ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
শারদ পূর্ণিমাকে আমরা বলি কোজাগরী পূর্ণিমা। কোজাগরী শব্দের উৎপত্তি ‘কো জাগতী’ কথাটি থেকে। অর্থাৎ কে জেগে আছ? লক্ষ্মীর আরাধনায় রাত্রি জাগরণই কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর বিশেষ আচার। ওই দিন মা লক্ষ্মী ঘুরে ঘুরে খোঁজ নেন কে জেগে আছে? যে জেগে অক্ষক্রীড়া করে মা লক্ষ্মী তাঁকে ধনসম্পদ দান করেন। এই হল কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর মিথ।
নিশীথে বরদা লক্ষ্মীঃ জাগরত্তীতিভাষিণী।
তস্মৈ বিত্তং প্রযচ্ছামি অক্ষৈঃ ক্রীড়াং করোতি যঃ।।
অনেকে বলেন অক্ষক্রীড়া জাগ্রত রাখে চেতনাকে। টানটান রাখে স্নায়ুকে। এই শরতেই শস্যক্ষেত্রে ধান পাকে। সোনার রং ধরে ধানের ডগায়। তাই ফসল পাহারা দেওয়ার জন্য সতেজ স্নায়ুতে রাত্রি জাগরণ নিমিত্ত অক্ষক্রীড়া এবং সেই ফাঁকে লক্ষ্মী দেবীর আশীর্বাদ চেয়ে নেওয়া - সংবৎসরে ভাঁড়ারে যেন টান না পড়ে মা! শস্যের সুফলন শ্রী, সমৃদ্ধি ও বিত্তের প্রতীক। লক্ষ্মী তাই শস্যেরও দেবী। মাঠের ফসল নষ্ট করে ইঁদুর, গোলাঘরে বাসা বেঁধে নষ্ট করে সঞ্চিত ধান। পেঁচার আহার্য ইঁদুর। ইঁদুরকে বিনাশ করে ফসল রক্ষা করে পেঁচা। তাই পেঁচা ‘মা লক্ষ্মীর’ বাহন।
বীজ বপন বা ফসল ঘরে তোলার আগে ও পরে ফসলের দেবীর আশীর্বাদ চেয়ে নিতে ব্রতপালন বাংলার ঘরে ঘরে বহুকাল ধরে প্রচলিত। আর্যদের আগমনের অনেক আগে থেকেই। সারা বছর বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ঋতুতে ব্রতপালন করত মেয়েরা। ভাদ্রে, আশ্বিনে, কার্তিকে, অঘ্রানে, পৌষে, ফাল্গুনে ও চৈত্রে। কিন্তু হৈমন্তিক ফসল ঘরে তোলার আগে আশ্বিনের পূর্ণিমার রাতে ব্রতপালনই ছিল এসবের মধ্যে সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ।
এখন দেখা যাক ব্রত কী? কোনও কিছু কামনা করে যে অনুষ্ঠান সমাজে চলে তাকেই বলে ব্রত। এই ব্রত পালনের উদ্দেশ্যেই অনার্য সংস্কৃতির গর্ভে ব্রতকথার জন্ম। এর মধ্যে রয়েছে মনের সমস্ত কামনা-বাসনাকে হৃদয়ের দুয়ার খুলে মাটির ভাষায় দেব-দেবীর কাছে নিবেদনের আকুতি।
নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন, ‘... আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি যাহাদের বলিয়াছে ব্রাত্য বা পতিত তাহারা কি ব্রতধর্ম পালন করিতেন বলিয়াই ব্রাত্য বলিয়া অভিহিত হইয়াছেন এবং সেইজন্যেই কি আর্যরা তাহাদের পতিত বলিয়া গণ্য করিতেন? বোধহয় তাহাই।’
