ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
ভারতের যুদ্ধজাহাজ আইএনএস বিক্রান্তকে খুঁজে বের করতে সেই ১৪ নভেম্বর করাচি থেকে রওনা হয়েছিল পিএনএস গাজি আরব আগরের বুকে। তারপর থেকে করাচি আর ঢাকার ন্যাভাল হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ থাকছে এই সাবমেরিনের। কিন্তু যখনই স্পাই এয়ারক্র্যাফট থেকে পাঠানো ছবিতে জানা গেল ভারতের আইএনএস বিক্রান্ত বম্বে হারবারে আছে, তখনই স্পিড বাড়িয়েছিল গাজি। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বিক্রান্ত ভ্যানিশ। পিএনএস গাজি এখন শ্রীলঙ্কার দিকে এগিয়েছে। ত্রিঙ্কোমালির কাছে। করাচি ন্যাভাল কন্ট্রোল তাদের ঢাকা ইউনিটকে বলল, তোমাদের কাছে কোনও সিগন্যাল ধরা পড়েছে? বিক্রান্তের লোকেশন কোথায়? ঢাকা জানে না।
ঠিক ২৪ ঘণ্টা পর হঠাৎ একটা একটা মেসেজ ডেসিফার করা যাচ্ছে। ঢাকার পাকিস্তানি নৌবাহিনীর গুপ্তচর বাহিনী রেডিও ট্রান্সমিটার ইন্টারসেপশনে শুনতে পেল একটা গোপন কোড মেসেজ। বলা হচ্ছে, ভাইজাগ পোর্ট, বয়লার মেনটেন্যান্স। চার্লি রেড। তার কিছু পরই আর একটা মেসেজ। মিল গয়া! লাফিয়ে উঠল করাচি আর ঢাকার পাকিস্তানি নৌসেনা। এত সহজে ইন্ডিয়া যে বিক্রান্তের লোকেশন বলে দেবে রেডিও ট্রান্সমিটারে একে অন্যকে, সেটা ভাবাই যায়নি। অবশ্য দ্বিতীয়টা সাধারণ মেসেজ নয়। একটা প্রাইভেট টেলিগ্রাম করা হয়েছে ইন্ডিয়ান জাহাজ থেকে। কোনও এক নাবিক দিল্লির সদর দপ্তরে জানাচ্ছে, মাদার সিরিয়াসলি ইল। সে খবর পাচ্ছে না। তাকে একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে জানানো হোক মায়ের অবস্থা কী? এই প্রাইভেট টেলিগ্রাম থেকেই পাকিস্তান নেভির কোডিং টেকনোলজিস্টরা বুঝে গেল বিক্রান্ত কোথায়। এই তো, বিক্রান্ত তাহলে আছে ভাইজাগ! বিশাখাপত্তনমে। এবার কাজটা সহজ হবে। পিএনএস গাজি আছে ত্রিঙ্কোমালিতে। জ্বালানি ভরাও হয়ে গিয়েছে। এবার কাজটা শুধু করতে হবে।
উত্তেজনায় ফুটছে পাকিস্তানের তিনটি লোকেশন। সমুদ্রে নিমজ্জিত গাজির ক্যাপ্টেন জাফর মহম্মদ খান, করাচির ন্যাভাল ওয়ারফেয়ারের ক্যাপ্টেন ভুমবাল এবং ঢাকায় বসে গোটা অভিযানের দিকে টানটান উত্তেজনায় চোখ রেখে বসে থাকা পাকিস্তান নৌবাহিনীর ইস্টার্ন ফ্লিট কমান্ডার মহম্মদ শরিফ।
