সম্পত্তিজনিত বিষয়ে অশান্তি বৃদ্ধির আশঙ্কা। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। শেয়ার, ফাটকা, লটারিতে অর্থাগম, কর্মক্ষেত্রে গোলযোগের ... বিশদ
আসলে, ভোটযুদ্ধটা এখন রাজনীতির তত্ত্বকথা ছেড়ে মনে হয় একটা হাইটেক কৌশলী ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভোট গোনায় বেশি সময় লাগার অছিলায় ব্যালটে ভোটে তাই হয়তো এত আপত্তি! এবং যত অপবাদই উঠুক ‘হাইটেক’ ভোটমেশিনে এত ভরসা! যুক্তিও অকাট্য— গোনার ক্ষেত্রে সময় অনেক কম লাগে। ঠিকই, আজ সময় একটা বড় ফ্যাক্টর। কারও যেন সেই অর্থে বাড়তি সময় নেই। সব কাজধান্দার শেকলে বাঁধা। আর সময় ধরতে জীবনে হোক, কি কাজে সর্বত্র বেড়েছে গতি। রাজনীতির ক্ষেত্রও তার ব্যতিক্রম নয়। চটজলদি কথাটা এখন কেবল কথার কথা নয়—জীবনে সমাজে বিনোদনে মায় রাজনীতিতেও চটজলদি রেজাল্ট চাইছি আমরা প্রায় সকলেই। কীভাবে কম খেটে বেশি পাওয়া যাবে কোন জায়গায় আঘাত করলে শত্রু ঘায়েল হবে জলদি—সেটাই আজ প্রধান ভাবনা, প্রথম লক্ষ্য। চলতি ভোটযুদ্ধের ময়দানে পক্ষ-প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক তরজা শুনলে অনেক ক্ষেত্রেই এই চটজলদি রেজাল্টের প্রতি একাগ্রতা টের পাওয়া যাচ্ছে! সভা-সমাবেশে উপস্থিত জনতার মন জয়ে তাই রাজনৈতিক নীতিতত্ত্ব বা বাস্তব সত্যের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে চটকে চমকে মশালাদার মন্তব্য, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। এতে উপস্থিত জনতা সাময়িক একটা মনোরঞ্জনের আস্বাদ অবশ্যই পাচ্ছেন, তবে তা ভোটযুদ্ধে কতটা বক্তা বা তাঁর দলীয় রাজনীতিকে এগিয়ে দিচ্ছে বলা মুশকিল।
এই যেমন ধরুন না—দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ রাজ্যে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে ‘স্পিড ব্রেকারে’র সঙ্গে তুলনা করে গেলেন! রাস্তায় স্পিড ব্রেকার বসানো হয় দুর্ঘটনা এড়াতে—সেদিক থেকে দেখলে এর উপযোগিতা অনস্বীকার্য। কিন্তু, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য মন্তব্যে এমন ইতিবাচক ভাবনা কি থাকতে পারে? পারে না। সেজন্যই মোদিজির ‘স্পিড ব্রেকার’ নিছক একটা নেতিবাচক অর্থ নিয়েই গত বুধবার শিলিগুড়ির জনসভায় উপস্থিত জনতার দরবারে হাজিরা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দাবি ছিল গোটা দেশে তিনি এত উন্নয়ন করলেন কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে পারলেন না—কারণ মমতা! মমতা নাকি ‘স্পিড ব্রেকারে’র মতো তাঁর উন্নয়নের পথে ‘প্রতিবন্ধক’ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন! মোদিজির মুখে এমন ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য শুনে হয়তো তাঁর দলের সমর্থক সাধারণ জনতার একটা অংশ আমোদ পেয়েছেন কিন্তু মাঠ ছাড়ার পর সেই আমোদজনক মন্তব্যের সঙ্গে বাস্তবের মিল কি তাঁরা পেয়েছেন? পাননি, পেতে পারেন না। তার কারণ, ওই জনতার ঘরে ঘরে কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, যুবশ্রী, কর্মশ্রী, সবুজসাথী, শিশুসাথী, স্বাস্থ্যসাথী, জল ধরো জল ভরো, সবার ঘরে আলো মধুর স্নেহের মতো মমতার জনহিতকর প্রকল্পগুলির কোনও কোনওটার, এক বা একাধিকের সুযোগ-সুবিধা অনেকদিনই পৌঁছে গেছে। পাশাপাশি রাস্তাঘাট, পানীয় জল, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র বিনামূল্যের চিকিৎসা, ওষুধ আজ প্রত্যন্ত গ্রামেও বাড়ি থেকে দু’পা বাড়ালেই মিলছে। তার ওপর নানারকম সরকারি আর্থিক অনুদান, সাহায্য, প্রকল্প, স্বাস্থ্য বা কৃষিক্ষেত্রে নিখরচায় বা অতি সামান্য খরচায় বিমা—তাও মিলতে শুরু করেছে বহুদিন। তাহলে!
