ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
বৃদ্ধার বলার মধ্যে এমন কিছু ছিল যে, রাইয়ের গলার কাছে দলা পাকিয়ে থাকা বোতলের দৈত্যের মতো কষ্টটা একটু একটু করে বাইরে বেরিয়ে আসে। আর সেটা গোপন করতে তাড়াতাড়ি চোখেমুখে জলের ঝাপটা দেয় রাই। বিশুদ্ধ চোখের জল আর পিউরিফায়েড ওয়াটার একাকার হয়ে যায়। বাকি জলটুকু গলায় ঢেলে দেয়। বৃদ্ধার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসে। বৃদ্ধা আর বাড়তি কৌতূহল দেখায় না।
রাই বরং জিজ্ঞাসা করে, ‘কোথায় নামবেন?‘
‘হাবড়া।’ উত্তর দিয়ে আবার মৌন হয়ে যায় বৃদ্ধা।
আগে এই ট্রেনে যাতায়াতের পথে ট্রেন-সম্পর্কে কত জন কত কিছু হয়ে উঠেছিল। কারও কারও সঙ্গে বাড়ি পর্যন্ত যাতায়াতের গল্পও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ভালো-মন্দ রান্না করলে নিয়ে আসা, ভাগ করে সিটে বসা, পুজো পালাপার্বণে উপহার দেওয়া নেওয়া পর্যন্ত। সে সব যেন অতীত। রাই বরাবর মিতভাষী। অরুণের চলে যাওয়ার পর থেকে আরও হয়ে গিয়েছে। আর সিদ্ধার্থ বিদেশে পড়তে চলে যাওয়ার পর যেন মূক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখন এই বৃদ্ধার সঙ্গে খুব কথা বলতে ইচ্ছা করে। তাই জিজ্ঞাসা করে, ‘এখন বাইরে বেরিয়েছেন, খুব দরকার ছিল?’
বৃদ্ধার বেশভূষা বলে দিচ্ছে নিম্নবিত্তের গল্প।
উত্তর দেয়, ‘না গো মেয়ে, বাবুসোনাকে দেখতে গিয়েছিলাম। বারাসাতে একটা পাঁচ বছরের বাচ্চাকে আমি দেখাশোনা করতাম। তা ওর মা-র গতবার লকডাউনের সময় থেকে ঘরে বসে কাজ শুরু হয়েছে। তাই আমাকে আর বাবুসোনাকে দেখতে হয় না। সেই জন্ম থেকে কোলেপিঠে মানুষ করেছি তো ভুলে থাকতে পারি না। মাঝে মাঝে দেখতে চলে যাই। ওর মা গেলে না খাইয়ে ছাড়ে না। বাড়িতে এখন বের হলে খুব বকে। কিন্তু কী করব বড্ড মায়া গো বাবুসোনার প্রতি। দেখলেই এসে গলা জড়িয়ে ধরে। তা ওর মা আজ বলল, মাসি, এ অবস্থায় এখন এসো না, একটু ঠিক হোক সব। ঠিকই বলেছে। কিন্তু কবে যে সব ঠিক হবে!’
