ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
সুতীর্থ কিছুটা বিস্মিত— ‘আশ্চর্য তুমি, হানিমুনে তাজমহল দেখার ইচ্ছে নেই। আমার সব সহপাঠীরা তো এই প্রস্তাবের জন্য তাদের স্বামীদের কাছে কৃতজ্ঞ এবং দারুণ খুশি হতো। অথচ তুমি সাহিত্যের ছাত্রী!’
‘সাহিত্যের ছাত্রী বলেই ইতিহাসকে তো অবহেলা করতে পারি না। মুমতাজ শাহজাহানের অনেক মহিষীর একজন। সম্রাটের সন্তানের জন্ম দিতে দিতে অসুস্থ হয়ে তাঁর অকালমৃত্যু। এখানে প্রেম কোথায়?’
‘বেশ প্রেম নেই মানলাম শাহজাহানের সম্রাট ইগোটাই বড়। কিন্তু পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম আমাদেরই দেশে, আমরা দেখব না?’
প্রচুর তর্ক-বিতর্কের পর সুতীর্থের কথাতে সহমত হল মালশ্রী। স্বামীর এই প্রেমের আবদার মানতেই হল। যাত্রাপথও নবদম্পতির আনন্দেই কাটল। প্লেনে করে দিল্লি। সেখানে ভ্রমণ বিলাসের পর অবশেষে আগ্রায় আগমন।
স্বল্পক্ষণ বিশ্রামের পর তাজমহল দর্শনে যেতে হবে মালশ্রীকে যথাসময়ে রেডি থাকতে বলল সুতীর্থ।
‘মুমতাজ’—কে যেন কানের কাছে ফিসফিস করে ডেকে উঠল।
চমকে উঠল মালশ্রী। হঠাৎ এতদিন পরে এই ভুলে যাওয়া নামে কে ডাকছে তাকে? নাকি এ তার মনের ভুল। এ নাম ছিল যার মুখে সে তো বহুদিনের হারানো এক নাম। এখন কোথায়, কত দূরে! আনমনে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল।
মাসতুতো দাদা অভিজিতের বন্ধু প্রিয়কের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ের প্রথম পর্ব মনে এল। প্রথম দেখার মুগ্ধতা, বুদ্ধিদীপ্ত কথার আকর্ষণ, নবীন ডাক্তারের রোমান্টিক মানসে মন হারল মালশ্রী। তারপর ধীরে ধীরে দু’টি প্রাণের ভালোলাগার কুঁড়ি কবে যে ভালোবাসার ফুল হয়ে ফুটে উঠল সেইসব মধুস্মৃতি ছায়া ফেলল মনে। আশ্চর্য, এতদিন পর সেই স্মৃতি। সেই ভুলে থাকা প্রিয় নাম কেন মনে এল?
সুতীর্থর তাজমহল দর্শনের প্রস্তাবেই কি তার অনুষঙ্গে ‘মুমতাজ’ নাম মনে এল মালশ্রীর। তার বাড়ির ডাক নাম মমতার সঙ্গে অতিরিক্ত আদর জুড়ে ‘মুমতাজ’ নামকরণ প্রিয়কের অবদান। স্মৃতি যে কোথায় কোন আড়ালে গভীর গোপনে লুকিয়ে থাকে!
আগ্রার বিলাসবহুল হোটেলের ঘরে দিবানিদ্রা মগ্ন স্বামী সুতীর্থের পাশে বিছানায় অস্থির মালশ্রীর ঘুম এল না।
একদিন যে কথা দেওয়া ছিল একজনকে, আজ এসেছে সেই শপথ ভাঙার দিন। বহু চেষ্টা করেও তাকে রোধ করা গেল না। আসলে দু’জনে তাজমহল দেখার স্বপ্ন ও সাধ ছিল মালশ্রী আর প্রিয়কের দীর্ঘদিনের লালিত ইচ্ছা। কোনও এক অলস মধ্যাহ্নে ছায়াঘন তরুতলে বসে হাতে হাত রেখে তারা প্রতিজ্ঞা করেছিল দু’জনে একসঙ্গে প্রথম দেখবে তাজমহল কোজাগরী পূর্ণিমার মায়াময় সন্ধ্যায়। সেই ইচ্ছে কোথায় হারাল পথ?