পুরাণের লক্ষ্মীদেবী আদিতে অপরিচিতা ছিলেন বাংলার অনার্য নারীকুলের কাছে। তারা পুজো করত বিমূর্ত এক শস্যের দেবীকে। তাদের মানস কল্পনায় এই দেবীর জন্ম। তিনি কখনও মঙ্গলঘট হিসেবে, কখনও চেলিতে মোড়া ঝাঁপি হিসেবে, কখনও কলা গাছ হিসেবে, কখনও বা মাটির সরা হিসেবে স্থান পেতেন পূজা বেদীতে। পরবর্তীকালে লৌকিক আরও অনেক ব্রতানুষ্ঠানের মতো এই শস্যদেবীর ব্রতও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুমোদন লাভ করে। যে ব্রতানুষ্ঠান একসময় ঘরে ঘরে মেয়ে-বউয়েরা নিজেরাই পালন করত, সেই অনুষ্ঠানে মন্ত্রোচ্চারণের জন্য পুরোহিতের অনুপ্রবেশ ঘটে। বৈদিক প্রভাব ঢুকে পড়ে পূজার আচার ও রীতিতে। এইভাবে কালের যাত্রাপথে পুরাণের লক্ষ্মীদেবী সমাপতিত হলেন অনার্যদের শস্যদেবীর উপরে। অনার্যদের বিমূর্ত দেবী পৌরাণিক লক্ষ্মী রূপে মূর্ত হয়ে উঠলেন। ভালো ফসলের কামনায় ঘরে ঘরে পালিত ব্রতোৎসবের নাম হয়ে গেল লক্ষ্মীব্রত।
এ প্রসঙ্গে নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন, ‘...তৎসত্ত্বেও কৌম সমাজের ঘটলক্ষ্মীর বা শস্যলক্ষ্মীর বা আদিমতম পূজা বা কল্পনা, তাহা বিলুপ্ত হয় নাই। বাঙালি হিন্দুর ঘরে ঘরে নারী সমাজের সে পূজা আজও অব্যাহত। আর শারদীয়া পূর্ণিমাতে কোজাগরী লক্ষ্মীর যে পূজা অনুষ্ঠিত হয়, তাহা আদিতে এই কৌম সমাজের পূজা বলিলে অন্যায় হয় না। বস্তুত দ্বাদশ শতক পর্যন্ত শারদীয়া কোজাগরী উৎসবের সঙ্গে লক্ষ্মীদেবীর পূজার কোনও সম্পর্কই ছিল না।’
আর্যদের শাস্ত্রীয় রীতি ও অনার্যদের লোকাচারের মিশেল আজকের কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর আচার ও পদ্ধতি। একদিকে বৈদিক শাস্ত্র, আরেক দিকে আবহমান কাল ধরে চলে আসা লৌকিক বিশ্বাস– এ দুয়ের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে পূজার আচার ও অনুষ্ঠান বিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপটি পেয়েছে। চালের গুঁড়ো জলে গুলে তর্জনীর ডগা দিয়ে আঁকা ধানের ছড়া, ধানের গোলা, লক্ষ্মীর পদচিহ্ন, কলাগাছের খোল দিয়ে নৌকো তৈরি করা, ঘটের উপর বসানো আম্রপল্লব, লক্ষ্মীর ঝাঁপি, কলাবউ- এসব সুপ্রাচীন কাল থেকে চলে আসা অনার্য লোকাচারের স্বাক্ষর আজও বহন করে চলেছে।
লৌকিক বিশ্বাস, পারিবারিক ঐতিহ্য ও দেশাচার ভেদে নানা রূপে কল্পিত হন মা লক্ষ্মী। কোথাও তিনি মূর্ত, কোথাও তিনি বিমূর্ত। কেউ পুজো করেন মাটির প্রতিমা গড়ে। কোথাও আবার ধান ভর্তি বেতের চুপরির উপর বসানো লাল চেলিতে মোড়া দুটি কাঠের সিঁদুর কৌটো মা লক্ষ্মীর প্রতীক হিসেবে পূজিত হয়। একে বলে আড়ি লক্ষ্মী। কেউ বা আবার শিষযুক্ত নারকেলকে চেলি দিয়ে ঢেকে লক্ষ্মী রূপে কল্পনা করেন। কোথাও লক্ষ্মীর মুখ আঁকা পোড়ামাটির ঘটে চাল অথবা জল ভরে সেটিকে দেবী হিসেবে পুজো করা হয়। মা লক্ষ্মীর আর একটি বহুল প্রচলিত রূপ হল লক্ষ্মীসরা।