মহম্মদ শরিফ গাজি সাবমেরিনকে মেসেজ দিয়ে বললেন, ক্যাপ্টেন তোমাকে স্পিড বাড়াতে হবে। এটা এক সুবর্ণ সুযোগ। যতক্ষণ বিশাখাপত্তনমে একা আছে বিক্রান্ত ততক্ষণ তোমার পক্ষে অ্যাটাক করা সহজ। কিন্তু একবার বিক্রান্ত মুভ করলে সঙ্গে থাকবে ডেসট্রয়ার, মাইনসউইপারস আর এসকর্ট ফ্রিগেট। তখন আর অ্যাটাক করা সহজ হবে না। বরং গাজির পক্ষে ঝুঁকি। তাই এখনই যা কিছু করা দরকার। ধ্বংস করে দাও ইন্ডিয়ার গৌরবকে।
কিন্তু পাকিস্তান জানতে পারছে না, এই কথোপকথন ভারতের সুপার কোড স্পেশালিস্ট মেজর ধরম দেব দত্ত সব শুনছেন। যাঁকে সকলে থ্রিডি নামেই ডাকে। থ্রিডি কিন্তু এইসব মেসেজ গ্রুন্ডিগ টেপ রেকর্ডারে রেকর্ড করে ইন্টারসেপ্ট করে ফেলেছেন। উত্তেজনায় ঘামছেন। প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। গাজি এগচ্ছে। বিক্রান্তের দিকে। বিক্রান্ত আছে বিশাখাপত্তনমে। সেটা পাকিস্তানও জেনে ফেলেছে। থ্রিডি অবাক হয়েছেন এবং ক্রুদ্ধও। কারণ, এত সহজে পাকিস্তান ভারতের নেভি মেসেজ ডিকোড করতে পারছে কীভাবে? কোন গর্দভের দল এভাবে সহজ সরল মেসেজ করছে যে, পাকিস্তান এত ইম্পর্ট্যান্ট ইনফরমেশন পর্যন্ত পেয়ে যাচ্ছে! এরকম চললে তো আগেই লড়াইয়ে হেরে যেতে হবে। থ্রিডি তাঁর ন্যাভাল আর্মি ইনটেলিজেন্স সিগন্যালিং সিস্টেমে জানিয়ে দিলেন— স্যার, বিক্রান্ত যে ভাইজাগে আছে, সেটা জেনে গিয়েছে পাকিস্তান। ইতিমধ্যেই গাজি সাবমেরিন বিক্রান্তকে ধ্বংস করতে অগ্রসর হয়েছে। আমাদের হাতে সময় নেই স্যার...ওভার! এই মেসেজ তিনবার রিপিট করলেন মেজর থ্রিডি। কিন্তু একি! কোনও রেসপন্স নেই কেন? কী হল? এরকম হওয়ার কথা নয়।
কমান্ডার জাফর স্থির করে ফেলেছেন তাঁর প্ল্যান। তিনি বিশাখাপত্তনমের বন্দরের বাইরে মাইন ছড়িয়ে দেবেন। বিক্রান্ত আজ নয় কাল ওই পথেই পাস করবে। সুতরাং একবার ওই রুটে ঢুকলেই একের পর এক বিস্ফোরণ হবে। বিক্রান্তকে আর কেউই বাঁচাতে পারবে না। কারণ, ইতিমধ্যেই জানা যাচ্ছে বিশাখাপত্তনম থেকে বিক্রান্ত গোপনে অগ্রসর হবে চট্টগ্রাম পোর্টের দিকে। চট্টগ্রাম বন্দর ধ্বংস করাই ভারতের লক্ষ্য। অর্থাৎ ভারত আজ নয় কাল যুদ্ধ শুরু করে দেওয়ার প্ল্যান করছে। সুতরাং তার আগেই আমাদের কাজ খতম করে ফেলতে হবে। ভাবলেন ক্যাপ্টেন জাফর। তবে বেশি অপেক্ষা করা যাবে না। একান্তই যদি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বিক্রান্ত বেরিয়ে না আসে, তাহলে টর্পেডো চার্জ করে ওই জাহাজ ডেসট্রয় করা হবে। এগচ্ছে পিএনএস গাজি।
....
