সম্পত্তিজনিত বিষয়ে অশান্তি বৃদ্ধির আশঙ্কা। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। শেয়ার, ফাটকা, লটারিতে অর্থাগম, কর্মক্ষেত্রে গোলযোগের ... বিশদ
তবে, এই ঘটনা ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নার্সদের অবাক করেছিল। একটি শিশুর ভেতর এত বড় হৃদয়ের সন্ধান পেয়ে তাঁরা অভিভূত হয়ে যান। এক নার্সই মোবাইল ফোনে এই বিরল শিশুর ছবি তুলে রেখেছিলেন। সেটাই পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। আমরা জেনে যাই, সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে চমকপ্রদ এই ঘটনার নায়কের নাম ডেরেক সি লালচানহিমা। সে থাকে মিজোরামে আইজল জেলার সাইরাং অঞ্চলে। ফেসবুক পোস্টে হাজার হাজার লাইক পড়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে। লাখের কাছে মানুষ তার ছবি শেয়ার করেছেন। বিখ্যাত ব্যক্তিরাও ডেরেকের মানবিক মুখের প্রশংসা করেছেন। তার স্কুলও তাকে পুরস্কৃত করেছে। এরপর বিষয়টির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে প্রথাগত সংবাদ মাধ্যম। নানা ভাষার কাগজে এবং টিভিতে খবর হয়েছে।
দেশ এখন এক ‘যুদ্ধপরিস্থিতি’র মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ভোটযুদ্ধ। এর উত্তাপ গোলাগুলির যুদ্ধের থেকে ঢের বেশি। ভারত পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র। সুতরাং এই নির্বাচনে ভারতবাসীর রায় কোন দিকে যায় তা জানার জন্য বস্তুত সারা দুনিয়া আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছে—ভারত আবার চৌকিদারের হাতে থাকবে নাকি যিনি চৌকিদারকেই চোর ‘সাব্যস্ত’ করে দিলেন তাঁর হাতে চলে যাবে? ৯০ কোটি ভোটার মিলে ৫৪৩ জন সদস্যকে নির্বাচন করে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে পাঠাবেন। আমাদের রাজনীতির কারবারিদের নাওয়া-খাওয়া-ঘুম ছুটে গিয়েছে। সবার মিশন ‘দিল্লি চলো’। সুতরাং প্রতিটি মিডিয়ার শিরোনাম দখল করে ফেলেছে এই বিরাট ইভেন্ট। অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবরই এই ঘোলা জলে হারিয়ে যাচ্ছে কিংবা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। তার ভেতরেও যে আমরা জেনে গেলাম সাইরাংয়ের ঘটনা, চিনে ফেললাম পাহাড়ি গাঁয়ের ছেলে ডেরেক সি লালচানহিমাকে—এটা নিঃসন্দেহে ভালো ব্যাপার। সবার আগে ধন্যবাদ দিতে হবে যে নার্স এই আশ্চর্য বালকের ছবি নিয়েছিলেন এবং যে বা যাঁরা ঘটনাটিকে দুনিয়ার সামনে তুলে ধরেছেন। তা নাহলে প্রথাগত সংবাদ মাধ্যমে ঘটনাটি আদৌ প্রচার পেত কি না সংশয় থাকে।
আজকের নির্বাচনী আবহে ডেরেকের মুখটি কিন্তু বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ঠেকছে। কারণ, ডেরেক যে হৃদয়ের পরিচয় দিয়েছে সেটি একজন খাঁটি মানুষের। যে মানুষের কথা বলে গিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ—ঈশ্বরজ্ঞানে জীবের প্রতি প্রেম প্রদর্শন করবে। ভোটে যাঁরা দাঁড়ান তাঁদের প্রত্যেকেরই দাবি থাকে—তাঁরা মানুষের সেবা করার সুযোগ চান। যে প্রার্থী পুনর্বার নির্বাচিত হওয়ার আশা নিয়ে সামনে আসেন তিনি বলেন, ‘‘আরও বেশি সেবা করার সুযোগ চাই।’’ কিন্তু, ৬৮ বছরব্যাপী বহুদলীয় নির্বাচনী গণতন্ত্র অনুশীলনের ইতিহাসের পাতায় রাজনীতির কারবারিদের যে ছবি ধরা রয়েছে তাতে তাঁদের বেশিরভাগের মুখের কথার সঙ্গে আচরণের সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্বঘোষিত জনসেবকদের অনেকেই নিজেকে চিনিয়ে দেন এক-একজন ক্ষমতালোভী হিসেবে। আর সেই ক্ষমতার কুর্সিতে আরোহণ করার জন্য কেউ কেউ যা করে থাকেন তা ভদ্রসমাজের কলঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। নিজেকে বড় দেখানোর জন্য প্রতিপক্ষকে পাঁকে নামানোর অদম্য চেষ্টা—মান্য রীতি হয়ে উঠেছে। কুকথার স্রোতেই থেমে থাকে না তাঁদের অ্যাডভেঞ্চার—নিজেরা নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থেকে ভক্ত সমর্থকদের একাংশকে