সম্পত্তিজনিত বিষয়ে অশান্তি বৃদ্ধির আশঙ্কা। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। শেয়ার, ফাটকা, লটারিতে অর্থাগম, কর্মক্ষেত্রে গোলযোগের ... বিশদ
আসলে ভোট বাজারের বিপণন কৌশল নরেন্দ্র মোদি নিজের হাতের তালুর মতো বোঝেন। এমনটা মনে করেন তাঁর প্রতিপক্ষরাও। ব্র্যান্ড মোদিকে কীভাবে প্রচারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করতে হয়, সেটা তাঁর নখদর্পণে। মোদিই মুখ, তিনিই ভরসা। নানা বিতর্কে বিদ্ধ বিজেপি লোকসভা নির্বাচনের রণতরী সাজিয়েছে সেই নরেন্দ্র মোদিকেই কাণ্ডারী করে। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে হটকেকের মত বিকোচ্ছে মোদি নামাঙ্কিত হুডি, কফি মগ, শাড়িও। ভোট ঘোষণার আগেই একের পর বিজেপি সংসদ সদস্য যখন ‘নমো এগেইন’ লেখা হুডি পড়ে ভরিয়ে তুলেছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়াল, তখন পাল্লা দিয়ে তাঁদের সেই পোস্টে কমেন্ট করছেন, রিট্যুইট করছেন স্বয়ং মোদি। উদ্দেশ্য অবশ্যই পরিষ্কার। নিজের ব্র্যান্ডের প্রচার। ‘নমো’ অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদি। এই নাম যেভাবে পারো, যত পারো, ছড়িয়ে দাও। পৌঁছে দাও বাড়ির শোয়ার ঘর পর্যন্ত। তা সে পুরনো দিনের মতো প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুন-ব্যানারেই হোক বা আধুনিক প্রযুক্তি। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইনস্টাগ্রাম-ফেসবুক-ট্যুইটারের মতো বিস্তীর্ণ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। সর্বত্র বিজেপির প্রচারের প্রধান ‘মুখ’ করে তোলো মোদিকেই। এই কৌশল দেশের যুব সম্প্রদায়কে আকর্ষিত করবে, যার প্রভাব পড়বে ভোট বাক্সে। এমনই আশা গেরুয়া শিবিরের।
ধরুন, ‘ম্যায় ভি চৌকিদার’-এর প্রচারের গল্পটাই। ২০১৪-য় ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী মোদির মুখে বার বার শোনা গিয়েছে দু’টি শব্দ। ‘চৌকিদার’ ও ‘প্রধান সেবক’। রাফাল যুদ্ধবিমান কেনা নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত হতেই কংগ্রেসের তরফে কটাক্ষ শুরু হয় ‘চৌকিদার’ শব্দটি নিয়ে। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী মন্তব্য করেন, ‘চৌকিদার চোর হ্যায়।’ লোকসভা ভোটের মুখে কংগ্রেস সভাপতির ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ স্লোগানের পাল্টা জবাব দিতে নতুন স্লোগান দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ‘ম্যায় ভি চৌকিদার’। সঙ্কটে তিনিই দেশের ‘পরিত্রাতা’ বোঝাতে ওই স্লোগান দিয়ে একটি ভিডিও প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর ট্যুইটে। সেই ভিডিওতে রয়েছে একটি গান। আর সেই গানের সঙ্গেই প্রধানমন্ত্রীকে কখনও দেখা যাচ্ছে কোনও জনসমাবেশে, কখনও বা কোনও যুদ্ধের ট্যাঙ্কের উপরে। নানা রকমের কর্মকাণ্ডে। প্রধানমন্ত্রী মোদিকে বলতে দেখা যাচ্ছে, ‘আপনাদের পাহারা দেওয়ার জন্য দেশের সেবার জন্য এই চৌকিদার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’ সেই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, গানের সুরে সুর মিলিয়ে আমজনতাও বলছে ‘ম্যায় ভি চৌকিদার হুঁ’। ‘ম্যায় ভি চৌকিদার’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে করা সেই ট্যুইটে প্রধানমন্ত্রী লিখেছিলেন, ‘আমি একা নই। যাঁরাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ছেন, সমাজের কলুষ, ত্রুটিবিচ্যুতির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন, তাঁরা সকলেই চৌকিদার। ভারতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যাঁরা লড়াই করে চলেছেন, তাঁরাও চৌকিদার। আজ প্রতিটি ভারতীয় নাগরিক বলছেন, ম্যায় ভি চৌকিদার।’ ব্যস! রাতারাতি ‘ম্যায় ভি চৌকিদার’ হয়ে গেল এই লোকসভা ভোটের প্রচারে বিজেপির অন্যতম হাতিয়ার। বিজেপির সব নেতা-কর্মীর নামের আগে এখন একটাই বিশেষণ। ‘ম্যায় ভি চৌকিদার’!
বিরোধীরা কটাক্ষ করে বলছেন, চৌকিদার তো তারাই— যারা কোটি কোটি টাকার মালিক। অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এডিআর)-এর তথ্য বলছে, গত লোকসভা ভোটে জয়ী ৫২১ জন সদস্যের হলফনামা পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে ৮৩ শতাংশ সাংসদই কোটিপতি! ৫২১ জনের মধ্যে কোটিপতি সাংসদ ৪৩০ জন। এঁদের মধ্যে বিজেপির সদস্য হলেন ২২৭, কংগ্রেসের ৩৭, তামিলনাড়ুর এআইএডিএমকে দলের ২৯ এবং বাকিরা অন্য দলের কিংবা নির্দল সদস্য। এই সদস্যদের মধ্যে ৩২ জন রয়েছেন যাঁদের সম্পত্তির পরিমাণ ৫০ কোটি টাকারও বেশি। লোকসভার মোট সদস্য ৫৪৩ জন। এডিআরের হিসেব অনুযায়ী সদস্যদের গড় সম্পত্তি দাঁড়াচ্ছে ১৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ওই ৫২১ সদস্যের মধ্যে মাত্র ২ জন রয়েছেন যাঁদের সম্পত্তির মূল্য ৫ লাখেরও কম।
বিজ্ঞাপন প্রচারের শুরুটা হয়েছিল অনেক আগেই। গত ২৪ ডিসেম্বর গুজরাতের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নমো পণ্য বিক্রির অনলাইন পোর্টাল চালু করে। যারা দাবি করেছে যে এসব পণ্য হচ্ছে নমো মন্ত্রের পণ্য। তাদের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘নরেন্দ্র মোদি ইন্সপায়ার্ড প্রোডাক্টস আর দ্য ওয়ে টু সে হোয়াট ইউ স্ট্যান্ড ফর’। যার বাংলা দাঁড়ায় ‘আপনার মূল্যবোধকে তুলে ধরার উপায় হচ্ছে সেই সব পণ্য, যেগুলো তৈরি হয়েছে নরেন্দ্র মোদির চেতনায়’। মোদি কুর্তা, মোদি জ্যাকেট এবং মোদি টি-শার্টের পর এবার বাজারে নামানো হয়েছে মোদি শাড়িও। সাধারণ শাড়ির উপর ডিজিটাল প্রিন্টারের মাধ্যমে বসানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মুখাবয়ব। আর এই শাড়িই ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গোটা দেশে।
নমো-কে ‘বিকাশ পুরুষ’ বা প্রগতির পুরুষ হিসেবে তুলে ধরার প্রচারে মূলধারার প্রচারমাধ্যম বা দলীয় সমর্থকদের সভা-সমাবেশ ছাড়াও নতুন মাধ্যমগুলোর ভূমিকাও কম নয়। নির্বাচনী বৈতরণী পার করাতে শাসকদলের প্রধান হাতিয়ার মোদির বিজ্ঞাপনের জন্য বিজেপি হাতছাড়া করেনি বলিউডকেও। যদিও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে আসতে হয়েছে গেরুয়া শিবিরকে। বিরোধীদের আপত্তির জেরে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে মুক্তি পায়নি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আত্মজীবনী নিয়ে সিনেমা ‘পিএম নরেন্দ্র মোদি।’ তবে এরই মধ্যে একটি নতুন টিভি চ্যানেলের জন্ম হয়েছে। নয়া চ্যানেলটির নাম ‘নমো টিভি’। একটি চব্বিশ ঘণ্টার স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল। আর কেউ নয়, চ্যানেলের বিষয়বস্তু শুধুমাত্র সেই তিনিই। খোদ নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। যে চ্যানেলের সম্ভবত কোনও বৈধ অনুমতিপত্র নেই। এবং যাকে নিয়ে আচারবিধির বাধ্যবাধকতায় সামান্য কদিন জলঘোলা হল বটে, কিন্তু আটকানো যায়নি। নির্বাচন কমিশনের উত্তরে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রক জানিয়ে দিয়েছে— নমো টিভি কোনও সংবাদ চ্যানেল নয়, একটি বিজ্ঞাপনী প্ল্যাটফর্ম মাত্র। যা প্রচারের জন্য ডিটিএইচ পরিষেবা সংস্থাগুলির কোনও সরকারি ছাড়পত্র প্রয়োজন হয় না। গত ৩১ মার্চ থেকে ডিটিএইচ পরিষেবার গ্রাহকদের কাছে এই চ্যানেল লভ্য। ফেসবুকে নমো টিভির পেজে ফলোয়ার সংখ্যা ইতিমধ্যে পনেরো লাখ। যাকে বলে বিজ্ঞাপনের আধুনিকীকরণ!
কী দেখানো হচ্ছে নমো টিভিতে? প্রধানমন্ত্রী মোদির ২০১৯-এর সবকটি নির্বাচনী প্রচারের সরাসরি সম্প্রচার। প্রতিটি জনসভা থেকে লাইভ। বিভিন্ন নির্বাচনী মঞ্চে মোদির গা-গরম করা পুরনো বক্তৃতা। গত লোকসভায় নানা সেশনে মোদিজির ভাষণ। এনডিএ সরকারের সাফল্যের নানা পরিসংখ্যান। মাঝে মাঝে যোগব্যায়াম, দু’একটি সিনেমা। মোদিময় এই চ্যানেলে মাঝে মাঝে অন্য নেতার মুখও যে ভেসে উঠছে না তা নয়, ঘুরেফিরে আসছে জিএসটি নিয়ে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির ভাষণ, রাজনাথ সিং, অমিত শাহের রোড শো। সদ্য বাজারে আসা এই ‘নমো টিভি’, ‘নরেন্দ্র মোদি’ মোবাইল অ্যাপ, যা ইতিমধ্যেই প্লে-স্টোর থেকে ডাউনলোড হয়ে গিয়েছে ১ কোটিরও বেশি হ্যান্ডসেটে। প্লে-স্টোরে থাকা অ্যাপের ভাঁড়ারে উঁকি দিলে গুনে শেষ করা যাবে না মোদির নাম ব্যবহার করে তৈরি করা অ্যাপের সংখ্যা। কোনওটিতে রয়েছে মোদির সঙ্গে সেলফি বা ছবি তোলার যান্ত্রিক কায়দা, কোনওটিতে মোদির জনপ্রিয় উক্তির সঙ্কলন, তো কোনওটিতে শুধুই বিজেপিকে ক্ষমতায় ফেরানোর ডাক। এই সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন।
ইন্টারনেট সমীক্ষক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্ডিয়ার সমীক্ষা অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির ১৯ তারিখের পর থেকে শুধুমাত্র গুগলকে বিজ্ঞাপন বাবদ রাজনৈতিক দলগুলি দিয়েছে ৩ কোটি ৭৬ লক্ষ টাকা। যার এক তৃতীয়াংশই দিয়েছে বিজেপি। মোট ৫৫৪টি বিজ্ঞাপনে বিজেপি খরচ করেছে ১ কোটি ২১ লক্ষ টাকা। গুগলে বিজ্ঞাপন দেওয়ার নিরিখে গেরুয়া শিবিরের ধারে কাছে নেই কংগ্রেস-সহ অন্য জাতীয় দলগুলি। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশের প্রধান বিরোধী দল ওয়াইএসআর কংগ্রেস। তাঁরা খরচ করেছে মোট, ১ কোটি ৪ লক্ষ টাকা। গুগলকে দেওয়া বিজ্ঞাপনের নিরিখে কংগ্রেস রয়েছে ষষ্ঠ স্থানে। মাত্র ৫৪ হাজার ১০০ টাকার বিজ্ঞাপন দিয়েছে রাহুল গান্ধীর দল। এবছর অবশ্য বিজ্ঞাপন নিয়ে বেশ কড়াকড়ি করেছে গুগল। টাকা দিলেই বিজ্ঞাপন দেওয়া যাচ্ছে না। সেজন্য প্রয়োজন পড়ছে নির্বাচন কমিশনের অনুমতির।