সরা হল মাটির তৈরি একধরনের গোলাকৃতি পাত্র বা ঢাকনা। সরার উপরিতলে যে ছবি আঁকা হয়, তাকে বলে সরাচিত্র। সরাচিত্রে স্থান পান কখনও মা লক্ষ্মী একা, কখনও লক্ষ্মী-নারায়ণ যুগলে, কখনও দুই সখী জয়া ও বিজয়া সহ মা লক্ষ্মী, কখনও রাধা-কৃষ্ণের সঙ্গে মা লক্ষ্মী আবার কখনও মা দুর্গার গোটা পরিবার। সরাচিত্রের মাধ্যমে লক্ষ্মীপুজো পূর্ববঙ্গীয় রীতি। বর্তমানে দুই বাংলাতেই বহু গৃহস্থ বাড়িতে কোজাগরী পূর্ণিমায় এই রীতিতে লক্ষ্মীপুজো হয়। অঙ্কনশৈলী ও গড়ন ভেদে লক্ষ্মীসরা এককালে ছিল নানারকমের— ঢাকাই সরা, ফরিদপুরী সরা, সুরেশ্বরী সরা, গণকা সরা, রিলিফের সরা ইত্যাদি।
ঢাকায় উৎপত্তি। তাই নাম ঢাকাই সরা। পরে ঢাকার ভৌগোলিক গণ্ডি ছাড়িয়ে এই ধারার নির্মাণশৈলী নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। ঢাকাই সরার চারপাশ কানা উঁচু। পরিধি বরাবর থাকে উজ্জ্বল লাল রঙের বন্ধনী। এই বন্ধনীর ভিতর দিকে উপরের অর্ধাংশ বরাবর থাকে সরু কালো একটি রেখা। ব্যাকগ্রাউন্ডে সাদা রং। এই সরার দু’টি তল বা প্যানেল। উপরের প্যানেল চারটি খোপে বিভক্ত। মাঝের দু’টিতে থাকেন লক্ষ্মী ও নারায়ণ। দু’পাশের দু’টি খোপে থাকে দু’টি প্রস্ফুটিত লাল পদ্ম। নীচের প্যানেলে হলুদ ও কালো রঙে আঁকা ময়ূরপঙ্খির উপরে দাঁড়িয়ে থাকেন মা লক্ষ্মী। লক্ষ্মীর মুখ সামনের দিকে। দেবীর দুই হাতে থাকে ধানের শিষ। লক্ষ্মীর দু’পাশে থাকেন দুই সখী - জয়া ও বিজয়া। ঢাকাই সরায় পেঁচা নেই। ময়ূরপঙ্খি মা লক্ষ্মীর বাহন। ময়ূরপঙ্খি ভাসিয়ে বাণিজ্যে যেতেন সওদাগরেরা। একদা নৌবাণিজ্যে সমৃদ্ধ ঢাকার স্মৃতি যেন বহন করছেন ময়ূরপঙ্খিতে ভেসে চলা লক্ষ্মীদেবী।
ফরিদপুরী সরার উৎপত্তি বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায়। অলঙ্করণ শৈলীর দিক থেকে বিচার করলে এই সরায় সাধারণত তিনটি প্যানেল বা তল থাকে। তল তিনটি অনুভূমিক। মাঝের প্যানেলের মাঝখানে অর্থাৎ সরার কেন্দ্রে থাকেন লক্ষ্মী। তার দু’পাশে দুই সখী জয়া ও বিজয়া। উপরের প্যানেলের মাঝে থাকেন লক্ষ্মী-নারায়ণ। তাঁদের দু’পাশে থাকে কুঁড়িসহ পদ্মলতা। নীচের প্যানেলের মাঝে পেঁচা ও তার দু’পাশে দুটি ময়ূর। সরার পরিধিরেখা মোটা, লাল রঙে আঁকা হয়। মাঝের প্যানেলে আঁকা লক্ষ্মীদেবীর দু’হাতে থাকে ধানের শিষ ও গাছকৌটো। লক্ষ্মী এখানে পদ্মাসনা। দেবীর মুখ থাকে সামনের দিকে। সখীদের মুখ থাকে প্রোফাইলে। সরায় মূলত লাল, সবুজ, হলদে ও নীল রঙের প্রয়োগ দেখা যায়। এখানেও ব্যাকগ্রাউন্ড সাদা। সরার অলঙ্করণে বাহুল্য নেই। রেখার বিন্যাসে থাকে সংযমের পরিচয়। অঙ্কন রীতি খুবই সহজ ও সরল।
বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার সুরেশ্বর গ্রামে উৎপত্তি— তাই নাম হয়েছে সুরেশ্বরী সরা। এই সরার পরিধি বরাবর থাকে লাল ও সবুজ রঙের বন্ধনী। লাল বন্ধনীর ভিতরে থাকে সরু কালো রেখার আর একটি বন্ধনী। ফরিদপুরী সরায় তল বিভাজন অনুভূমিক কিন্তু সুরেশ্বরী সরার তল বিভাজন লম্বালম্বি। মাঝের প্যানেল ভরাট হয়ে থাকে সাত পুতুলে। সাত পুতুল মানে হল মা দুর্গার গোটা পরিবার ও অসুর। সিংহবাহিনী দুর্গা অসুর বধে রত। দুর্গার বাঁদিকে থাকে কার্তিক ও সরস্বতী। ডানদিকে থাকে লক্ষ্মী ও গণেশ। নীচে থাকেন মা লক্ষ্মী। সরাচিত্রে দুর্গার প্রাধান্য থাকলেও একে লক্ষ্মীসরাই বলা হয়। সরার উপরে থাকেন শিব। তাঁর দু’পাশে পদ্মলতা। সুরেশ্বরী সরার কম্পোজিশন খুব জমজমাট কিন্তু কখনওই ঘিঞ্জি বলে মনে হয় না। প্রতিটি এলিমেন্টই খুব স্পষ্ট। যা কিনা শিল্পীর মুন্সিয়ানার পরিচায়ক। চিত্রের রেখাগুলি খুব সূক্ষ্ম। দুর্গার পিছনে চালচিত্রের মতো চালা আঁকা হয়। মাঝের প্যানেলের কার্তিক-সরস্বতী, লক্ষ্মী-গণেশের পিছনেও থাকে চালা। চালার রং নীল।
গণকা সরা উজ্জ্বল লাল রঙের ব্যাকগ্রাউন্ডে আঁকা হয়। এই সরার নাম গণকা হওয়ার কারণ আচার্য ব্রাহ্মণ বা গণকরা এই সরা আঁকতেন। এই ধরনের সরা একসময় রাজপরিবারে বা জমিদার বাড়িতে পুজোয় ব্যবহার করা হতো। দুর্গাপুজোর পর তুলে রাখা হতো এই সরা। পরে ওই একই সরা ব্যবহার করা হতো লক্ষ্মীপুজোয়। এই সরার পরিধি বরাবর থাকে কালো ও লাল রঙের বন্ধনী। অঙ্কনশৈলীর বৈচিত্র্য অনুযায়ী এই সরা কখনও তিনটি তলে আবার কখনও দু’টি তলে বিভক্ত। দেবীর কাপড়ের রং কখনও সবুজ, কখনও কালো, কখনও নীল। পূর্ববঙ্গে গণকা সরায় চালচিত্র থাকে। এপার বাংলায় চালচিত্র দেখা যায় না। একেবারে উপরের দিকে থাকেন শিব আর নীচে থাকেন লক্ষ্মী। গণকা সরার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল দেবতাদের গায়ের অলঙ্কার সাদা রঙে আঁকা হয়।
রিলিফের সরায় ঢাকাই সরার মতো পরিধি বরাবর উঁচু বেড় বা কানা থাকে। কাঁচা সরার উপর পাতলা মাটির আস্তরণ দিয়ে দেব-দেবীদের ফুটিয়ে তোলা হয়। রিলিফের সরা দেখে মনে হয় সরা থেকে দেবদেবী যেন মূর্ত হয়ে উঠে আসছেন। রিলিফের সরার ব্যাকগ্রাউন্ড হয় আকাশি রঙের। ফাঁকা স্থান ভরাট করা হয় আলপনা দিয়ে।