সবটাই ফাঁদ। পাকিস্তান ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারল না যেসব মেসেজ কিংবা সাঙ্কেতিক কোডের উপর ভিত্তি করে তারা এই মেগা অপারেশন করার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, সেই প্রতিটি পদক্ষেপ ভারতীয় নৌবাহিনীর সম্মিলিত একটি ট্র্যাপেরই ফলাফল। ভারতীয় নৌসেনার সিগন্যালিং কন্ট্রোলের ইঞ্জিনিয়াররা ইচ্ছাকৃতভাবে এমন মেসেজ পাঠিয়েছে এবং সেগুলি ডিকোড করার মতো সহজ বার্তা দিয়েছে, যাতে পাকিস্তান মনে করে তারা সঙ্কেত ধরে ফেলেছে এবং সেইমতোই উল্লসিত হয়ে প্ল্যান রূপায়ণ করে বিক্রান্তকে অ্যাটাকের লক্ষ্যে। আইএনএস বিক্রান্ত আসলে বিশাখাপত্তনমেই নেই। পাকিস্তানকে বিভ্রান্ত করার জন্যই ভুল মেসেজ সিগন্যালিং করা হচ্ছিল। এমনকী লিকও করা হচ্ছিল ইচ্ছাকৃতভাবে।
যে ফ্রিকোয়েন্সি থেকে দুই স্পাই নিয়ম করে বম্বে এবং মাদ্রাজ বন্দর থেকে ঢাকায় গোপন সঙ্কেত পাঠাচ্ছিল, সেটা ভারতের নৌসেনা ধরে ফেলেছে আগেই। কিন্তু বুঝতে দেওয়া হয়নি। উদ্দেশ্য একটাই। তারা যেন সতর্ক না হয় এবং ফ্রিকোয়েন্সি চেঞ্জ না করে। এই প্ল্যান কাজে দিয়েছে। বিশাখাপত্তনমেই যে আছে বিক্রান্ত, এই সংবাদ দ্রুত পেয়ে গেল পাকিস্তান। যে কোনও বন্দরের সংলগ্ন বাজার এলাকায় ঘোরে গুপ্তচর। পাকিস্তানের গুপ্তচরও যে বিশাখাপত্তনম এবং মাদ্রাজের পোর্টের আশপাশে ঘুরছে এবং কোনও একটি হোটেলে কিংবা বাড়িতে থাকছে সেটা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
যেই পাকিস্তান জেনে গেল বিক্রান্ত কোথায় আছে, তৎক্ষণাৎ, আইএনএস বিক্রান্ত আবার চলতে শুরু করেছিল। প্রথমে মাদ্রাজ। ভারতের ইস্টার্ন ন্যাভাল কমান্ডের ফ্ল্যাগ অফিসার, কমান্ডার-ইন-চিফ ভাইস অ্যাডমিরাল এন কৃষ্ণাণের নেতৃত্বে প্ল্যান করা হয়েছিল আইএনএস বিক্রান্তকে মাদ্রাজ থেকে নিয়ে যাওয়া হবে সম্পূর্ণ অজানা লোকেশনে। এমনকী নৌবাহিনীর মধ্যেও কেউ জানবে না সেই জায়গার সঠিক নাম। তাই প্রতিটি ইন্টারনাল কমিউনিকেশনে বলা হয়েছে একটি কোড। ‘পোর্ট এক্স রে!’ অর্থাৎ মাদ্রাজ থেকে বিক্রান্ত চলে গিয়েছে পোর্ট এক্স রে নামক একটি স্থানে। বঙ্গোপসাগরের বুকে। কোথায় এই জায়গা? এই নামে কোনও বন্দর আছে নাকি? কোথায় এই পোর্ট এক্স রে?
চারদিকে ঘন অরণ্য। মাঝখানে সমুদ্রের একটি খাঁড়ি। জায়গাটা আন্দামানের কাছে। কিন্তু এই গোটা যাত্রাপথে বিক্রান্তকে একটাই ঝুঁকিবহুল কাজ করতে হচ্ছে। সেটি হল, কোনও সিগন্যাল অন থাকবে না। সব সিগন্যাল আর মেসেজিং ট্রান্সমিটার বন্ধ। কারণ, কোনওভাবেই যাতে এবার বিক্রান্তের আসল লোকেশন পাকিস্তান জানতে না পারে।
ভারতীয় উপমহাদেশ তো বটেই, বিশ্বজুড়ে নানাবিধ যুদ্ধ অথবা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এরকম এক টানটান সত্যিকারের থ্রিলারের মতো পরিস্থিতি খুবই বিরল। কেমন থ্রিলার? শত্রুরাষ্ট্রের ডেসট্রয়ার সাবমেরিন সমুদ্রের নীচে গোপনে খুঁজে বেড়াচ্ছে অন্য পক্ষের একটি বিরাট যুদ্ধজাহাজকে। সেই ১০ নভেম্বর থেকে চলছে এই দুই জাহাজের লুকোচুরি। কখনও আরব সাগর, কখনও বঙ্গোপসাগরে। পিএনএস গাজি বনাম আইএনএস বিক্রান্ত। রুদ্ধশ্বাস প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে দুই দেশের নৌসেনার মধ্যেই। শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হবে? কারা হাসবে শেষ হাসি?
