বিদ্যার জন্য স্থান পরিবর্তন হতে পারে। গবেষণামূলক কাজে সাফল্য আসবে। কর্মপ্রার্থীরা কোনও শুভ সংবাদ পেতে ... বিশদ
শীতের ছুটি মানেই দেদার মজা! মিঠে রোদ গায়ে মেখে ঘুরে বেড়ানো এবং খাওয়া-দাওয়া। আর কাছেপিঠে বেড়ানো মানেই চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, নিকো পার্ক, ইকো পার্ক, বিড়লা তারামণ্ডল এবং অবশ্যই উপরি পাওনা সার্কাস। শীতের সঙ্গে কমলালেবু আর ক্রিকেটের মতোই সার্কাসেরও যেন একটা অদ্ভুত যোগ রয়েছে। এখন বিনোদনের হাজার পসরার মাঝে সার্কাস হয়তো বর্তমান প্রজন্মের কাছে তার আগ্রহ হারিয়েছে, কিন্তু তবু এখনও যেন নিয়ম মেনেই ফি বছর সার্কাসের তাঁবু পড়ে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে। এবার যেমন পাটুলি এবং বরানগরে চলছে যথাক্রমে ফেমাস সার্কাস এবং অজন্তা সার্কাস।
আগে সার্কাসের প্রধান আকর্ষণ ছিল বাঘ-সিংহের খেলা। জ্বলন্ত রিংয়ের ভিতর দিয়ে বাঘ লাফিয়ে চলে যাচ্ছে। সিংহ সামনে রাখা টুলের ওপর পা তুলে দর্শকদের অভিবাদন জানাচ্ছে। হাতি ফুটবলে শট মারছে। ভল্লুক বল নিয়ে নানারকম কেরামতি দেখাচ্ছে। আর হাততালিতে ফেটে পড়ছে সার্কাসের তাঁবু। কিন্তু, এখন নিয়মের গেরোয় সার্কাসে বাঘ, সিংহ, হাতি, ভল্লুকের খেলা দেখানো নিষিদ্ধ। তাই, সার্কাসের চরিত্রও কিছুটা বদলেছে। এখন দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য বেশি করে জোর দেওয়া হচ্ছে ব্যালান্সের খেলা, ট্রাপিজের খেলা, বাইকের কসরত, অ্যাক্রোবেটিক প্রদর্শন এবং হাস্যকৌতুকের উপর। ফেমাস সার্কাসের যেমন মূল আকর্ষণ উটের খেলা, প্রকাণ্ড জলহস্তীর বাঁধাকপি খাওয়া, রোমাঞ্চকর পাঁচফলা বর্ষার খেলা প্রভৃতি। চিড়িয়াখানায় দূর থেকে খাঁচার মধ্যে দেখা জন্তুগুলিকে কয়েক হাত তফাতে দেখার এমন সুযোগ সার্কাসেই পাওয়া যায়। কাকাতুয়াকে ডিগবাজি খেতে দেখলে বা তিন চাকার ছোট গাড়ি চালাতে দেখলে মজা তো লাগেই! এছাড়া জোকারের ভাঁড়ামি তো রয়েইছে।
মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে, এই সার্কাসের অতীত ইতিহাস কী? কীভাবে এই খেলার জন্ম হল? ভারতেই বা কীভাবে এই বিনোদন তার জায়গা করে নিল? সে কথাই বলব, তবে তার আগে দেখে নেওয়া যাক ‘সার্কাস’ শব্দটির অর্থ কী? লাতিন ‘circus’ থেকে এর উৎপত্তি। যা এসেছে গ্রিক ‘kipkos’ বা ‘kirkos’ শব্দ থেকে। এর অর্থ হল রিং বা বৃত্ত। আর এই রিংয়ের ব্যাস মোটামুটি ৪২ ফুট (বা ১৩ মিটার)। রিংয়ে যিনি খেলাগুলি পরিচালনা করেন, তাঁকে বলা হয় রিং মাস্টার। জানা যায়, ‘সার্কাস’ নামকরণটি করেন প্রখ্যাত ব্রিটিশ গীতিকার, সুরকার, লেখক ও অভিনেতা চার্লস ডিবডিন। কথিত আছে, সার্কাসের জন্ম রোম সাম্রাজ্যে। গ্রিকদের বিভিন্ন খেলাই ছিল রোমানদের সার্কাসের প্রধান অনুপ্রেরণা। রোমে আয়োজিত প্রথম সার্কাসটি হল সার্কাস ম্যাক্সিমাস। গুরুত্বের বিচারে এর ঠিক পরেই থাকবে সার্কাস ফ্ল্যামিনিয়াস, সার্কাস নেরোনিস এবং সার্কাস ম্যাক্সেনটিয়াস। তারতুলিয়ন (তিনি ছিলেন একজন খ্রিস্টান) তাঁর বই ‘দি স্পেকটাকুলিস’-এ লিখেছেন, বাবা হেলিয়সের (সূর্যদেব) জন্য প্রথম সার্কাসের খেলা দেখিয়েছিলেন দেবী সিরসে। তবে, আধুনিক সার্কাসের জনক হলেন ইংল্যান্ডের ফিলিপ অ্যাসলে। ১৭৪২ সালে নিউক্যাসেলে তাঁর জন্ম। ১৭৬৮ সালে (৪ এপ্রিল) লন্ডনে আয়োজিত প্রথম সার্কাসে তিনি ঘোড়া নিয়ে নানারকম কসরত দেখান। ১৭৭০ সালে তাঁর সার্কাসে যোগ হয় অ্যাক্রোব্যাটিক স্কিল, দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, জাগলিং শো এবং জোকারের ভাঁড়ামি। তবে, প্রকৃত অর্থে সার্কাসে জোকারের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৮০৫ সালে। সার্কাসের ইতিহাসে প্রথম জোকার হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে ব্রিটিশ অভিনেতা জোসেফ গ্রিমালদির নাম। আর ট্রাপিজের খেলার জন্মদাতা বলা হয় ফরাসি অ্যাক্রোব্যাট জুলস লিওটার্ডকে।
