সম্পত্তিজনিত বিষয়ে অশান্তি বৃদ্ধির আশঙ্কা। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। শেয়ার, ফাটকা, লটারিতে অর্থাগম, কর্মক্ষেত্রে গোলযোগের ... বিশদ
কিন্তু, আশঙ্কা যথেষ্টই ছিল। ওই দুই যুদ্ধের ময়দানে বহিরাগতদের দিয়ে বড় গোলমাল পাকানোর চেষ্টা হতে পারে বলে রাজ্যের সংশ্লিষ্ট মহলে খবর ছিল বলেও শুনেছিলাম। কিন্তু, শেষঅব্দি কিছু যে ঘটেনি তার জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনীর পাশাপাশি রাজ্য পুলিসেরও বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য হতে পারে। তার কারণ, উত্তেজনাপ্রবণ এলাকাগুলো নিয়ন্ত্রণে বা ভিন রাজ্য থেকে দুষ্কৃতী ঢোকার রাস্তা বন্ধ করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বাহিনীর চেয়ে রাজ্য পুলিসের ভূমিকা ও কৃতিত্ব কোনও অংশে কম ছিল না। অথচ, এই পুলিস বাহিনীকে নিয়ে ভোটের আগে কত কথা! পুলিস নাকি শাসকদলের হুকুম মেনে চলে, তাদের হয়ে কাজ করে! তা যদি হতো তাহলে কি এমন নির্বিঘ্ন শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আমরা দেখতে পেতাম? আলিপুরদুয়ারে তো গোটা দিনে কোথাও একটা চড়া গলাও শোনা গেল না। কোচবিহারে যেটুকু টিভিতে দেখাল অত বড় লোকসভা ক্ষেত্রের নিরিখে সেটা কিছুই নয় বলা যায়! তবে, জেলাশাসকের অফিসে ধর্না নিয়ে একটি দলের প্রার্থীর দেহরক্ষী ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর কয়েকজন জওয়ান যে অতিসক্রিয়তা দেখালেন এবং রাজ্য পুলিসের সঙ্গে প্রায় হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়লেন সেটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। বাহিনী, সে রাজ্যের হোক কী কেন্দ্রের— পারস্পরিক মর্যাদা রক্ষা করতে হবে না! রাজ্যে পুলিস তো অন্যায্য হস্তক্ষেপ করতে যায়নি। ভোটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব তো তাঁদেরও কিছু কম নয়। ভোটের সময় জেলাশাসকের অফিসের গুরুত্ব কে না বোঝেন? তো সেই অফিসে গোলমাল হলে তা থামাতে বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাঁদের তো উদ্যোগ নিতেই হবে। সেখানে তাঁদের কাজে ভোট নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বাহিনীর কেউ কেউ বা প্রার্থীর দেহরক্ষী যদি প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, তবে কি সেটা শোভন সঙ্গত হয়? আশা করা যায়, নির্বাচন কমিশন ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন। এমন অনভিপ্রেত ঘটনা যাতে ভোটযুদ্ধের আগামী দিনগুলোতে না ঘটে তার ব্যবস্থা করবেন। আসলে, সংঘর্ষের বড় ঘটনা না ঘটলেও যুযুধান পক্ষগুলোর মধ্যে, বিশেষত, তৃণমূল বিজেপি শিবিরের মধ্যে, একটা চড়া লড়াইয়ের মেজাজ আছেই। একটা সময় পর্যন্ত এ রাজ্যে প্রধান যুযুধান ছিল সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল। রাজ্যে কংগ্রেসের রাজনৈতিক ভূমিকা সেই আশির দশকের পর থেকে ক্রমশ দুর্বল হয়েছে। মমতার তৃণমূলের উত্থানের পর সেই দুর্বলতা আরও প্রকট হয়েছে। পরবর্তীতে দেশে কংগ্রেসের সরকার হলেও রাজ্যে কংগ্রেসের স্বাস্থ্য ফেরেনি বরং রাজনৈতিক দিক থেকে জনমহলে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে গিয়েছে। ফলে, তৃণমূলের জন্মের পর থেকে ভোটযুদ্ধই হোক কি দৈনন্দিন রাজনৈতিক সংঘাত— মূল লড়াইটা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল একা মমতা বনাম তৎকালের শাসক সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামেদের। নানা সময়ে কংগ্রেস সহ আরও অনেকেই এই মমতা-বিরোধী শিবিরের দোসর হয়েছিল, সেটাও অনস্বীকার্য। এই পর্বতপ্রমাণ প্রতিকূলতা ঠেলেই মমতাকে এগতে হয়েছে দিনের পর দিন, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে অবিচল থাকতে হয়েছে তাঁর মা-মাটি-মানুষের সেবায়। শারীরিক লাঞ্ছনা থেকে প্রায় প্রাণঘাতী আঘাত সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। এবং তাঁর এই বিদ্রোহিণী জননেত্রী ভাবমূর্তিতেই মজেছে বাংলার মানুষ, আর তার জেরেই ২০১১ সালে অজেয় বলে কথিত সিপিএমের লালদুর্গ ধূলিসাৎ হয়েছে, মা-মাটি-মানুষের নেত্রী অভূতপূর্ব জনজোয়ার তুলে সিপিএম ও তার শরিকদের কেবল ক্ষমতাচ্যুতই করেননি, প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রচনা করেছেন এক নতুন ইতিহাস। অতঃপর সিপিএমের ছেড়ে যাওয়া মৃত্যুপথযাত্রী পশ্চিমবঙ্গের বুকে মাত্র কয়েক বছরের ঐকান্তিক চেষ্টায় নতুন প্রাণসঞ্চার করেছেন, উন্নয়নের বিপুল উদ্যোগে বাংলার পাহাড়-জঙ্গল থেকে সাগর সাজিয়ে দিয়েছেন অভাবনীয় রঙে, গরিব সাধারণের ঘরে ঘরে নানান সরকারি প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা পৌঁছে দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন হাসি এবং বিশ্বের দরবার থেকে আদায় করে নিয়েছেন সম্মান স্বীকৃতি। কন্যাশ্রী সবুজসাথীর মতো সরকারি প্রকল্প আজ বিশ্ববন্দিত। আমাদের পশ্চিমবঙ্গ আজ বিশ্ববাংলা।
এই বদলে যাওয়া বাংলায় আজ সিপিএম কোথায়! কংগ্রেসই বা কোথায়? দূরবিনে দেখতে হয়। কিন্তু, প্রকৃতির নিয়মে কোনও শূন্যস্থানই শূন্য থাকে না। বাংলার রাজনীতিতেও থাকেনি। সিপিএম কংগ্রেসের দুর্বলতা এবং জনসমর্থন হারানোর পথ ধরে শূন্যস্থান ভরাতে একটু একটু করে উঠে এসেছে বিজেপির গেরুয়া বাহিনী। আজ এই ২০১৯ সালের ভোটযুদ্ধের সময় সকলেই স্বীকার করবেন—এ রাজ্যের প্রধান যুযুধান মমতার তৃণমূল এবং বিজেপির পদ্মশিবির। বিজেপি নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে দেশ শাসনের এক টার্ম শেষ করে পরের টার্ম দখলের জন্য ঝাঁপিয়েছে। ভোটপূর্ব জনসমীক্ষাগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিতেই মোদিজির ক্ষমতায় ফিরে আসার আভাস মিলেছে। কিন্তু নানান ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ও শেষ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলের চেহারা চরিত্র দেখে উত্তরপ্রদেশ মধ্যপ্রদেশ দক্ষিণ ভারত এবং পশ্চিম ভারতের কিছু রাজ্যে এবার কতটা কী মিলবে তা নিয়ে মোদিজি শিবিরে কিছু চিন্তা জেগেছেই। সেই ঘাটতি মেটাতে এবার বাড়তি নজরে পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। ফলে, বাংলায় পদ্মবাহিনীর সঙ্গে এ রাজ্যে মমতার তৃণমূলের টক্করে যে বাড়তি তাপ ছড়াবে তাতে সন্দেহ কি? এবার রাজ্যে ভোটযুদ্ধের ময়দানে নিরাপত্তা জোরালো করতে আধা সেনার বহর বৃদ্ধি তার ইঙ্গিত দিয়েই রেখেছে। তার সঙ্গে বিজেপির রাজ্য নেতাদের গরম গরম বক্তৃতা এবং এমনকী রাজ্যের সভাগুলোতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিজির মমতামুখী আক্রমণে অতিরিক্ত ধার সেই ইঙ্গিতকে যে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে তাতেই বা সন্দেহ কি?