....
বিশাখাপত্তনমের বাজার থেকে ভারতীয় নৌবাহিনীর কাছে হঠাৎ এত সব্জি, মাংস, চাল, আটা, ফল যাচ্ছে কেন? পাকিস্তানের গুপ্তচর বাহিনী সক্রিয় হয়ে উঠল। তারা এই বন্দরের আশপাশেই ঘুরছে। গন্ধ শুঁকছে গোপন খবর পাওয়ার জন্য। দুই দেশের মধ্যে যে প্রবল এক স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। যে কোনও সময় সেটার বিস্ফোরণ ঘটবে। অতএব এই সময় সবথেকে কার্যকরী ভূমিকা এই দুই দেশের গুপ্তচরদের। ভারত জানে সর্বত্র ছায়ার মতো রয়েছে পাকিস্তানি স্পাই। আবার ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম অথবা করাচি, লাহোরেও যে ভারতীয় গুপ্তচরেরা মিশে রয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যেই সেটা জানা আছে পাকিস্তানের। বিশাখাপত্তনমের বাজার থেকে বন্দরে থাকা ভারতীয় নৌসেনার কনটিনজেন্সি ক্যাম্পে এত বেশি বেশি খাদ্যপণ্য যাচ্ছে এটা বেশ ইন্টারেস্টিং। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান সক্রিয় এবং জানা গেল বন্দরের নৌকা করে সেই খাদ্যশস্যের ভাণ্ডার যাচ্ছে সমুদ্রের একটু গভীরে। অর্থাৎ কোনও একটি জায়গায় সাপ্লাই হচ্ছে। নিশ্চয় সেটা আইএনএস বিক্রান্ত। পাকিস্তান যাতে এরকম ভাবে, সেই কারণেই এই এত বেশি বাজার করা। ভারতীয় নেভির প্ল্যান!
কিন্তু পাকিস্তান তো গোপন একটি প্রাইভেট টেলিগ্রাম পেয়েছে। যেটা পাঠানো হয়েছে বিশাখাপত্তনম বন্দরের কাছেই থাকা একটি জাহাজ থেকে। কোনও এক নেভি অফিসার দিল্লিতে মায়ের অসুস্থতার খবর জানিয়ে ফিডব্যাক চাইছে। তাছাড়া হঠাৎ করেই এই রুটে সিগন্যালিং মেসেজ, আর ট্রান্সমিটার মেসেজ বেড়ে গিয়েছে অনেক। তখনই এরকম প্রচুর মেসেজ একটি বিশেষ লোকেশন থেকে জেনারেট করে, যখন কোনও একটি বৃহৎ জাহাজ অবস্থান করে। অর্থাৎ সবদিক থেকেই পাকিস্তান ১০০ শতাংশ নিশ্চিত হয়েছে যে, ভাইজাগেই আছে বিক্রান্ত। আর তাই তাদের প্ল্যান নিখুঁতভাবে অগ্রসর হচ্ছে। সেই মেসেজ কি মিথ্যা?