উপরে যে সরা বৈচিত্র্যের কথা বলা হল, তা এখন প্রায় অতীত ইতিহাস বললেই চলে। তবে পুরোপুরি লুপ্ত হয়ে গিয়েছে বলা যায় না। সারা পশ্চিমবঙ্গ খুঁজে দেখলে হয়তো হাতেগোনা সামান্য কয়েকজন প্রবীণ শিল্পীকে পাওয়া যাবে যাঁরা সাবেকি ঢাকাই সরা, ফরিদপুরী সরা, সুরেশ্বরী সরা আঁকার কলাকৌশল জানেন। বর্তমানে যে সরাচিত্র সচরাচর আমরা দেখতে পাই তাতে ঢাকাই ও ফরিদপুরী সরার আঙ্গিক মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়ে এক নতুন শৈলীর জন্ম হয়েছে। রেখাঙ্কনে এসেছে পটচিত্রের আদল। এখন এই বাংলায় যারা সরাচিত্র আঁকেন, তাঁরা প্রায় সকলেই দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে এদেশে এসেছেন। তাহেরপুর, ফুলিয়া, চাকদা, নৈহাটি, পানিহাটি, দত্তপুকুর প্রভৃতি নানা জায়গায় বসতি স্থাপন করে ছড়িয়ে পড়েছেন।
‘আগে যেমনটা ছিল— সরা আঁকায় তেমন বৈচিত্র্য আর দেখা যায় না। ঢাকাই সরা, ফরিদপুরী সরা, সুরেশ্বরী সরা যেভাবে আঁকা হতো, তেমন আমরা আর আঁকতে পারি না। সেসব আমাদের বাপ-ঠাকুরদারা জানতেন,’ বলছিলেন নদীয়ার তাহেরপুরের ষাট ছুঁই ছুঁই সরাশিল্পী রতন পাল।
‘এখনও আমাদের এই তাহেরপুর থেকে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর সময়ে সাত-আট লক্ষ সরা বাজারে যায়। এখন আমরা সাত রকমের সরা বানাই। সারা বাংলাতে এখন এমনটাই পাবেন,’ এই বলে সাত রকমের সরা এনে হাজির করলেন রতনবাবু। দেখা গেল, দেবদেবী চরিত্রগুলি আঁকার স্টাইল সব সরায় একই রকমের। রকমফের কেবল দেবদেবীর উপস্থিতিতে ও রঙের ব্যবহারে।
শিল্পীদের ভাষায় এই সাত রকমের সরা হল, এক পুতুল (শুধু লক্ষ্মী), দুই পুতুল (লক্ষ্মী ও নারায়ণ), তিন পুতুল (লক্ষ্মী ও তাঁর দুই সখী জয়া ও বিজয়া) চার পুতুল (মাঝে রাধা ও কৃষ্ণ, তাদের দু’পাশে জয়া ও বিজয়া), পাঁচ পুতুল ( দু’পাশে ময়ূর এবং জয়া ও বিজয়াসহ লক্ষ্মী ), সাত পুতুল (মা দুর্গার গোটা পরিবার) ও গণকা সরা (সাত পুতুল সরার মতোই চিত্রণ শৈলী, তফাত শুধু ব্যাকগ্রাউন্ড এবং অসুরের গায়ের রঙে। সাত পুতুল সহ অন্যান্য সরায় ব্যাকগ্রাউন্ডের রং সাদা। গণকা সরায় ব্যাকগ্রাউন্ড লাল রঙের এবং অসুরের গায়ের রং সবুজ)। চার পুতুল, সাত পুতুল ও গণকা সরায় লক্ষ্মী থাকেন নীচের প্যানেলে। এছাড়া আরও একরকমের সরা আছে। গজলক্ষ্মী সরা। মা লক্ষ্মী এখানে গজগামিনী। রতনবাবু বলছিলেন, ‘এই সরার চল ততটা নেই, কেউ এসে স্পেশাল অর্ডার দিলে, তবেই এঁকে দিই।’
প্রশ্ন করা হল, ‘আগেকার ঢাকাই, ফরিদপুরী বা সুরেশ্বরী সরা কেউ এসে চায় না?’
রতনবাবুর জবাব, ‘মাঝে মাঝে বনেদি পরিবারের কিছু প্রবীণ লোক আসেন। তাঁরা এসে খোঁজ করেন।’
‘কী করেন তখন?’
