ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
গণেশ টুডু এই মৌজার রাজা। গাঁয়ের মেয়ে-মুনিষ সব উয়ার খেতে ভাতুয়া খাটে। গাঁয়ের একমাত্র কোঁচাঘাট, টুসুমেলার থান, বিলাইতি গাছের বাগান... সবই তার। গাঁয়ের সব জমিন, দলিল, কাঁসা-পেতলের বাসন, মাদল, ধামসা, এমনকী বউ ছেলেমেয়ে পর্যন্ত বন্ধকি আছে তার কাছে। একটা বিশাল গোরখপুরী সিন্দুক। কাগজে কাগজে ভর্তি, কাঁসা-পেতল-অ্যালুমিনিয়ামের থালা-বাটি-গেলাস-সানকি, মরচে পড়া টাঙ্গি-বল্লম-লাঙল। সব বন্ধকি!
লখনের নিজের ভাই মাড়ুয়া, সব বন্ধকি দিয়ে সদরে ইটভাট্টিতে কাজ করতে চলে গিয়েছে। হা সিংবোঙ্গা! ধানজমি ঘরদুয়ার ছেড়ে শহরে কুলিগিরি!
গণেশের ভাই সোমবারি গোরামথানের আসল লোক। মুরগা-পাঁঠা-কাঁড়া বলি দেয় যখন, দেখলে ভয় লাগে। সেই সোমবারির অসুখ। হতে পারে?
রঙ্কনথানে ফি-বছর কাঁড়া বলি, গোরামথানে বিশ-তিরিশটা মুর্গা বলি, জাহিরাথানে ফি-পরবে পাঁঠা বলি, গনগনির ডাঙ্গায় মোম জ্বালিয়ে পূজা। চাতবোঙ্গায় সেন্দ্রা-উত্সব, বৈশাখবোঙ্গায় অযোধ্যা-সেন্দ্রা, জ্যেঠবোঙ্গায় রাজা-সাকরাত, আষাঢ়বোঙ্গায় চিতাউ-পরব।
‘কন পূজায় কমতি নাই, তব্যে?’
দুই
যত দোষ ওই জামুনির। কেউ কখনও শুনেছে, বিটিছেল্যাকে ইশকুলে পাঠায়? জুগিন মাস্টার সদরে পড়ালিখা শিখে আসছে, গাঁয়ের খোকাগুলাকে ইশকুলে পড়াতে নিয়ে যায় তাই। আর জামুনি সেইসঙ্গে চূড়ামণিকেও ইশকুলে পাঠাতে লাগল!
বুড়া পাহান কত্ত বুঝিয়েছিল, ‘মেয়াটাকে ডান বানাইবি তু! বিটিছেল্যা পড়ালিখা করলে ডান হয়।’
শুনল কোনও কথা? একা একা শান্ত উদ্ধত ভঙ্গিতে খেতে কাজ করে, গোরু-ছাগল চরায়, জঙ্গলের পথে হেঁটে বেড়ায় একা একা। তখনই বোঝা যাচ্ছিল, উয়ার মাথায় ডান ভর করেছে। নইলে লতাগুলা উয়ার কথা শুনে ইমন?
পিলুরামের বিটি ফুল্লরাকে লতা কাটল যখন, কাপড় বেঁধে কেমন বিষ নামিয়ে দিল? ফুল্লরাকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে চলে গেল! হাসু গুনিন,পুন্নু গুনিন কাউকে একটা খবর করল না?
বুনো আগুন। লখনের সঙ্গে বিয়া হয়ে গাঁয়ে এল, সব জুয়ানদের বুকে হুহু বাতাস। নীল নীল কালো শরীর, গা দিয়ে তেল ঝরে এমন চকচকে। খোলাচুলে জবাফুলের গন্ধ। টুসুমেলায় আয়না, চিরুন নিয়ে ভাব জমাতে চেয়েছিল সোমবারি। সেন্দ্রা-পরবে নাচের আগে রুপোর মল পাঠিয়ে সঙ্গে নাচের প্রস্তাব দিয়েছিল রাজা গণেশ টুডু নিজে। সাড়া দেয়নি জামুনি।
তখনই সবাই সন্দেহ করেছিল, জামুনি আসলে ডাইনি। ডান না হলে এত জোর হয়? নিজের মরদ লখনের কথা বাদই দাও, দেওর মাড়ুয়া পর্যন্ত ভেড়ুয়া বনে গেছে। আর লখনের বাপ-মা? বহু বলতে অজ্ঞান!