কিন্তু, কথা হল—ভোটটা তো দেবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। তাঁদের সিংহভাগ যে এখনও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিকল্প হিসেবে কাউকে ভাবছেন না সেটাও তো ভোটপূর্ব সমীক্ষাগুলোতে উঠে এসেছে। এ রাজ্যে ভোটযুদ্ধের ফল তৃণমূলের পক্ষে ৪২-এ ৪২ হবে কি না জানা নেই, তবে হলেও আশ্চর্য হবেন কি কেউ? আমার এক বন্ধু বলছিলেন, মমতা ৪২-এ ৪২ ডাক দেওয়ার পরও কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে পথেঘাটে সাধারণের মধ্যে হালকা কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। বরং, তাঁদের কথা শুনলে মনে হয়েছে এমন ফল হতেও পারে। ৪২-এ ৪২ না হোক ৪০ কি ৩৬ হলেও কি কম? রাজ্যে যে মাত্রায় উন্নয়ন হয়েছে, গ্রাম শহরের প্রান্তিক গরিব থেকে সাধারণ মধ্যবিত্ত যেভাবে সেই উন্নয়নের সুযোগ সুবিধা পেয়েছে তাতে মমতা ছাড়া অন্য কিছু তাঁরা কেন ভাববেন! তাছাড়া বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ ত্রিপুরা ইত্যাদি থেকে মাঝেমধ্যেই যেসব খবর এসেছে বা আসছে তাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতার প্রতি ভক্তি বিশ্বাস আরও জোরদারই হচ্ছে। শান্তি সম্প্রীতির ক্ষেত্রেও তো পশ্চিমবঙ্গ গত সাত বছরে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এখন প্রশ্ন হল, বাংলার আজকের পরিস্থিতিতে মানুষের মনে মুখ্যমন্ত্রী মমতার যে ভাবমূর্তি তাকে কেবল কথা দিয়ে আর অভিযোগ ব্যঙ্গবিদ্রুপের হুল ফুটিয়ে কিছুমাত্র বিচলিত করা কি সম্ভব?! বাংলার ভোটে বঙ্গজনতার এই মমতাভক্তি ঠেকানো যাবে? এই প্রশ্ন যতদূর জানি রাজ্য বিজেপির অন্দরমহলেও উঠেছে। এ রাজ্যের পদ্মশিবিরে মমতার সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিতে পারেন এমন নেতা বা নেত্রীর অভাবও যে আছে সেটাও কি অস্বীকার করতে পারছেন দলের শীর্ষস্তরের কর্তারা? কিন্তু তা বলে তো যুদ্ধের আগেই বসে পড়া যায় না। তাই যুদ্ধক্ষেত্রে সর্বশক্তি দিয়েই লড়তে নেমেছে বিজেপি। আর সেই আক্রমণ ঠেকিয়ে একাধিপত্য বজায় রাখতে নেমেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। প্রথম দফার লড়াই শেষ। দ্বিতীয় দফাও আসন্ন। প্রথম দফা নির্বিঘ্ন হওয়ায় মানুষ যে বুকে বাড়তি বল পেয়েছেন এবং ভোট ব্যাপারে তাঁদের উৎসাহও যে বেড়েছে তা সংশ্লিষ্ট মহলের প্রায় সকলেই স্বীকার করছেন। এখন দেখার শেষদফার লড়াই অব্দি এই শান্তি-আমন বজায় থাকে কি না, নানা প্ররোচনা রুখে ভোটশান্তি বজায় রেখে মমতার বিশ্ববাংলা সম্প্রীতির বাংলা দেশে নতুন নজির গড়তে পারে কি না—ভোটফলের পাশাপাশি তা নিয়েও কিন্তু বাংলার জনমহলে কৌতূহল বাড়ছে।