এবার ভারতের দিকে চোখ ফেরানো যাক। ভারতে সার্কাসের প্রবর্তন হয় মহারাষ্ট্রের আনকাখোপ গ্রামের বাসিন্দা দক্ষ অশ্বারোহী বিষ্ণুপন্থ ছাত্রের হাত ধরে। তিনি ছিলেন রাজা কুর্দুওয়াদির আস্তাবলের দেখভালের দায়িত্বে। তবে, ভারতীয় সার্কাসের জনক বলা হয় কিলেরি কুনহিকান্নানকে। তাঁর জন্ম কেরলের থালাসেরিতে। তাই, কেরলকেই বলা হয় ভারতীয় সার্কাসের ধাত্রীগৃহ। ১৭৭৪ সালে প্রথমবার ভারত সফরে (তদানিন্তন বম্বেতে) এসেছিল গিউসেপ্পি চিয়ারিনির রয়্যাল ইতালিয়ান সার্কাস। তাদের দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েই ১৮৮০ সালের ২০ মার্চ প্রথম শোয়ের আয়োজন করে বিষ্ণুপন্থের গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস। জানা যায়, কেরলে প্রথম সার্কাস দল তৈরি করেন বিষ্ণুপন্থের ছাত্র পারিয়ালি কান্নান। দলের নাম দেন গ্র্যান্ড মালাবার সার্কাস (১৯০৪)। কুন্নিকান্নান প্রশিক্ষণের জন্য একটি স্কুল খুলেছিলেন। তার নাম চিরাক্কারা সার্কাস স্কুল। সেই স্কুলের ছাত্ররা পরবর্তীকালে বেশ কয়েকটি সার্কাস দল তৈরি করেছিলেন। যেমন হোয়াইটওয়ে সার্কাস, গ্রেট রেমন সার্কাস, গ্রেট লায়ন সার্কাস, ফেয়ারি সার্কাস, ইস্টার্ন সার্কাস, ওরিয়েন্টাল সার্কাস, জেমিনি সার্কাস, গ্রেট বম্বে সার্কাস, কমলা থ্রি রিং সার্কাস প্রমুখ।
সময় বদলেছে। বদল হয়েছে পরিস্থিতির। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে মানুষের চাহিদা ও রুচি। বর্তমানে সার্কাসের আড়াই ঘণ্টার শোয়ের আকর্ষণ যেন অনেকটাই হারিয়েছে। বিষয়টি একটু তলিয়ে দেখলেই সার্কাসের সমস্যার বিষয়টি কিছুটা আন্দাজ করা যাবে। একটা সার্কাস দলে কমবেশি জনা ষাটেক লোক থাকেন। তার উপর জন্তুজানোয়ার, পাখির রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বিপুল। এছাড়া, শো আয়োজনের খরচও রয়েছে। সব মিলিয়ে গড়ে দিন প্রতি কমবেশি হাজার ৪০-এর মতো খরচ লাগেই। শুধু টিকিট বিক্রি থেকে এই বিপুল খরচ মেটানো বেশ সমস্যার। জন্তুজানোয়ার ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের পর শারীরিক কসরতের খেলার উপর জোর দিতে হচ্ছে। কিন্তু, কম টাকা এবং ঝুঁকির কারণে এই পেশার প্রতি এখন অনেকেই আগ্রহ হারাচ্ছেন। ফলে, প্রতিভার খোঁজে এবং শোয়ের আকর্ষণ বাড়াতে এজেন্টের মাধ্যমে বিদেশ থেকে কলাকুশলী আনতে হচ্ছে। পাটুলির ফেমাস সার্কাসে যেমন রয়েছেন কেনিয়ার ছ’জন। এখানকার জলহস্তীটিকে আনা হয়েছে সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। বহু বছর ধরে সে এই দলের সঙ্গেই ঘুরছে। বিপুল খরচ সামাল দেওয়ার জন্য সারা বছর বিভিন্ন জায়গায় তাঁবু ফেলে শো করতে হয় সার্কাসের দলগুলিকে। কিন্তু,
আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ফারাকটা থেকেই যায়।
তবে, সময় বদল হওয়া সত্ত্বেও ‘সার্কাস’ নামের মধ্যেই যেন লুকিয়ে রয়েছে একটা নস্ট্যালজিয়া! রয়েছে এক অদ্ভুত মাদকতার হাতছানি। আর তাই অনেক আশা নিয়ে ফি বছর শহরের বুকে তাঁবু ফেলে সার্কাসের দল। হাজির হয় বিনোদনের নিত্যনতুন ডালি নিয়ে। বাঘ, সিংহ, হাতি না হোক, চোখের সামনে উট, জলহস্তীর কেরামতি দেখার সুযোগটাও কী কম? কিছুক্ষণের জন্য অন্তত একটু অন্যরকম বিনোদনের স্বাদ চাখাই যায়! তাই না?
ছবি: ভাস্কর মুখোপাধ্যায়