লেলিয়ে দেন অন্যায় যুদ্ধের ময়দানে। প্রতিটি ভোটের আগে পরে এইভাবে কত নিরীহ মানুষের প্রাণ যে যায়, কত পরিবার যে চিরকালের মতো সর্বস্বান্ত হয় তার নিরপেক্ষ খতিয়ান আমরা কোনোদিনই পাব না। এর পরেও দেখা যায়—রাজনীতির কারবারিদের দল বদল, পক্ষ বদলের বাঁদরামি। হঠাৎ একদিন দেখা গেল (ধরা যাক) ‘লাল’ দলের একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি ‘সবুজ’ কিংবা ‘গেরুয়া’ দলে ভিড়ে গিয়েছেন! কী ব্যাপার—না, আগের দলে থেকে জনসেবা করার বড় সমস্যা হচ্ছিল! অথচ, ওই মহামান্যকে জেতানোর জন্যই ‘লাল’ দলের কিছু কর্মী সমর্থক ‘সবুজ’ এবং ‘গেরুয়া’ দলের লোকেদের হাতে বেধড়ক ঠ্যাঙানি খেয়েছিলেন কিংবা কেউ কেউ প্রাণও দিয়েছিলেন। উল্টো ঘটনাও ঘটে থাকতে পারে। (সেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য রাজকোষের কত অর্থের আদ্যশ্রাদ্ধ হয়েছে, এখানে তা উহ্য।) আবার এমনও কিছু মহামান্যের আবির্ভাব ঘটে যাঁরা দল বা পক্ষ বদল করেছেন চরকি কাটার মতো করে। কোনও ঘাটের জল খেতে বাকি নেই তাঁদের। মানুষের সেবা করার জন্য কিছু নারী পুরুষ এতটা আকুল হবেন বিবেকানন্দ নিশ্চয় কল্পনাও করেননি।
‘মানুষ’ শব্দের অর্থ না-জেনে মানুষের সেবা করতে গেলেই এই নিষ্ঠুর সার্কাস দেখানো সম্ভব। শিক্ষিত সমাজ জানে এবং মানে যে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র রাজনীতিকে বাদ দিয়ে নয়। তবু, যুব সমাজের শিক্ষিত সংবেদনশীল অংশ আজ রাজনীতিতে নামার, রাজনীতি অনুশীলনের, রাজনীতিকে ভালোবাসার কারণ খুঁজে পায় না। প্রতারণার সীমাহীন প্রতিযোগিতা রাজনীতির প্রতি সমস্ত আকর্ষণ নষ্ট করে দিয়েছে। তাঁরা কৃতজ্ঞ নির্বাচন কমিশনের প্রতি—এই জন্য যে ভোটযন্ত্রে প্রার্থীদের সঙ্গে ‘নোটা’ অপশনটাও রাখা হয়েছে। যাঁরা রাস্তায় নেমে রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচারের প্রতিবাদ করতে পারেন না এটা তাঁদের একান্ত হাতিয়ার। এবার সারা দেশে নতুন ভোটার (১৮-১৯ বছর বয়সি) দেড় কোটি বা মোট ভোটারের ১.৬৬ শতাংশ। আর মোট যুব (১৮-৩০ বছর বয়সি) ভোটার ২০ কোটি। বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে আরও তাৎপর্যপূর্ণ—মোট প্রায় সাত কোটি ভোটারের মধ্যে নতুন ভোটার প্রায় তিন শতাংশ আর যুব ভোটার প্রায় দেড় কোটি। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষ নোটা-য় ভোট দিয়েছিলেন। গত বছর রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, মিজোরাম বিধানসভার ভোটেও ০.৫-২ শতাংশ হারে নোটা-য় ভোট পড়েছিল। অনেকগুলি আসনে জয়ের ব্যবধানের চেয়ে নোটা ভোটের সংখ্যা বেশি ছিল। বেশকিছু জবরদস্ত প্রার্থীকেও ঘোর অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল নোটা। নোটা একাধিক আসনে নির্ণায়কের ভূমিকা নিয়েছিল। নোটা কি পারবে রাজনীতির অনুশীলনটাকে মানবিক করে তুলতে—নীতি খুঁজতে আমাদের আর দূরবিন হাতড়াতে হবে না?
আমাদের বাংলা থেকে বহু দূরে একটি পুচকে ছেলে একটি মুরগি ছানাকে বাঁচানোর জন্য কত কীই না করল! তাও সেটি তার নিজেরও নয়, কোনও এক প্রতিবেশীর। তারই কারণে সেটি রক্তাক্ত হয়েছিল। পাছে তাকে বকাঝকা করা হয় কিংবা তার বাবা মায়ের কাছে দাম চাওয়া হয়—এই ভেবে ডেরেকের পক্ষে পালিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কিংবা, ধরা পড়ে গেলে হাত ধুয়ে ফেলার মতো অজুহাতও দিতে পারত সে। লোকে সেটা মেনেও নিতে পারত বলে অনুমান হয়। কিন্তু, ওইটুকু ছেলে পুরো উল্টো পথে হেঁটেছে—মানুষের পথে—যে পথে হাঁটার সাহস বড়রা হারিয়ে ফেলেছি। এই ডেরেকের সামনে কোনও মানুষ আহত হলে সে আরও কী কী করতে পারত কল্পনা করি। বুকটা ভরে ওঠে।
কিছু ক্ষমতালোভীর সৌজন্যে রাজনীতি যখন বৃহৎ আকারে এক মুরগির কারবার হয়ে ওঠে তখন একটি সত্যিকার মুরগির বাচ্চাকে বাঁচানোর আকুতি থেকে শিক্ষা নেবে রাজনীতি! যদি একশো বছরেও বাস্তব হয়—সেই যুগের ভাগ্যবান প্রজন্ম পরখ করতে পারবে প্রকৃত ঈশ্বরসেবার স্বাদ।