রাইয়ের সমস্ত কথারা ফুলঝুরির আগুনের মতো চারদিকে ছড়িয়ে যেতে থাকে, গুছিয়ে কিছু বলবার মতো শব্দবন্ধ তৈরি হয় না। বৃদ্ধার ঘোলা ঘোলা চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
বৃদ্ধা হাসে। বলে, ‘দাঁড়াও মেয়ে তোমাকে বাবুসোনার ছবি দেখাচ্ছি’, বলে জায়গায় জায়গায় আস্তরণ উঠে যাওয়া কোনও এক সময়ের খয়েরি রঙের চামড়ার ব্যাগের ভেতরে প্লাস্টিকে মোড়ানো প্যাকেট থেকে খুব যত্ন করে একটা কাগজের প্যাকেট বের করে। তার ভেতর থেকে গোলগাল ছোট্ট একটা বাচ্চার ছবি বের করে মেলে ধরে রাইয়ের সামনে।
রাই একটু ঝুঁকে ছবিটা দেখে বলে, ‘খুব মিষ্টি।’
‘খুব দুষ্টু। এটা ওর তিন বছর জন্মদিনের ছবি।’ বলবার সময় গলাটা কেঁপে যায় বৃদ্ধার।
মুখ তুলে রাই দেখে বৃদ্ধার দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে যাচ্ছে।
রাই কী যেন বলতে যাচ্ছিল তার আগেই ট্রেন থামে।
‘ওই দেখো কথায় কথায় হাবড়া এসে গিয়েছে,’ বলে উঠে পড়ে। নেমে যায় বৃদ্ধা। রাইয়ের জানা হয় না ওর বাড়িতে কে কে আছে। বা ওই বাচ্চাটার বাড়ি থেকে কিছু করে হলেও মাইনের টাকা দেয় কি না।
বৃদ্ধা জানলার দিকে তাকিয়ে একটু হাসে। তারপর ধীরে ধীরে স্টেশনের বাইরে যাওয়ার দিকে হাঁটতে শুরু করে।
রাই যে কোনওদিন খুব একটা প্রচণ্ডরকমের হাসিখুশি উচ্ছল ধরনের ছিল তা না। তবে প্রাণবন্ত পজিটিভ ভাইভস যাদের আছে তাদের সঙ্গ বরাবরের পছন্দের ছিল। আর এখন এই দেড় দু’বছর ধরে সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। হুল্লোড় করে বেঁচে থাকা বা বাঁচতে জানা মানুষগুলো কোথায় যে সব হারিয়ে গেল! অসময়ের শ্রাবণ মেঘ ঢেকে দিয়েছে মানুষের যাপিত জীবন। ট্রেনটা আবার স্পিড নিয়েছে। দৌড়োচ্ছে তার গন্তব্যের দিকে। উদাসীন দৃষ্টিতে রাই জানলার দিকে তাকিয়ে। খুব গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। নিজেকেই যেন বলে, ‘এভাবে আর কত দিন!’
আর তখনই একটা চেনা কণ্ঠ ডেকে ওঠে, ‘রাই দিদি, কেমন আছো? কত্তদিন পরে দেখলাম গো।’
রাইও সোজা হয়ে বসে খুশিখুশি গলায় বলে, ‘আরে সীতুকুমার যে! কোথায় ছিলে এতদিন। আমি তো প্রায় অফিস যাই। রোস্টার ডিউটি চলছে। তোমাকে দেখি না তো।’
সীতুকুমারের একটা পরিচয় আছে। শীতকালে সে যাত্রা দলের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘোরে। বাঁশি বাজায়। পার্টও করে নাকি। বাঁশি ওর সঙ্গে সব সময় থাকে। কেউ একটু শুনতে চাইলে, প্রথমটা লজ্জা লজ্জা করলেও শুনিয়ে দেয়। তবে বনগাঁ লোকালের যে মৌমাছির চাকের মতো বিজবিজে ভিড় কে আর বাঁশি শুনতে চাইবে! তবু রাতের দিকে কামরা একটু ফাঁকা থাকলে কেউ কেউ বলে, সীতু একটু শোনা না। সীতু শোনায়। তখন সেই শিয়ালদা থেকে ঝগড়া করতে করতে আসা কমবয়সি বউটাও কেমন বাধ্য বালিকার মতো চুপ করে যায়। ফণা গুটিয়ে নিয়ে নিজেই ঝাঁপির মধ্যে ঢুকে যায়। সীতুকুমার ট্রেনে শশা, পেয়ারা বেচে। আর বাকি সময়টা যাত্রার দল। পুরো নাম নাকি সীতাপতি সর্দার। এটা নাকি যাত্রা দলের অধিকারী মশাইয়ের দেওয়া। একদিন কে যেন জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তা বাপ সীতুকুমার তোর আসল মানে বাপ-মায়ের দেওয়া নামটা কী বল একটু শুনি।’