ডাক্তারির উচ্চতর ডিগ্রি নিতে বিদেশে গিয়ে নির্ধারিত সময় পেরিয়েও ফিরল না প্রিয়ক। অতন্দ্র দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর জানা গেল এক রোগীর ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর দায়ে দীর্ঘদিন শাস্তি ভোগ করতে হয়েছিল লন্ডন প্রবাসী প্রিয়ককে।
অপেক্ষার ক্লান্ত আশাহত প্রহর পেরিয়ে সাত বছরের প্রতীক্ষা শেষে মালশ্রীর বিয়ে হল যোগ্য পাত্র সুতীর্থর সঙ্গে। কী আশ্চর্য সমাপতন। সুতীর্থও ডাক্তার। তবে মালশ্রী আগেই জেনে আশ্বস্ত হয়েছে যে দু’জনের কলেজ ছিল আলাদা। প্রিয়ক কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের উজ্জ্বল ছাত্র আর সুতীর্থ জলপাইগুড়ি কলেজের। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বিয়েতে মত দিতে বাধ্য হয়েছিল মালশ্রী। জেনে নিশ্চিন্ত হয়েছিল সুতীর্থর কোনও বিলিতি ডিগ্রি নেই।
কালের প্রবাহে প্রিয়ক এক ভুলে যাওয়া ক্ষণিকের অতিথির নাম হয়ে বেঁচে রইল মনের গভীরে। একসঙ্গে তাজমহল দেখার রোমান্টিক বাসনা থেকেই ‘মুমতাজ’ নামে ডাকা। ডাক্তার প্রিয়ক আবৃত্তি করত ভালো। ওর কণ্ঠে শোনা রবীন্দ্রনাথের ‘শাজাহান’ কবিতা যেন অশ্রুত শ্রবণে দোলা দিয়ে গেল এতদিন পরে। তাকে বাদ দিয়ে তাজমহল দেখতে যাওয়ার অনুতাপে বিদ্ধ হৃদয় মালশ্রীর মনে মেঘ জমল। যা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ল চোখের জলে। ভোলা ভালো ছিল। তবু ভোলা গেল না এখনও। আর প্রিয়কের সঙ্গে তাজমহল দেখা হল না বলেই— সেই ইচ্ছেটার মৃত্যু ঘটল। তাই সুতীর্থর তাজমহল দেখার প্রস্তাবকে নানাভাবে বাধা দিয়েছিল। মালশ্রী নিজের মনের কাছে কথা দিয়েছিল কোনওদিন তাজমহল দেখবে না। ‘মুমতাজ’ ডাকটার মতো ‘তাজমহল’-ও তার কাছে হোক বিস্মৃত। বহুদিন লালিত স্বপ্ন যখন ভেঙে গেল, প্রতিশ্রুতি যখন বিস্মৃতির অতলে তখন সেই ইচ্ছেরও মূল্য রইল না। তাজমহলের রোমান্টিক ভাবনা তখন ইতিহাসের নীরস তথ্য হয়ে জেগে রইল মনে, তাই সুতীর্থের সঙ্গে ইচ্ছাকৃত তর্ক।
তবে শেষ পর্যন্ত রাজি হতেই হল। কী হবে হারানো অতীত মনে করে। ‘মুমতাজ’ নামটা আজ বিস্তৃত এক অধ্যায়— এক বিষামৃত অনুভব। সুতীর্থ তাকে ডাকে ‘মালা’ বলে, স্বামীর আদরের ডাকে ‘মুমতাজ’ নামের মাধুরী কবে যে হারিয়ে গেল। কিন্তু আজ কেন স্মৃতি তরঙ্গে ভেসে এল?
তাজমহলের গেট থেকেই প্রবল ভিড়। জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার, পূর্ণিমার জ্যোৎস্নালোকে তাজমহল দেখার জন্য রোমান্টিক বাসনা ব্যাকুল বাঙালি ভ্রমণকারীদের বিশাল ভিড়।
স্ত্রীর হাত ধরে এগিয়ে চলল সুতীর্থ। দূর থেকে শ্বেতশুভ্র মর্মর সৌধের গম্বুজ চোখে পড়ল। ছায়া ম্লান অপরাহ্ণের শেষ আলোতে তাজমহল যেন অপার্থিব মায়াচ্ছন্ন এক স্মৃতিস্বাক্ষর।
মোবাইলে দু’জনের সেলফি তুলে সুতীর্থ তাকাল মালশ্রীর দিকে হাসি মুখে। স্বামীর খুশির হাসিতে হাসি মেলাল মালশ্রী। শেষ পর্যন্ত তাজমহল দেখতে আসা হল। শুধু মানুষটি অন্য, প্রতিশ্রুত নায়ক নয়।
সুতীর্থ নানা ভাবেভঙ্গিমায় ছবি তুলল মালশ্রীর। ওর তৃপ্ত হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে এক ধরনের অপরাধবোধ জাগল মালশ্রীর। স্বামীর রোমান্টিক আবেগ ও আবেশ জড়ানো মুহূর্তকে অস্বীকার করতে পারল না। এক সময় অজানিতে ও হাত ধরল সুতীর্থর। অপরাধবোধ না কৃতজ্ঞতা নিজেই জানে না। প্রিয়কের জন্য সাগ্রহ ব্যর্থ প্রতীক্ষার সাত বছর বাদে বিয়েতে মত দিয়েছিল মালশ্রী স্বেচ্ছায়। ধীরে ধীরে শুক্লা রাতে চাঁদের তরণী দেখা দিল গগণপ্রান্তে। তাজমহলের চত্বর লোকারণ্য। যেন জ্যোৎস্নার আনন্দ উৎসব। চেনা-অচেনা, দেখা-অদেখা নানা মানুষের ভিড়। বলাবাহুল্য বাঙালিই বেশি, রবীন্দ্রনাথের শাজাহান কবিতা কেউ কেউ উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করে চলেছে। জ্যোৎস্নার চন্দ্রালোকে জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার।