গাঁয়ের কিছু বহু বিটিও বলতে লাগল,‘যেখানে যত মরদ,সব্বাই উয়ার দিকে ছুটে যায় কেনে?’
মাড়ুয়া গাঁ ছেড়ে গেল, সে নিয়ে গণেশ সোমবারির মায়ের কাছে, বাড়ির বউদের কাছে ছুটে এসেছিল জামুনি। নাকি মিছা কথা বুঝায়ে উয়ার ভাগের জমিন বাঁধা রাখা হয়েছে। সাহস দেখো। ই বহুটা গাঁয়ের ভালো বহুগুলাকেও বিগড়ে দিচ্ছে। ডান না হলে এমন হয়?
তারপরই এই সোমবারির অসুখ। জামুনির চোখ আর তাপ লেগেই হয়েছে, এ তো সব্বাই বুঝতে পেরেছে। গণেশ টুডু বলেছে, ‘লখন যদি বহুকে না ছাড়ে, তার মানে লখনও ব্যাটাছেলে-ডান। দু’জনকেই গাঁ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে।’
দোষের মধ্যে লখন বলেছিল, ‘জামুনি ডাইন হবে কেন? সোমবারির তো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাবার মতনই অবস্তা হয়েছে।’ এতেই খেপে উঠেছে গাঁয়ের লোক। বউ একটা সোমত্ত ষাঁড়া জুয়ান ছেল্যাকে ‘খেয়ে ফেলছে।’
অঝোরে বৃষ্টি চলছিল। গ্রাম লাগোয়া জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পালিয়ে এসেছে জামুনি। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে জুগিন মাস্টারের কাছে পৌঁছতে হবে। মাস্টার সদরে নিয়ে যেতে পারবে। গাঁয়ের মধ্যে নিরাপত্তা চাই। জন্ম থেকেই জঙ্গলের গ্রামে বাস। ছেলেমেয়ে রয়েছে। কী করে হঠাৎ ডাইনি হয়ে গেল জামুনি?
না পালিয়ে করবে কী? এদিকের জঙ্গলের গ্রামে ডাইনি বলে কত মেয়েকে যে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, বাইরের দুনিয়ার লোক সে খবর জানে না।
তিন
এ পাহাড়ে গরমকালে শালফুল কুসুমফুলে মনমাতাল। বসন্তকালে বেদম পলাশ ফোটে, সঙ্গে জারুল, শিমুল, কুর্চি। শীতকালে ঘন কুয়াশা। সবে কালীপূজা গেল, দু’দিন পরে বাদনা পরব। এখনই শীতের মতো কুয়াশা। না, শীতের কুয়াশা না। বৃষ্টি পড়ছে কাল থেকে। অসময়ে জঙ্গলের বৃষ্টি। তাই এমন।
এই বৃষ্টির মধ্যেই দৌড়ে দৌড়ে সাঁঝাডুংরি কমলডি কালাচাঁদবুরু পেরিয়ে এসেছে জামুনি।
ঘুরে ঘুরে আসতে হয়েছে, কারণ গোরামথানের পাশের চট্টানে বসে মহুয়ার নেশা করছিল সোমবারি। সামনে দুটো খাঁড়া। ফুল, বেলপাতা। ডান-বলি দেবে আজ। এদিকের জুনু টুডুর খেতের পাশের জঙ্গলের মুখে হাসু-পিলুরাম-মাংলা খোঁজাখুজি করছে। বুড়ি শাশুড়ির জন্য ভয় করছিল জামুনির। উয়ারা যদি ঘরে আগুন দেয়!
