সম্পত্তিজনিত বিষয়ে অশান্তি বৃদ্ধির আশঙ্কা। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। শেয়ার, ফাটকা, লটারিতে অর্থাগম, কর্মক্ষেত্রে গোলযোগের ... বিশদ
ব্যাপারটা একটু খোলসা করা যাক। এমনিতে জাপানিদের বেশ খানিকটা দুর্নামই আছে ‘ওয়ার্কঅ্যাহলিক’ বা কাজে আসক্ত বলে। কর্মে আসক্তি সে দেশের জাতীয় বৈশিষ্ট্যই বলা চলে। তার ফলশ্রুতিতেই বোধকরি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে গুঁড়িয়ে যাওয়া একটা দেশের ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে জেগে ওঠে উন্নয়নের আর সমৃদ্ধির ফিনিক্স। প্রযুক্তির হাত ধরে। মার্কিন দানবের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলে সে।
৩০ এপ্রিল অবসর নিচ্ছেন জাপান সম্রাট আকিহিতো। এমনিতে জাপান সম্রাটরা সাধারণত অবসর বড় একটা নেন না। (কোন দেশের কোন সম্রাটই বা নেন!) তাঁরা স্বপদে থাকেন আমৃত্যু। গত দুই শতাব্দীর মধ্যে আকিহিতোই প্রথম জাপান সম্রাট যিনি সরে যাচ্ছেন পদ থেকে। অনেকটা অবশ্য স্বাস্থ্যের কারণেই। সেই সঙ্গে অবসান হচ্ছে ‘হেইসেই’ যুগের। নতুন রাজা হবেন আকিহিতোর জ্যেষ্ঠ পুত্র নারুহিতো। সূত্রপাত হবে ‘রেইয়া’ যুগের। যাই হোক, রাজার অবসর গ্রহণ উপলক্ষে (আর নতুন রাজার অভিষেকের জন্যে) দশ দিনের ছুটি দিচ্ছে জাপান। রীতিমত সংসদে অনুমোদন করেই। (ছুটি দিতে গেলেও সংসদের অনুমোদন! একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত একরত্তি দ্বীপরাষ্ট্রের আধ শতাব্দীর মধ্যে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হতে গেলে বোধকরি এমনটা দরকার।) শুনতে দশদিন লাগলেও আসলে কিন্তু ছুটিটা মাত্র দু'দিনের। ৩০ এপ্রিল আকিহিতোর অবসর, আর ১ মে নারুহিতোর অভিষেক। ‘গোল্ডেন উইক’ নামক প্রথাগত ছুটি আর দুজোড়া শনি-রবি জুড়ে গিয়ে এই ছুটিটা বড় হয়ে গিয়েছে, এই যা। কিন্তু সেই ছুটি নিয়ে মস্ত বড় হইচই।
জাপান ধনী দেশ হলেও ফুরসতের অভাবে জাপানিদের বিদেশে বেড়াতে যাবার সুযোগ বেশ কম। অনেকে তাই এই বিরল সুযোগে বেড়াতে যাচ্ছেন বিদেশে। অনেকেই আবার মস্ত ঝঞ্ঝাটে পড়েছেন। তাঁরা জানেনই না কি করে এতবড় ছুটি কাটাতে হয়। বন্ধ ক্রেসগুলি, বন্ধ বাচ্চাদের স্কুল, নার্সারি। তাহলে দিনভর বাচ্চাদের রাখবে কে? বিশেষ করে বাবা-মা দু’জনে চাকুরে হলে, তারা তো এভাবে বাচ্চা সামলাতে একেবারেই অভ্যস্ত নয়। ওদিকে কোথাও বেড়াতে যাওয়াও সহজ নয়। সব জায়গা ভিড়ে ভর্তি। সেটাও স্বস্তির নয় অনেকের কাছে। হোটেল ইত্যাদি বেড়ানোর আনুষঙ্গিক খরচও বেড়ে গেছে এই ছুটির ধাক্কায়। খুব স্বাভাবিক ভাবেই। অনেক মাস আগে থেকেই হলিডে প্যাকেজ, হোটেল, এইসব বুক করে রেখেছে অনেকে।
‘আবাহি শিমবান’ নামে এক সংবাদপত্র আবার উদ্যোগ নিয়ে এক সমীক্ষা করিয়েছে। তাতে দেখা গিয়েছে, মাত্র ৩৫ শতাংশ জাপানি কিন্তু খুশি এই পড়ে পাওয়া ছুটি পেয়ে। আর অখুশি অনেক বেশি। ৪৫ শতাংশ। বাকিরা বোধহয় জানেই না যে, ছুটি পেলে খুশি হতে হয়, নাকি অখুশি। ‘জাপান টাইম’’-এর এক সমীক্ষায় আবার দেখা যাচ্ছে যে, লম্বা ছুটির ফলে সবাই বাড়িতে বসে থাকলে গৃহস্থালির কাজ যাবে অনেকটাই বেড়ে। সেটা কে সামলাবে? সেই আশঙ্কাতেও অখুশি অনেকে। আবার ‘হেইসেই’ যুগের সমাপ্তি আর ‘রেইয়া’ যুগের শুরুতে স্মারক বিক্রি হচ্ছে দেদার। সেই স্মারক কিনতে চায় অনেক রাজভক্ত জাপানবাসী। কিন্তু তাতে খরচের ধাক্কা আছে। তাতেও অখুশি অনেকে।