মাথা নেড়ে বলে, ‘শুনি কাজ নাই। উটি নামটা ভালো নয়।’
আর এই কথায় সবার কৌতূহল বেড়ে যায়। চেপে ধরে। ‘বল, বল সীতু।’
সীতুকুমার মুখ নিচু করে সলাজ হেসে বলেছিল, ‘ধনপতি।’
সমস্ত কামরা হাসিতে ফেটে পড়ে।
সীতুকুমার কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, ‘জানতাম তুমরা হাসপে। তাই বলতি চাইনি।’
সেদিন রাইও ছিল ওই কামরায়। রাই সীতুর মনের চোরা দুঃখে জোনাকি জ্বালার মতো বলে ওঠে, ‘তুমি কান দিও না সীতু। একটু বাঁশি শোনাও দেখি। আর আমাকে পাঁচশো শশা দাও।’
মন কেমন করা বাঁশি শুনিয়েছিল সেদিন সীতু। সমস্ত কামরা থমথমে হয়ে যায়।
আজ অনেকদিন পর সীতুকুমারকে দেখে সে সব মনে পড়ে যায়। রাই দেখে সীতুর হাতে শশা বা পেয়ারার ঝাঁকার বদলে একটা লম্বা লাঠির সঙ্গে আড়াআড়ি করে কতগুলো লাঠি বাঁধা আর তাতে দড়ি, সেপ্টিপিন দিয়ে মাস্ক ঝোলানো। রাই সেদিকে তাকালে সীতু নিজেই বলে, ‘এখন তো বাইরে আর কেউ কিছু খায় না। কিন্তু পেট তো চালাতে হবে। গতবছর যাত্রাও হয়নি। তাই মাস্ক বিক্রি করছি।’
অনলাইনে একগাদা ডিস্পোজাল মাস্ক কেনা আছে রাইয়ের ঘরে। মাস্ক কেনার কোনও দরকার নেই। তবু মন চায় সীতুকুমারকে কিছু সাহায্য করতে। গেটের উল্টোদিকে শুধু কমবয়সি একটা মেয়ে ছিল। সে শিয়ালদা থেকে পুরো সময়ই মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত ছিল। গোবরডাঙা আসতে নেমে গেল।
রাই বলে, ‘সীতু একটু বাঁশি শোনাও। কত দিন শুনিনি।’
সীতু বেশ খুশি মনেই কাঁধের ঝোলা ব্যাগটা থেকে বাঁশি বের করে বাজায়। সুরটা রাই চেনে না। কিন্তু বাঁশি তো বাঁশিই। বড় করুণ এর ধুন। মন কেমন করে। শেষ করে সীতু হাসিমুখে তাকায় রাইয়ের দিকে।
রাই বলে, ‘মনটা ভরে গেল গো সীতুকুমার।’
ব্যাগ থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে দিতে গেলে সীতু বলে, ‘এমা রাই দিদি তুমি কি কোনওদিন দেখেছো বাঁশি শুনিয়ে কারও কাছ থেকে টাকা নিয়েছি!’
রাই বুঝতে পারে, ভুল হয়ে গিয়েছে তার। একজন শিল্পীর ভেতরকার অহং-এ ঘা দিয়ে ফেলেছে সে। তাড়াতাড়ি বলে, ‘তাহলে দুটো মাস্ক দাও দেখি।’
চাঁদপাড়া এলে, ‘আসি গো রাই দিদি’ বলে নেমে যায় সীতু। নেমে গিয়েও ছুটে আসে জানলার কাছে। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। সীতু হাওয়ার গতিবেগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিৎকার করে বলে, ‘রাই দিদি, ট্রেনে যে শিবুদা, গঙ্গাদি ছিল না, গান গাইতো। শিবুদা করোনায় একমাস হল মরে গিয়েছে।’
ট্রেন স্পিড নিয়ে নেওয়ায় সীতুর আর কোনও কথা রাই শুনতে পায় না, আর রাইও কী যেন বলতে যাচ্ছিল আর বলা হয় না।