হঠাৎ সুতীর্থর উচ্চকণ্ঠে ফিরে তাকিয়েই স্তব্ধ হয়ে গেল মালশ্রী—
‘আরে! ডঃ রায়চৌধুরী। What a pleasant surprise আপনি।’
সুতীর্থর ডাকে সাড়া দিয়ে তাকানো মানুষটির দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ বিস্ময়ে বাক্যহারা মালশ্রী।
‘দেখো মালা, আমার পুরনো বন্ধু সিনিয়র কলিগ ডাঃ প্রিয়ক রায়চৌধুরী।’
দীর্ঘদেহী সুদর্শন মানুষটি একটু চমকালো বোধহয়।
‘ডাঃ গুপ্ত, আশ্চর্য কতদিন পরে দেখা।’
‘আলাপ করিয়ে দিই, মালশ্রী, আমার স্ত্রী। আর মালা এঁর সঙ্গে আমার বহুদিনের পুরনো পরিচয়। ইনি বিলেত যাবার আগে বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছিলাম কিছুদিন। কিছুদিনের বন্ধুত্ব, তবে ওঁর মতো ব্রিলিয়ান্ট ডক্টরকে তো ভোলা যায় না।— এতদিন কোনও খবর পাইনি। আজ অনেক বছর পরে দেখা। এখন কোথায় আছেন?’
‘আমি লন্ডন থেকে কিছুদিন আগে ফিরেছি। আসলে অনেকদিন ওখানেই ছিলাম।’
‘আপনিও আমারই মতো তাজমহলপ্রেমী। সস্ত্রীক এসেছেন নিশ্চয়ই, উনি কোথায়— আপনার মিসেস?’
‘উনি কল্পনায়’— মৃদু হেসে উত্তর এল। ‘সময় ও সুযোগ হয়নি, দেশে ফিরেই দাদা-বউদির সঙ্গে দিল্লি গিয়েছিলাম একটা কাজে। ওখান থেকে ওঁরা জোর করে আগ্রায় নিয়ে এলেন, উৎসাহটা বউদির। উনি আমাকেও তাজমহল দেখাতে নিয়ে এলেন জোর করে।’
‘আপনাকেও তাজমহল দেখার জন্য জোর করতে হল? আমার স্ত্রীর মতোই। ও তো কিছুতেই তাজমহল দেখতে চায়নি। ওর মতে মুমতাজ নাকি শাহজাহানের প্রেম নয়, নিষ্ঠুরতার সাক্ষী।’
উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠল সুতীর্থ। তারপর হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে কাকে দেখে এগিয়ে গেল— ‘আরে, মালা আমার মাসতুতো বোন তন্দ্রারা এসেছে। ওদের সঙ্গে অনেক দিন যোগাযোগ নেই ওরা থাকে গুরগাঁওয়ে। আমি একটু দেখা করে আসছি। তুমি ততক্ষণ ডাঃ রায়চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ করো। আমি একটু আসছি, ডাঃ রায়চৌধুরী, please don’t mind’ চকিতে ওপাশে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল সুতীর্থ।
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রিয়ক আর মালশ্রী। দু’জনেই স্তব্ধ। ভাষাহীন নীরবতা। কোন মন্ত্রবলে যেন ঘটল সময়ের অপসারণ।
‘মুমতাজ,’ যেন অনেক দূর থেকে ভেসে এল স্বপ্নিল কণ্ঠ।
‘শেষ পর্যন্ত তাজমহলেই দেখা হল,’ অস্ফুটে বলল মালশ্রী
‘পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় আমার মুমতাজকে নিয়ে প্রথম তাজমহল দেখব, এমন কথাই তো ছিল।’
বাঁধভাঙা চাঁদের হাসিতে তাজমহলের মর্মর সৌধের সামনে ওরা দু’জন দাঁড়িয়ে। মালশ্রীর কানে গুঞ্জরিত হল, মনেও-বহুদিন আগে শোনা প্রিয়কের কণ্ঠের উচ্চারণ—
‘ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া’
ওদের দু’জনের ভাষাহারা বিজন রোদনা যেন মধুর বেদনা হয়ে দেখা দিল।
বহুদিনের প্রতিশ্রুতি পূর্ণতা পেল, মনে হল মুমতাজের প্রতি শাহজাহানের প্রেম যেন—
‘কালের কপোলতলে
শুভ্র সমুজ্জ্বল
এক বিন্দু নয়নের জল।’
অলঙ্করণ : সোমনাথ পাল