এতক্ষণে গাঁয়ের সিঁয়্যার পেরিয়ে এসে একটু বসেছে। পায়ে অনেক জায়গায় কেটে গেছে, নখ উপড়ে গেছে। কনুই থেকে তিরতির রক্ত পড়ছে। তবু থামেনি জামুনি। ভোর হবার আগেই জুগিন মাস্টারের কাছে পৌঁছতে হবে।
কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে বেশি দূর যেতে পারেনি জামুনি। একলা জঙ্গলে বসে বাড়ির জন্যে মনখারাপ করছে।
অন্ধকারে চোখ সয়ে এসেছে। এখানে জঙ্গল হালকা। ফাঁকা ফাঁকা। আগে এদিকটায় মহুয়া পলাশ অর্জুন বহেড়া কুসুম বট অশ্বত্থ, কত গাছই না ছিল। বনের মধ্যে শান্ত নদী, ভোররাতে সেখানে জল খেতে আসে সব জন্তু জানোয়ার।
জানোয়ারের কথা ভাবতেই মনে পড়ে গেল, এদিকের পড়িহা ঝিটকার জঙ্গলে পঞ্চাশ-ষাটটা হাতির একটা দল ঘোরাফেরা করছে বেশ কয়েকদিন ধরে। ক’দিন আগে রাতের অন্ধকারে একটি দাঁতাল জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গ্রামে ঢুকে নীলমণিদের বাড়ি ঘর ভাঙচুর করেছে। হাতির উৎপাতের ভয়ে রাতভর জেগে আছে গ্রামের মানুষ। এমনিও জঙ্গল লাগোয়া খেতগুলোর সীমানা বা সিঁয়্যারগুলোয় বুনো শুয়োর, বন্যপ্রাণীর উৎপাত কমাতে বাজি-পটকাভর্তি ফল, আনাজ রাখা থাকে। দাঁতাল এলে সিঁয়্যারে বিস্ফোরক ফেটে যাবে। আর উয়ারা ভয়েই পালিয়ে যাবে।
কিন্তু... দাঁতালগুলো যদি এদিকে চলে আসে?
ভাবতে না ভাবতেই চোখে আঁধার নেমে এল। পাহাড়ের মতো কালো দাঁতাল একটা। হা সিংবোঙ্গা! ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল জামুনি।
একটা শব্দ হল। হাতিটা কি দেখে ফেলেছে জামুনিকে?
আবার শব্দ। হাতিটা চিত্কার করে উঠেছে। ও কি দলছুট? তাই আওয়াজ করে ডাকছে অন্যদের? আবার আওয়াজ করল হাতি। একটা যন্ত্রণার আওয়াজ কি? দাঁড়িয়ে আছে কেন ও?
হাতিদের সঙ্গে গাঁয়ের লোকের একটা অকথিত চুক্তি আছে। কেউ কোনওদিন দেখেনি, বাদনা পরবের দু’দিন কোনও হাতি ধান খেয়ে গেছে। জানোয়ার হলে কী হয়, খুব বুঝমান আছে উয়ারা। তাছাড়া গ্রামরক্ষী দল তৈরি আছে। দল বেঁধে রাত জাগে, হাতে ক্যানেস্তারা, মশাল-বাজি-পটকা-তিরধনুক। বিডিও অফিস থেকেও মশাল জ্বালার কেরোসিন, পটকা সব দেয়। ভয়ে হাতি গাঁয়ে ঢুকতে পারে না। কিন্তু জঙ্গলের মুখে দাঁড়িয়ে খুব চিত্কার করে। রাগে পাগল হয়ে যায়। সে সময় একলা কাউকে পেলে পাথরে আছড়ে ফেলে।
চার
মনে মনে বলতে লাগল জামুনি, ‘তুমি আমাদের দেবতা। আমি জংলি বিটি বাবা। আমাকে মেরে ফেলো না। আমাকে যেতে দাও।’
মাত্র দু’দিন আগে লখনকে বলেছিল জামুনি, ‘বাদনা পরবের সময় তো দাঁতাল আসে না। এত বছরে কোনওদিন আসেনি। তাহলে সিঁয়্যারে এত পটকা রাখছ কেনে? হাতি তো আমাদের গণেশ বাবা, দেবতা— উয়াকে খুশি রাখতে হয়।’
সেই কথা শুনে গণেশ টুডু নাকি খুব রাগ করেছিল, ‘আরে মুখ্যু, হাতির জন্য সারা দুনিয়ায় কত কিছু চলছে জানিস? মানুষ মারার কমপেনসেশন, কথাটা শুনেছিস? উ দাঁতাল পাগলা হলে আমাদের কত লাভ, জানিস কিছু?’
একপ্রকার তাড়িয়েই দিয়েছিল লখনকে। ‘কিছু একটা চলছে, বুঝলি?’ লখন বলেছিল, ‘বিরজু আর মাংলা বলল, উয়ারা এবার তিনপুরুষের ধানজমি সব ফিরত পাবে। আমাকে বলল, চুপ থাক। পাগলা দাঁতাল কাউকে মারলে লোকের ভালো হবে।’
পাগলা দাঁতাল কাউকে মারলে সারা গাঁয়ের ভালো হবে? মানে? অনেক ভেবেও এই কথাটার মানে বুঝতে পারেনি জামুনি। গতকাল সোমবারিকে দেখতে গিয়ে কথাটা তুলেছিল একবার।
এখন হঠাত্ মনে পড়ে গেল।
আচ্ছা, এই দুটো ব্যাপারে কি কোনও মিল আছে? জামুনিকে ডাইনি অপবাদ তো সেই কবে থেকেই দিয়ে আসছে সবাই। হঠাত্ সোমবারির অসুখের সঙ্গে, গ্রামে আগামী কোনও এক মহামারীর সঙ্গে কেন জড়িয়ে ফেলা এই ডাইনি অপবাদ? তাহলে কি হাতি নিয়ে কথা বলাটা ভুল হয়েছে?