বাংলার আজকের এই উজ্জ্বল উন্নত ছবিটার খোঁজ মোদিজি রাখেন না এমন তো নয়। হতেই পারে না। তিনি সব জানেন, জানে তাঁর দলের জাতীয় থেকে রাজ্য শাখার সকলে। তা সত্ত্বেও তবে কেন তিনি বুধবার ওইভাবে তীব্র আক্রমণ চালালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে নিশানা করে? বাংলার উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধক ‘স্পিড ব্রেকার’ বলে ব্যঙ্গ করলেন তাঁকে? এই ব্যঙ্গটুকু দিয়ে যে মমতার উন্নয়নকামী ভাবমূর্তিকে কিছুমাত্র বিচলিত করা যাবে না, পরন্তু বাংলায় বিজেপি সমর্থকমহলের মধ্যেই হয়তো কোথাও কোথাও কিঞ্চিৎ উষ্মা জাগার (মহানেতার বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবের সঙ্গতিহীনতার জন্য) সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে—এমন কথাও কি ভাবেননি? আমাদের জানা নেই। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার দিক থেকে অত্যন্ত
বিচক্ষণ এবং কূটকৌশলী তা তথ্যভিজ্ঞজনেদের কাছে বহুবার শুনেছি। সুতরাং, তিনি যখন তাঁর অন্যতম প্রতিপক্ষকে ‘স্পিড ব্রেকার’ বলে ব্যঙ্গ করেন তখন সেটাকে কেবল মাঠ মাতানোর চেষ্টা বলে ভাবা
কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ওই ব্যঙ্গটি যখন
রাজ্যের ‘উন্নয়ন’ প্রসঙ্গে উত্থাপিত হয় তখন
সন্দেহ হয়—তাহলে কি খোদ প্রধানমন্ত্রীও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতার উন্নয়নমুখী ভাবমূর্তির প্রবল
প্রভাব প্রতিপত্তিতে চিন্তিত! বাংলার নজিরবিহীন উন্নয়নের কাণ্ডারী মমতাকেই কি ভয় পাচ্ছে বিজেপি?