‘ওঁরা পুরনো সরার ছবি দেখান। সেই মতো আঁকার চেষ্টা করি।’
তাহেরপুরের গৌরদাস পাল, গোবিন্দ পাল, স্বপন পালদের মতে, ‘এখনকার সরা চিত্রে রঙের ঔজ্জ্বল্য আগের থেকে অনেক বেশি। ক্রেতারা দেবদেবীর পোশাকের গাঢ় উজ্জ্বল রং পছন্দ করেন। আগে একসময় আমরা দেবদেবীর গায়ের গয়না আঁকতাম হলুদ রঙে। এখন সাদা রঙে আঁকি। গাঢ় রঙের পোশাকের ব্যাকগ্রাউন্ডে সাদা রং খুব ভালো ফুটে ওঠে।’
যাঁরা লক্ষ্মীর সরা আঁকেন, শুধু সরা এঁকে তাঁদের দিন চলে না। পরিশ্রমের তুলনায় উপযুক্ত পারিশ্রমিক এঁরা পান না। মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিলে বছরে নয় মাস লেগে থাকতে হয় সরা তৈরির কাজে। কিন্তু পয়সা যা পাওয়া যায়, তাতে সংসার চালানো কঠিন। তাই সরা আঁকার ফাঁকে অন্যান্য কাজে তাঁদের নিযুক্ত থাকতে হয়। কেউ বাজারে তরকারি বিক্রি করেন, কেউ মাছ বেচেন, কেউ মাটির শো-পিস গড়েন, কেউ আবার ছাঁচের প্রতিমা তৈরি করেন।
যুবক প্রসেনজিৎ পাল, দেবাশিস পালের কথায়, ‘শুধু সরা আঁকলে ডাল-ভাত খেয়ে থাকতে হবে, মাছ জুটবে না।’ তাই তাহেরপুরের পালপাড়ায় বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই আর এই জীবিকা আঁকড়ে থাকতে চান না।
মনে প্রশ্ন জাগে তাহলে এই শিল্পের ভবিষ্যৎ কী? মেলে না উত্তর।
বাঙালির জীবন থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে তার নিজস্বতা, সাবেকিয়ানা। লক্ষ্মীর আরাধনার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নেই। চালের গুঁড়ো জলে গুলে আঙুলের ডগা দিয়ে বাড়িজুড়ে আলপনা দেওয়ার রীতি উঠে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে আলপনার রকমারি নকশা। লক্ষ্মীপুজোর কয়েকদিন আগে থেকে বাড়িতে বাড়িতে পিতলের হাঁড়িতে যে নাড়ু তৈরির রেওয়াজ ছিল, নাকে ভেসে আসত গুড় আর নারকেলের সুগন্ধ তাও একরকম লুপ্ত হতে বসেছে। তবে সব কিছুরই রেডিমেড বিকল্প আছে। আজকাল তিলের নাড়ু, নারকেলের নাড়ু, খই মুড়কি প্যাকেটজাত হয়ে দোকান থেকে চলে আসছে বাড়িতে। লক্ষ্মীর পা আঁকা, ধানের ছড়া আঁকা ও আলপনা দেওয়ার ঝক্কি পোয়ানোর পরিবর্তে দোকান থেকে পছন্দসই স্টিকার কিনে এনে মাটিতে সেঁটে দিলেই কাজ সারা হয়ে যায়। এমনটা হওয়াই বোধহয় স্বাভাবিক। এখনকার ছোট ছোট পরিবারে খাটাখাটনি করার লোক কম। তাই প্যাকেটজাত নাড়ু, খইমুড়কি, আলপনার স্টিকার— এসব দিয়ে একরকমের মানিয়ে নেওয়া। কালের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা। কিন্তু সরা শিল্পীদের আধুনিক প্রজন্ম সত্যিই যদি অর্থনৈতিক কারণে পারিবারিক বৃত্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন কি সরার মসৃণ তলের উপরে সরাচিত্রের আদলে স্টিকার সেঁটে ম্যানেজ করে নিতে হবে আমাদের? জবাব দেবে মহাকাল।
সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায়