বিদ্যার জন্য স্থান পরিবর্তন হতে পারে। গবেষণামূলক কাজে সাফল্য আসবে। কর্মপ্রার্থীরা কোনও শুভ সংবাদ পেতে ... বিশদ
গতকাল পিকনিক থেকে ফেরার সময় ছোটকাকু বল্লভপুরের রাস্তায় মোটর সাইকেল থেকে পড়ে যায়। খুব বড় অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারত। কিন্তু অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে। আমরা সবাই একটা বড় গাড়িতে ছিলাম। পনেরো-ষোলোজন আরাম করে বসা যায়। ছোটকাকুর বাইক আমাদের গাড়ির সামনে ছিল। কে জানত দুটো ষাঁড় মাঝরাস্তায় মুখোমুখি শিং বাগিয়ে লড়াই করতে করতে ছোটকাকুর মোটর বাইকে এসে আছড়ে পড়বে? যাক এখন সে ভালোই আছে। শুধু ডান-পা’টা আস্তে আস্তে টেনে হাঁটছে।
শীত এবার যাব যাব করেও যাচ্ছে না। সত্যি অনেকদিন পরে এমন শীতের মজায় আমরা মাতোয়ারা হয়ে আছি। একবার স্কুলের বন্ধুরা আর একবার পাড়ার বন্ধুরা মিলে দু’ দুটো পিকনিক হয়ে গেল। আমাদের সকলের মনে মনে একটা গানই এখন অনর্গল বেজে চলেছে ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।’ ছোটকাকুর সত্যি কোনও তুলনা নেই। তাঁর নির্দেশমতো আগামীকাল বিকালে মিটিং বসবে বাড়িতে। কলকাতা বইমেলা শুরু হয়েছে ৩১ জানুয়ারি থেকে। ক’জন কীভাবে বইমেলায় যাব তার প্ল্যান তৈরি হবে আগামীকাল। যেমন প্রত্যেক বছর আমরা দঙ্গল বেঁধে বইমেলামুখী হই দুপুর দুপুর। এবারও তার অন্যথা হবে না।
গুসকরা থেকে সুবর্ণা আর রজত। ঝাপটের ঢাল থেকে পিনাকী, সুদর্শনা, ভেদিয়া থেকে রণিত, শামীমা আর রেফুল ভোরবেলার বিশ্বভারতী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ধরবে। আমি তুহিন, সুজন, সহেলী আর আসিফ উঠব বোলপুর থেকে। সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে হাওড়ায় পৌঁছে সেখান থেকে বইমেলার বাস ধরলে রবিবার দুপুর বারোটার মধ্যেই মেলার মাঠে পৌঁছে যাব। পরিকল্পনামতো সক্কলে হাওড়া স্টেশনে যখন বড় ঘড়ির নীচে এক জায়গায় হলাম তখন দশটা পঁচিশ। সেখান থেকে প্রথমে এলাম পার্ক স্ট্রিট মল্লিকবাজার। ছোটকাকু আমাদের সবাইকে সঙ্গে করে বিখ্যাত রেস্টুরেন্টে ঢুকে বিরিয়ানি খাওয়ালেন। তারপর বেকবাগানের মোড় অবধি হেঁটে এসে সেখান থেকে বাস ধরে সোজা বইমেলা।
দুপুর দেড়টার মধ্যে বইমেলায় প্রবেশ করে প্রায় একঘণ্টা ধরে আমরা যে কত স্টলে ঘুরলাম তার হিসেব নেই। পিনাকী বলল, ‘এখনও ফেলুদার বই জনপ্রিয়তার শীর্ষে মনে হল।’ শামীমা বলল, ‘রবীন্দ্রনাথের মতো জনপ্রিয় লেখক আজ পর্যন্ত কাউকে দেখলাম না।’ রণিত আওয়াজ দিল। ‘তুই রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিস?’ রজত বলল, কেন খেপাচ্ছিস রণিত! বইমেলায় তো আমাদের সময়কার স্বনামধন্য কয়েকজন লেখককে অটোগ্রাফ দিতে দেখলাম। অথচ কত কত মানুষজন ঢুকছেন মেলায়। বেশিরভাগ পাঠকের হাতেই তো কোনও বইয়ের ব্যাগ দেখলাম না! তারা কি ঘুরতে আসছেন? সুদর্শনা বলল, ‘এমনও হয় প্রথমদিন ঘুরে ঘুরে দেখে পরে একদিন বই কিনে নিয়ে যান।’ তুহিন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। ওর মুখের কথা ছোঁ মেরে সুবর্ণা বলল, আমি সেই ছেলেবেলায় ফিরে গিয়ে আবার সেই চিরকালের সেরা বই ‘পাগলা দাশু’ কিনেছি। দেখলাম আমাদের কেউ কিনেছে ছড়া, কেউ কবিতা, কেউ গল্প, উপন্যাস আবার কেউ কেবলমাত্র ভ্রমণকাহিনী।