ঠিক এখানেই ভুল করছে পাকিস্তান। তুখোড় ফ্ল্যাগ অফিসার ভাইস অ্যাডমিরাল কৃষ্ণাণ আসলে সম্পূর্ণ অন্য একটি যুদ্ধজাহাজকে দায়িত্ব দিয়েছেন বিশাখাপত্তনমে চলে যেতে। আইএনএস বিক্রান্ত ঠিক যখন বেরিয়ে যাবে ভাইজাগ থেকে, তখনই সেখানে ঢুকে পড়তে হবে আর একটি যুদ্ধজাহাজকে। সেটির নাম আইএনএস রাজপুত। অর্থাৎ আইএনএস রাজপুতের আপাতত দায়িত্ব আইএনএস বিক্রান্তের ছদ্মবেশে থাকা। আইএনএস রাজপুত নিজেকে বিক্রান্ত হিসেবে সাজিয়ে নিল টেকনিক্যালি। একই রকম আকার। একইরকম রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি। একইরকম সিগন্যালিং মেসেজ পাঠাচ্ছে সে। ওরকমই মেসেজ পাচ্ছে পাকিস্তান ইন্টারসেপ্ট করে। ভাবছে বিক্রান্ত থেকে আসছে এসব মেসেজ! আসলে আসছে রাজপুত থেকে।
আর আইএনএস রাজপুতকে গত কয়েকদিন ধরে আইএনএস বিক্রান্ত ভেবে উল্লসিত হয়েছে পাকিস্তান। এই রাজপুতকে লক্ষ্য করেই সমুদ্রের অতলে সাবমেরিন পিএনএস গাজি এগিয়ে চলেছে। ক্যাপ্টেন জাফর ঠিক করেছেন ভাইজাগ পোর্টের দিকে তিনি অগ্রসর হয়ে একেবারে সামনে থেকে বিক্রান্তকে টর্পেডো দিয়ে ধ্বংস করবেন।
৩ ডিসেম্বর। ১৯৭১। আইএনএস রাজপুত বিশাখাপত্তনম পোর্ট থেকে হঠাৎ এগিয়ে চলেছে। কেন? কারণ ইতিমধ্যেই মৎস্যজীবীদের থেকে গোপন সংবাদ পাওয়া গিয়েছে যে, ভাইজাগের অদূরে সমুদ্রে ভেসে উঠেছে তেল। রহস্যজনক কিছু তোলপাড়। ভাইস অ্যাডমিরাল কৃষ্ণাণ এরকমই নির্দেশ দিয়েছিলেন ভাইজাগ ইউনিটকে। মৎস্যজীবীদের আগে থেকে সমুদ্রে নজরদারি করতে। কোনওরকম সন্দেহজনক পরিস্থিতি উপস্থিত হলে যেন তারা খবর দেয়। তারা সেইমতোই বন্দরে এসে খবর দিয়েছে। আর এই বার্তা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোঝা হয়ে যায় যে, এসে গিয়েছে পিএনএস গাজি। অতএব এবার সারপ্রাইজ দেওয়া দরকার। সেটাই ছিল গোপন পরিকল্পনা। তাই রাজপুতকে বলা হল, ইমিডিয়েটলি ভাইজাগ থেকে বেরিয়ে এসো। আর আমাদের এয়ারক্র্যাফট, ফ্লিট ডেস্ট্রয়ার রেডি থাকছে পাকিস্তানের সাবমেরিনকে কমব্যাট করতে। তবে রাজপুত যেন খালি হাতে না ফেরে। কিছু সন্দেহজনক গতিবিধি দেখতে পেলেই একটা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে। কী ব্যবস্থা? ডেপথ চার্জ!
৩ ডিসেম্বর। রাত গভীর হয়েছে। আইএনএস রাজপুত প্রায় অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে ভাইজাগ থেকে। হঠাৎ সে বুঝতে পারল অদূরে জলের মধ্যে একটা অস্বাভাবিক তরঙ্গ। সমুদ্র ঠিক ওই জায়গাটায় আচমকা একটু বেশি বেশি ফুঁসে উঠছে। কী ব্যাপার? ইন্দার সিং কমান্ডিং অফিসার। তিনি তৎক্ষণাৎ জানতে চাইলেন কন্ট্রোলে, কিছু অ্যাবনর্মাল সাবজেক্ট দেখতে পাচ্ছ? কন্ট্রোল রুমেও ধরা পড়েছে। তারা জানাল, ইয়েস। তাহলে কী...? হ্যাঁ এরকম হওয়ার অর্থ সামনে সাবমেরিন। কিন্তু সেটা কাদের? আমাদের নয় তো? ইন্দার সিং ভাবছেন। আবার মেসেজ দিচ্ছেন, আমাদের কোনও আন্ডারওয়াটার সাবজেক্ট লোকেশনে আছে? মেসেজের উত্তর এল, নেগেটিভ! ব্যস! আর সন্দেহ নেই। সামনের ওই সমুদ্রের নীচে নির্ঘাত গাজি। কিন্তু অনেকটাই উপরে উঠে না এলে সমুদ্রের জল এভাবে আন্দোলিত হতে পারে না। এতটা উপরে এসেছে কেন গাজি? কী ব্যাপার? অ্যাটাক করবে বলে? নাকি অন্য কারণ?