কী করতে চাইছে হাতি নিয়ে?
কাঁদন একটা গোপন কথা বলেছিল। হাসু, মাংলা নাকি গুরুদারী দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল চোরের মতো। ওরা নাকি হাতি খেদিয়ে আনতে যাচ্ছিল। অবাক হয়েছিল জামুনি। গাঁ থেকে, ধানখেত থেকে হাতি খেদিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু হাতিকে খেদিয়ে গাঁয়ে আনবে কেন কেউ?
পাশের খেতে কাজ করতে করতে পুন্নুও বলেছিল, ‘কেন যে পাগলা হাতি আনছে গাঁয়ে? গণেশ-বাবাকে কোনও বিশ্বাস লাই।’
সত্যি গণেশবাবাকে বিশ্বাস নেই। কিছুদিন আগেই গাঁয়ের লোক গিয়ে বনদপ্তরে হাতির নামে নালিশ লিখিয়ে এসেছে। ফরেস্টার-বাবুরা এসে বন্দুক নিয়ে আকাশে গুলি ছুড়ে হাতি খেদিয়ে দূরের জঙ্গলে পাঠিয়ে দিয়ে এসেছিল।
তাহলে? সেধে কেউ হাতিকে গাঁয়ে নিয়ে আসে?
কিছু একটা ব্যাপার আছে। এই নিয়েই সোমবারির বহুর কাছে জানতে চেয়েছিল জামুনি। কথা শুরু করতেই ‘শরীর হলুদ হয়ে গেছে সোমবারির’,‘তু আমাদের ছেল্যাটাকে খেতে আসছিস’ বলে তাড়া করল সোমবারির মা।
পাঁচ
হাতিটা আবার চিত্কার করে উঠল। এটাই কি সেই পাগলা হাতি? দুটো শজারু ভয় পেয়ে ছুটে পালিয়ে গেল। আস্তে সামনের অর্জুনগাছটার আড়ালে দাঁড়াল জামুনি।
একটা বাচ্চা হাতিকে টেনে আনছে মা-হাতি। একটু করে টেনে আনছে, আর বাচ্চা-হাতিটা বেজায় চিৎকার করছে। সেই শুনে মা-হাতি আরও জোরে চিৎকার করছে। বাচ্চা-হাতির পায়ে লেগেছে বোধহয়, চলতেই পারছে না। পা দিয়ে গলগল করে রক্ত ঝরছে।
এবার বুঝেছে জামুনি। মা-হাতিটা মোটেই পাগল নয়। বাচ্চার পায়ে লেগেছে বলে ওরা দুজনে দল থেকে আলাদা হয়ে গেছে। দলের সঙ্গে হেঁটে যেতে পারেনি। নাকি হাতি খেদানোর দল ওদের তাড়া করে গাঁয়ের দিকে নিয়ে এসেছে? বাচ্চা-হাতির পায়ে এতবড় একটা ঘা হল কি করে? ওই বিস্ফোরক বাজির জন্যে?
দূরে কোথায় অনেকগুলো মশাল জ্বলে উঠল। হইহই করে ক্যানেস্তারা বাজছে। আগুনে জঙ্গলের ওদিকটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে পলকে মা-হাতি উঠে দাঁড়িয়েছে। চিত্কার করে উঠেছে। চারধার কেঁপে উঠেছে।
এবার বুঝেছে জামুনি। ঠিক ঠিক বুঝেছে। ওরা এটাই চায়। হাতিটা রাগে চিত্কার করুক, গনগন রাগে ছুটে যাক গাঁয়ের দিকে, ধান নষ্ট করুক, একটা দুটো মানুষ মারুক। তবেই তো কমপেনসেশন। হ্যাঁ,এই কথাটাই বলেছিল লখনকে। মানুষ মারার কমপেনসেশন।
এই ক’দিন আগে কোথায় যেন একটা গর্ভবতী হাতিকে বাজি-পটকা ভর্তি আনারস খাইয়ে মেরে ফেলেছে কিছু মানুষ। মা-হাতিকে খেদানোর কথাটা সেই থেকেই বুঝি মাথায় এসেছে গণেশ টুডুর? হাতিবাবার নামে নাম, আর মনে এত আঁধার!