মাঠের একটা ফাঁকা জায়গায় বসে বাদামভাজা খেতে খেতে আমরা যে যার মতো বইয়ের পাতা ওল্টাছিলাম। এই সময় ছোটকাকু বললেন, সেই কবে থেকে বইমেলায় আসছি। আমাদের কৈশোর কালে দেখেছি সববয়সি সব পাঠকের হাতে কোনও না কোনও বই। সেই ছবি এখন বদলে গিয়েছে। আগামীতে হয়তো আরও বদলাবে। অথচ সারা বইমেলা জুড়ে বিশ্বভারতী, প্রতিক্ষণ, দে’জ, কারিগর, গাঙচিল, পত্রভারতী, শিশু সাহিত্য সংসদ, লালমাটি, পারুল, দীপ প্রকাশন কী সুন্দর স্টল করেছে। ভালো লাগা প্রিয় বইদের এর মধ্যে থেকেই খুঁজে নিতে হবে। ছোটদের জন্য ভালো লিখছেন এমন লেখক তো এখনও কয়েকজন আছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, বলরাম বসাক, কার্তিক ঘোষ, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়দের বাদ দিলে এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন নবীন লেখক আমাদের ভরসার জায়গা।
সহেলী একটা কাগজে কয়েকজন লেখকের নাম লিখেছে। আমি বললাম তুই কিনবি নাকি এদের বই? সহেলী বলল এখান থেকে সেই বোলপুর পর্যন্ত বই টেনে নিয়ে যাওয়া খুব মুশকিল। সুবর্ণরেখা কিংবা রামকৃষ্ণের দোকানে তালিকা দিয়ে দেব। আমার প্রিয় লেখকদের বিরাট তালিকা। প্রচেত গুপ্ত, দীপান্বিতা রায়, জয়ন্ত দে, তিলোত্তমা মজুমদার, হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত, অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী, রাজেশ বসু, তপনকুমার দাস, ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুনির্মল চক্রবর্তী, সৈকত মুখোপাধ্যায়, দীপ মুখোপাধ্যায় সহ আরও অনেকে। যদিও এখন কিনেছি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘কর্ণেল সমগ্র’র একটা খণ্ড।
আমাদের পাশে বসে দুলকি চালে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ছড়ার বই থেকে পিনাকী ছড়া পড়তে শুরু করল—
‘আটুম লতায় কাটুম না
পয়সা কড়ি বাটুম না
শুইয়া থাকুম খাটুম না
আটুম লতায় কাটুম না।’
তারপর এইটুকু শেষ করেই বলল, ‘আমাদের সময়কার লেখকরা ঠিক এমন। কিছুতেই পরিশ্রম করে লিখতে চান না। তার চাইতে ছুটির দুপুরে শীতের চাদর গায়ে ছাদে উঠে লাল-নীল ঘুড়ি উড়িয়ে বলব—
আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম কী?
—কী আবার! এই অ্যাতো বড় করে বইমেলা হচ্ছে অথচ আজকাল আর কোনও বইচোর দেখা যায় না। বাবার কাছে কত বইচুরির গল্প শুনেছি। আমাদের বাড়িতেও এত বই অথচ কেউ বই পড়তেই নেয় না।
ছোটকাকু বলল, ‘এই না তুই লাল-নীল ঘুড়ি আকাশে উড়িয়ে কী বলবি বলছিলি পিনাকী?’
—ও, হ্যাঁ—
ঘুড়ি তোমার জুড়ি নেই
এখন আর বই চুরি নেই।