ইন্দার সিং ঠিক বুঝেছেন। পাকিস্তানের গাজি সাবমেরিনের মধ্যে আচমকা এয়ার প্রেশার টেকনিক্যাল ফল্ট যাচ্ছে। ততক্ষণে অনেক নাবিক অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কাশি হচ্ছে। ব্যাটারি চার্জ করে ফ্রেশ এয়ার আনতে অন্তত ৩ ঘণ্টা। তাই কিছুটা উপরে উঠে আসতে হয়েছে গাজিকে। ক্যাপ্টেন জাফর মহম্মদ খান আতঙ্কিত। এরকম তীরে এসে নিজেদের তরিই ডুববে যান্ত্রিক কারণে? আচমকা সেই আতঙ্ক বেড়ে গেল। কারণ, অদূরে একটি ইন্ডিয়ান ভেসেলের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। সেটি কি বিক্রান্ত? নাকি অন্য কিছু? ভাবার আর সময় পেলেন না বেশি। কারণ আইএনএস রাজপুত অন্য পথে বেরিয়ে যাওয়ার প্রাক মুহূর্তে দু’টি ডেপথ চার্জ ফেলে দিল সমুদ্রে। ডেপথ চার্জ হল অ্যান্টি সাবমেরিন বিস্ফোরক। কয়েক মিনিট পর রাজপুত দূর থেকেই শুনতে পেল বিস্ফোরণ। পিএনএস গাজিতে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ শুরু হয়েছে। ধ্বংস হচ্ছে পিএনএস গাজি।
সত্যিই আইএনএস রাজপুতই গাজিকে বিস্ফোরক দিয়ে ধ্বংস করেছে? এই তত্ত্ব পাকিস্তান আজও মানতে নারাজ। এখনও তাদের দাবি, টেকনিক্যাল কারণে নিজেদের অন্দরে থাকা মাইনস ফেটে গিয়েই গাজি ধ্বংস হয়েছে। সত্যিই কী হয়েছিল গাজির ভাগ্যে? আজও এক রহস্য! রহস্য সার্কুলার নিয়েও। ৩ তারিখে ধ্বংস হওয়া গাজির ধ্বংস হওয়ার অফিসিয়াল রেকর্ড ৯ ডিসেম্বর দেওয়া হয়েছিল। কেন? এই রহস্যগুলি থাকলেও, এটা ঠিক যে, ভারতের নৌসেনার গর্বকে ধ্বংস করতে এসে পিএনএস গাজি নিজেই খতম হয়ে গেল এক রহস্যময় সিচ্যুয়েশনে!
....
পিএনএস গাজিতে যখন বিস্ফোরণ হচ্ছে তার বেশ কয়েকঘণ্টা আগেই কলকাতায় রাজভবনে সন্ধ্যায় সাহিত্য সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত শিল্পী বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে একটি চা পানের আসরে বৈঠক করছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ৩ ডিসেম্বর। সন্ধ্যা ৬টা। তিনি নিজে শান্তিনিকেতনের ছাত্রী । বাংলা ভালোই বোঝেন। অল্প বলতেও পারেন। বইপত্র, সঙ্গীত, সিনেমা নিয়ে আলোচনা চলছে। চা চক্রের মাঝপথেই এক সেনা অফিসার দ্রুত একটি চিরকুট দিলেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব ডি পি ধরের হাতে। তিনি কাগজের টুকরোটা নিয়ে ইতস্তত করে প্রধানমন্ত্রীকে দিলেন। ইন্দিরা গান্ধী সেটা পড়ে চুপ। কাগজে লেখা আছে, পাকিস্তান অ্যাটাক করেছে ভারতের ওয়েস্টার্ন সেক্টরে। অসংখ্য এয়ারফিল্ডে বোমা ফেলছে!
শুরু হল একাত্তরের যুদ্ধ! (চলবে)