মোটের উপর ছুটির ফলে অখুশি হবার কারণ অনেক রকম। যেমন, ধরা যাক, সাধারণ লোকের তো ছুটি। তাই তারা বেড়াতে যাবে, যাবে সিনেমা-থিয়েটার দেখতে, ছুটবে বিনোদন পার্কে। খেতে ছুটবে রেস্তরাঁয়। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই ছুটি নেই ট্যুরিজমের সঙ্গে যুক্ত লোকজনের। হোটেল ব্যবসা, বিনোদন ব্যবসা, রেস্তরাঁ কিংবা পিৎজা বা ফাস্টফুড স্টলের কর্মীদের। এদের বরং কাজ অনেকটাই বাড়বে এই দেশজোড়া ছুটির ফলে। থাকবে না দম ফেলবার ফুরসত। তাতে আবার অখুশি এরা।
আচ্ছা, আমাদের দেশের সংগঠিত ক্ষেত্রের চাকুরেদের কথা একটু ভাবা যাক এ প্রসঙ্গে। (অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের কথা অবশ্য এ আলোচনায় আসবে না। অন্ন সংস্থানের জন্য তাদের বেশিরভাগকে অবশ্যই মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। আক্ষরিক অর্থেই।) এটা স্বীকার করে নেওয়াই ভালো, মোটের উপর আমরা ঠিক কাজ-পাগল নই। কোনও নিন্দুক আমাদের ওয়ার্কঅ্যাহলিক বলুক দেখি। ওই জাপানিদের যেমন বলে। আসলে আমাদের বেশিরভাগ লোকই হয়তো একটু ঢিলেঢালা। আর কর্ম-সংস্কৃতিটাও তেমনই। ছুটি পেলেই ‘আমার ছুটি’ বলে ছুট লাগানো আমাদের মজ্জায় মজ্জায়। শুন্ডি থেকে হল্লা পর্যন্ত। এমনকী ছুটি না-থাকলেও কাজের মধ্যে ছুটিকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে দেওয়ায় আমাদের বিরল স্বাভাবিক নৈপুণ্য। তাতে কাজ দাঁড়িয়ে থাকে থমকে, জমে ওঠে ফাইলের পাহাড়। এ একেবারে অতি-চেনা দৃশ্য। অফিসে অফিসে। আবার ফাইল যখন টেবিল ছাড়িয়ে কম্পিউটারে জমা হচ্ছে, সেই আজকের দিনে ব্যাঙ্ক বা পোস্ট অফিসে গিয়ে হামেশা জানা যায়, লিঙ্ক নেই। সুতরাং কাজ বন্ধ। আমাদের ছুটি-বান্ধব কালচারে সত্যি সত্যিই সেই লিঙ্ক আছে না নেই, জানার কোনও উপায়ও নেই সাধারণ গ্রাহকের। কিন্তু কর্ম-সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের ‘লিঙ্ক’টা সত্যিই বড় একটা নেই। এটাই বাস্তব।
পদার্থবিদ্যার ক্লাসে পড়েছিলাম, প্রযুক্ত বলের অভিমুখে প্রযুক্ত বলের সঙ্গে সরণের গুণফল হচ্ছে ‘কাজ’-এর পরিমাণ। অর্থাৎ আমি যদি একটা পাহাড়কে ঠেলে গলৎঘর্ম হই, কিন্তু পাহাড়টা একবিন্দুও না সরে, তবে আমার ‘কাজ’-এর পরিমাণ শূন্য। সামাজিক স্তরে ‘কাজ’কেও তাই বিচার করতে হবে দেশের, সমাজের উন্নয়নের মাপকাঠিতে। যেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সূচক আর তার বৃদ্ধির অভিমুখ দিয়ে। প্রচেষ্টাটা কীভাবে চলেছে, তার মাপকাঠিতে নয়। আমাদের শ্যাওলা-ধরা সমাজের ক্ষেত্রে এই সরণটা কিন্তু বড্ড কম। তাই কাজটাকে আতশ কাচ দিয়েও খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হয়ে যায়।
যাই হোক, অনেকটা সে কারণেই ভাবলাম যে, পড়ে পাওয়া ছুটির ফাঁদে হাঁসফাঁস করতে থাকা জাপানিদের কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থার কথা ঘটা করে জানানো উচিত আমাদের জনগণকে। জাপানিদের দেখে আমাদের ‘কাজ’ করতে শেখা প্রয়োজন, নাকি আমাদের দেখে ওদের ‘আজ আমাদের ছুটি ওভাই’ বলতে শেখাটা জরুরি, সেটাও আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে। আচ্ছা, জাপানিরা তো একটা উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল পাঠাতে পারে আমাদের দেশে, কাজ আর ছুটিকে কী করে মিশিয়ে দিতে হয়, তা শেখার জন্য।
সেদিন বিকেলেই আমার এক সহকর্মী বেশ উৎসাহ নিয়ে জানালো যে, এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে তিনদিন ছুটি—সোম, বুধ, শুক্র—পয়লা বৈশাখ, মহাবীর জয়ন্তী, গুড ফ্রাইডে। তাই মাঝে দু’দিন ক্যাজুয়াল লিভ নিয়ে নিলেই একটানা ন’দিন ছুটি। বেশ মজা করে তার খানিকটা বেড়ানোতে, আর বাকিটা রিলাক্স করে কাটানো যাবে। খবরটা শুনেই মনটা কিন্তু বেশ খুশি খুশি হয়ে উঠল।