মা-হাতি বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত আছে, সেই ফাঁকে আস্তে গাছের পাশ থেকে সরে এল জামুনি। গ্রামের মেয়ে, গ্রামের বউ। অনেকরকম ওষুধ জানে শাশুড়িমা। দিকুমাঝির ঠাকুমাও জড়িবুটি দিয়ে অনেক রোগ সারায়। তবে অন্ধকার এমন, তার ওপর বৃষ্টি পড়ছে, গাছ খুঁজে পাওয়াই মুশকিল।
দেরি করলে চলবে না। ওদের মা আর বাচ্চাকে ঘন জঙ্গলের দিকে সরিয়ে দিতে হবেই। নইলে ওদের বিপদ, জামুনিদের সবারই বিপদ।
চুপিচুপি গাছের আড়াল দিয়ে হাতির কাছ পর্যন্ত পৌঁছবার আগে মা-হাতিও টের পায়নি। কাছে গিয়েই জামুনি বাচ্চা-হাতিটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করল। আর বলতে লাগল, ‘কিছু হবেক না তুমার ব্যাটার। তু ভয় পাস না মা। আমি তুর মাইয়া বটে।’
বারবার বলতে লাগল। মা-হাতি কী বুঝল কে জানে, তেড়ে গেল না, চিৎকারও করল না।
তারপর বাচ্চা-হাতির পায়ে ওষুধ লাগাতে বসল জামুনি। ওষুধ দিয়ে কাপড় দিয়ে বাঁধার জন্য নিজের শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে নিল জামুনি।
বাচ্চা-হাতি প্রথমে ছটফট করছিল, একটু পরে শান্ত হয়ে মাথাটা মাটিতে নামিয়ে রাখল
দূর থেকে এগিয়ে আসছে মশাল। এইদিকেই। ভয়ানক ছ’সাতটা লকলকে শিখা। আকাশ কাঁপিয়ে চিত্কার করে উঠল হাতি-মা। তাকে লক্ষ্য করে ছুটে আসে জ্বলন্ত মশাল। তির। হাতি তীব্র চিত্কার করে ওঠে আবার।
কিন্তু আর ভয় করছে না জামুনির।
বুক দিয়ে আগলে রাখল ছোট্ট হাতিকে। মশালের ভিড়টা যখন আরও এগিয়ে এল, হস্তীশাবকের শরীর আড়াল করে উঠে দাঁড়াল জামুনি, ‘হিম্মত থাকে তো আয় কেনে?’
থমকে দাঁড়িয়েছে সবাই। জঙ্গল ভোরের প্রথম আলোয় লাল। সেই লাল আলো মেখে খোলা চুলে হাতিকে আগলে দাঁড়িয়ে আছে ডাইনি। কালো দু’চোখে মশালের আলো পড়ে জ্বলজ্বল করছে। ভিড়টা ভয়ে আওয়াজ করে উঠল। শিউরে উঠল। ডাইনি!
ঠোঁটের দু’পাশে হাত রেখে গলার শির টানটান, ‘হো ও ও ও ...’
কেমন লম্বা হয়ে যাচ্ছে জামুনির শরীর। তিন চারবার ডাকের পর নেমে এল একপাল কালো কালো মস্ত শরীর। ভিড়টা ভয়ে আওয়াজ করে উঠল আবার। এতগুলো দাঁতাল একসঙ্গে! আজ আর কারও নিস্তার নেই। মা-হাতির পায়ে হাত দিয়ে বসল জামুনি, ‘তুমরা যাও গ। কেউ তুমাদের কুনো ক্ষতি করবেক নাই।’
তারপর হাত তুলে দাঁড়িয়ে রইল। স্থির দাঁড়িয়ে রইল ডাইনি-জামুনি। বরাভয় মূর্তি। ঠিক যেন রঙ্কন-মা। ঠিক যেন বনদেবী।
বহুদূর থেকে একটা আওয়াজ। ডিম ডিমা ডিম ডিম। আকাশে বাতাসে বাঁশির সুর। হাতির পাল চলে গেল গভীর জঙ্গলের দিকে। তখনও স্থির দাঁড়িয়ে আছে জামুনি।