ভয় কতটা পাচ্ছে আমাদের জানা নেই, তবে বাংলায় মমতার অভাবনীয় ‘উন্নয়ন’ যে দেশজনতার মনে তাঁর সম্পর্কে প্রত্যাশার পারদ অনেকটা চড়িয়ে দিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। জাতীয় স্তরের ভোট-রাজনীতিতে তো বটেই দেশজনতার মহলেও বাংলার উন্নয়ন এখন রীতিমতো চর্চার বিষয়। একথা আশা করি সকলেরই মনে আছে, ২০১৪ সালে মোদিজির জাতীয় রাজনীতিতে একচ্ছত্র হয়ে ওঠার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ‘ভাইব্রান্ট গুজরাত’—শিল্পোন্নয়নের আলোয় উদ্ভাসিত গুজরাত। সারা দেশজুড়ে তখন গুজরাতের ‘অভূতপূর্ব’ উন্নয়ন এবং সেই উন্নয়নের রূপকার বলে চিত্রিত নরেন্দ্র মোদিজিকে নিয়ে সে কী ব্যাপক চর্চা! উঠতে বসতে ঘরে বাইরে সর্বত্র উন্নয়নের দিশারী হিসেবে মোদিজি’র গুণগান চলছে গেরুয়া শিবিরের দশদিক জোড়া প্রচারে আর দেশজনতাও অভিভূত, আত্মহারা। যে মানুষ গোধরা দাঙ্গায় ক্ষতবিক্ষত বদনামী একটা রাজ্যকে মুখ্যমন্ত্রীর সীমিত ক্ষমতা দিয়ে এমন উন্নয়নের শিখরে তুলে নিয়ে যেতে পারেন তাঁর হাতে দেশের ভার তুলে দিলে ‘আচ্ছে দিন’ নিশ্চয়ই আসবে। আসবেই। মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি ইত্যাদি ইস্যুতে পড়তি দশার কংগ্রেস তখন মোদিজির ওই উন্নয়নপন্থী ভাবমূর্তির প্রবল উত্থান আটকাতে দিশেহারা। এবং শেষপর্যন্ত পর্যুদস্ত। দেশের মানুষের অঢেল সমর্থনে কংগ্রেসিরাজকে নস্যাৎ করে মোদিজি ‘স্বচ্ছ ভারত’ ‘নতুন ভারতে’র রূপকার হয়ে অবতীর্ণ হলেন দিল্লি মসনদে। তারপর কী হয়েছে না হয়েছে, জনপ্রত্যাশা পূরণে মোজিদি কতটা কী সফল বিফল হয়েছেন তা নিয়ে তর্ক আলোচনা বহু হয়েছে! সেসব থাক।
কিন্তু, একথা অস্বীকার করা যাবে কি যে আজও এই ২০১৯ সালেও ২০১৪ সালের মতোই রাজ্যের নজিরবিহীন উন্নয়নকে হাতিয়ার করে জাতীয় রাজনীতিতে আর এক মুখ্যমন্ত্রীর বিরাট উত্থান ঘটছে? এবং বলা বাহুল্য তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর রাজ্যটা বাংলা। সুদূর পশ্চিমের গুজরাত যদি উন্নয়নের ধ্বজা উড়িয়ে তার মুখ্যমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রিত্বের আসনে পৌঁছানোর পথ করে দিতে পারে, তবে বাংলা পারবে না কেন? উন্নয়নের গতি-প্রকৃতি ও সাফল্যের নিরিখে আমাদের বাংলা এই মুহূর্তে দেশের যে কোনও রাজ্যের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই যে অনেক এগিয়ে তা কেন্দ্রীয় সরকারি পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে চলেছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বমঞ্চে সম্মান, মর্যাদা লাভের ক্ষেত্রে কন্যাশ্রীর মতো সাফল্য আর কেউ কোনওদিন পেয়েছে কি? তো, এমন উন্নয়নমুখী ভাবমূর্তি যাঁর জাতীয় ভোট-রাজনীতিতে তাঁকে ঘিরে সাধারণ জনতা নতুন করে স্বপ্ন দেখতেই পারেন, ভাবতেই পারেন মমতা বাংলার মতো দেশকেও বিশ্বমানে পৌঁছে দিতে পারেন। আর সেই প্রত্যাশাতে যদি ভোটবাক্সে ঢল নামে তবে...!
প্রশ্ন হল, এই সম্ভাবনার কথা ভেবেই কি বুধবারের নির্বাচনী সভায় ‘স্পিড ব্রেকার’ বলে মমতাকে ব্যঙ্গ করলেন মোদিজি, কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর চেয়ে বেশি আক্রমণ শানালেন তাঁকে লক্ষ্য করে? কিন্তু, এভাবে কি পশ্চিমবঙ্গের ঝলমলে উন্নত বাস্তবকে উপেক্ষা করা যাবে? বাংলা সমেত গোটা দেশের জনমনে উন্নয়নের সফল সার্থক দিশারী হিসেবে মমতার যে ইমেজ গড়ে উঠেছে তাকে একটুও ম্লান করা যাবে? আমরা বলব না, বলবে সময়—লোকসভা যুদ্ধের শেষফল।