আসলে, নবীন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করার সেরা মাধ্যম যে সোশ্যাল মিডিয়াই, তা অনেক আগেই টের পেয়েছিল বিজেপি। দলীয় অনুমোদনে ও ভোট-রাজনীতির স্বার্থে একজন নেতার ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্রায়নে অন্যায় নেই ঠিকই। এও ঠিক, ভারতের মতো অর্ধপক্ব রাজনৈতিক সংস্কৃতির দেশে, যেখানে ক্যারিশমার মোহ থেকে আজও বেরতে পারেননি দেশের ভোটাররা। আজও এ দেশের ভোটাররা আগমার্কা গণতন্ত্রের খোঁজ করেন না, এই দেশ একজন সার্জিকাল স্ট্রাইকার চায়। সেটাও জানে বিজেপি। অতএব, গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ল নয়া বিজ্ঞাপন। ‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’— মোদি থাকলে সবই সম্ভব।
লোকসভা ভোটের মুখে ৫০৯ শব্দের এক বিস্ফোরক ব্লগে বিজেপির উদ্দেশ্যেই বিশেষ বার্তা দিয়েছেন বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি। যার শিরোনাম ছিল: দেশ আগে, দল তার পরে, ব্যক্তি সব শেষে। ‘ব্রাত্য’ আদবানিকে নিজের ঢঙেই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে ভোলেননি মোদি। হয়তো তিনি ভালো করেই জানেন, ব্র্যান্ড মোদির অবিসংবাদী নির্মাণের পথে সব কাঁটাগুলি ইতিমধ্যে উপড়ে ফেলা গিয়েছে, এগুলি তাদের মধ্যে একটি-দু’টির শেষ মরণখোঁচা মাত্র। দলের মার্গদর্শন নিয়ে এসব আপ্তবাক্যে তাঁর আর প্রয়োজন নেই। কারণ, দেশ ও দল ব্র্যান্ড মোদিতে এসে মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে। তিনিই এখন এ দেশের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা!
২০১৪ নির্বাচনেও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছিল গেরুয়া শিবিরের প্রচারের মূল অস্ত্র। স্লোগান উঠেছিল, ঘর ঘর মোদি। এবারেও সেই একই পথে দিল্লি জয়ের প্রচেষ্টায় বিজেপি। আর আপাতদৃশ্যে মনে হচ্ছে, বিজেপির প্রচার-কুশীলবদের রি-ব্র্যান্ডিং অভিযানের তোড়ে বিরোধীদের রাজনৈতিক প্রশ্নগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। ভোটের ময়দানে এই বাংলার মাটিতে মোদিকে একমাত্র টক্কর দিচ্ছেন সেই
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই। কটাক্ষ করে বলেছেন,
দেশের প্রধানমন্ত্রী কাজের চেয়ে এখন বেশি নিজের বিজ্ঞাপন করেন।