হাতে ধরে থাকা মাস্ক দুটো ব্যাগের ভেতর ভরে নেয় রাই। হাতে একটু স্যানিটাইজার দেয়। সেদিন ফেসবুকে একটা মিমস দেখছিল, ঠাকুরঘরে গঙ্গাজলের বোতলে স্যানিটাইজার রাখা। সিটে একটু হেলান দেয় রাই। চোখটা বন্ধ করে। স্বপ্নটার কথা মনে হয়। সারি দিয়ে চিতা জ্বলছে। চিতার লকলকে আগুন। সব কোভিডে আক্রান্তদের শরীর। আর তখনই ট্রেনটা সিগ্যনাল না পেয়ে থেমে যেতে একটা ঝাঁকুনিতে চোখ খোলে রাই। পুরো কামরাটায় সে এখন একা। জীবনের প্রথম অবিশ্বাস্য ঘটনা। খাঁ খাঁ করছে যেন। সীতুর কথাটা মনে পড়ে। কী যেন বলছিল সে, শিবু গঙ্গা মানে সেই অন্ধ স্বামী-স্ত্রী। মাইক্রোফোন দিয়ে গান গেয়ে ট্রেনে ভিক্ষা করত। ওদের তো একটা মেয়েও আছে শুনেছিল। বনগাঁ গার্লস স্কুলে পড়ে। নতুন ক্লাসে উঠলে গতবার রাই একটা বই কেনার দামও দিয়েছিল। অনেকেই দেয়। ইসস স্বামীটা মারা গেলে বউটা একা একা কী করে সব সামলাবে! একে তো অন্ধ মানুষ। মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়।
বনগাঁ অন্তিম স্টেশন বলে নামার কোনও তাড়াহুড়ো নেই। ধীরেসুস্থে নামে রাই। নাকের উপর মাস্কটা একটু টেনে নেয়। সামনের সপ্তাহ থেকে আবার নাকি লকডাউন হবে শোনা যাচ্ছে। লকডাউনে দিন আনি দিন খাই মানুষগুলোর দুরবস্থার শেষ থাকে না। ট্রেন বন্ধ মানে সীতুদের মতো মানুষদের রুটিরুজিও বন্ধ। কবে যে সব ঠিক হবে কে জানে। অনেকে বলে, এ নাকি প্রকৃতিকে নিয়ে খেলা করার প্রতিশোধ নিচ্ছে সে। রাই মনে মনে বলে, ‘না অনেক হয়েছে আর নিও না প্রতিশোধ।’
স্টেশন থেকে বের হওয়ার সময় হঠাৎ একটা গানের সুর কানে আসে। গানটা কিশোরকুমারের জনপ্রিয় গান। ‘চলতে চলতে মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ রাখ না কভি আলবিদা না কহে না...’ বেশ কমবয়সি মেয়ের গলা। ভালো সুরেই গাইছে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে দেখে গঙ্গা। আর বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না কমবয়সি মেয়েটা তারই মেয়ে। রাই দাঁড়িয়ে পড়ে।
গান শেষ হলে জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি গাইছ তোমার মা এখন আর গায় না?’
মেয়েটি মাথা নাড়ে। বলে, ‘বাবা মরে যাওয়ার পর থেকে মা আর গান গায় না। আর আমারও তো স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছে তাই আমিই গাই।’
রাই একটু চুপ করে যায়। তারপর বলে, ‘বন্ধ মানে! অনলাইন ক্লাস তো হচ্ছে।’
মেয়েটা হাসলে বাঁ গালে টোল পড়ে। সেই টোল ফেলে হেসে বলে, ‘আমাদের তো স্মার্টফোন নেই দিদি। একটা কাকু বলেছে আমার গানের গলা খুব ভালো। কলকাতায় ভালো জায়গায় গান গাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। তখন ওই ফোন কিনব। ক্লাস করব।’
রাই জবুথবু হয়ে বসে থাকা গঙ্গার দিকে ভালো করে তাকায়। মনে হয় ভাগ্যিস গঙ্গা চোখে দেখে না। তাহলে রাইকে হয়তো চিনতে পারত। জিজ্ঞাসা করত, রাইদিদি মেয়েটাকে ওই কাকুর সঙ্গে কলকাতায় গান গাইতে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে?
ব্যাগ থেকে একশো টাকার একটা নোট ওদের সামনে রাখা পাত্রটায় রেখে হনহন করে হাঁটতে শুরু করে রাই।
অঙ্কন : সুব্রত মাজী