) জন্য কংগ্রেসের এবারের প্রতিশ্রুতি হল—ইকোয়াল অপারচুনিটিজ কমিশন, আরও ইতিবাচক ভূমিকা এবং বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও তাঁদের জন্য সংরক্ষণ। কংগ্রেসের ইস্তাহারে প্রতিশ্রুতি রয়েছে প্রবীণ নাগরিকদের জন্য, ভাষাগত এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য, নানাভাবে প্রতিবন্ধীদের জন্য এবং ‘এলজিবিটিকিউআইএ+’ কমিউনিটির জন্য। কংগ্রেসের এবারের নির্বাচনী ইস্তাহার পড়লে প্রত্যেকেই মনে করবেন এতে তাঁর কথাটা আছে।
কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহার জাতীয় নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং বিদেশ-নীতি নিয়ে আলোচনা করেছে এবং এসব বিষয়ে বিজেপির ভুল নীতি ও ভুল পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ করেছে। জেটলিজি কিছু প্রশ্ন তোলার পরে কংগ্রেস বাস্তব দিক তুলে ধরে জবাব দিয়েছে এবং পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে। কেন জম্মু ও কাশ্মীরে অনুপ্রবেশের চেষ্টার সংখ্যা, অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা এবং হতাহতের সংখ্যা বেড়ে গেল? সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষ ক্ষমতা) আইন বা সংক্ষেপে আফসপা তুলে নেওয়া হল কেন ২০১৫ সালে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে পুরোপুরি, মেঘালয় থেকে ২০১৮ সালে এবং অরুণাচল প্রদেশের তিনটি জেলা থেকে ২০১৯-এর ১ এপ্রিল? বিজেপি কি মদতপুষ্ট-অন্তর্ধান, যৌননিগ্রহ ও হিংসাকে সমর্থন করছে? সংসদ যেকালে ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট এবং আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট তৈরি করেছে সেইকালে কেন ১২৪এ ধারার (বিদ্রোহ) প্রয়োজন—যেটা উপনিবেশ জমানার একটা অন্যায় ব্যবস্থামাত্র? এটা পরিষ্কার যে তার মতো লড়াই করার কায়দাটা কংগ্রেস ফের খুঁজে বার করেছে এবং বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ জানাবার সদিচ্ছা দেখাচ্ছে। আমি বিতর্কে তাঁদের স্বাগত জানাই কিন্তু হতাশ হচ্ছি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ দিনকে দিন উগ্র হয়ে ওঠায়।
আইডিয়ার লড়াই চেয়েছিলাম
বিজেপি এখনও অব্দি (৫ এপ্রিল) তাদের নির্বাচনী ইস্তাহার বার করেনি। অথচ, প্রথম দফার ভোট আগামী ১১ তারিখ, আজ, সোমবার থেকে ধরলে মাত্র তিনদিন বাকি। আমার সন্দেহ হচ্ছে যে, কংগ্রেসের ইস্তাহারকে ‘কাউন্টার’ করার জন্য বিজেপি তার খসড়া ইস্তাহারটাকে মাজাঘষা (রিভাইজ) করছে। সে ভালো। বিজেপিকে আইডিয়ার যুদ্ধে নামানো যাক। যতদূর সম্ভব, বিজেপি ভরসা রেখেছে উগ্র-জাতীয়তাবাদে এবং অপব্যবহারে-গালমন্দে। বিজেপির প্রচার যদি আইডিয়া এবং যুক্তিতর্কের দিকে ঘুরে যেত তবে আমি সেটাকে স্বাগতই জানাতাম।
বহু দফায় ভোটগ্রহণের আইডিয়াটা আমার পছন্দ নয় কিন্তু, বর্তমান পরিস্থিতিতে, এটা হয়তো এড়ানো মুশকিল ছিল। ভোটগ্রহণের বিভিন্ন দফার ভিতরে খবর পরিবেশনে সংবাদ মাধ্যমকে অবশ্যই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে এবং নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা প্রয়োগে অবশ্যই কোনোরকম বৈষম্য হবে না। বাকিটা ভারতের মানুষের বিবেচনা।