ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
নায়ার বললেন, ক্যালকাটায় ব্যানার্জি আছে ম্যাডাম। মোস্ট এফিশিয়েন্ট। ইন্দিরা গান্ধী বললেন, ইয়েস আই নো হিম! মেক আ টিম। ইট উইল মাস্ট বি অপারেটেড ফ্রম ক্যালকাটা। আমার মনে হচ্ছে, রিফিউজি ইনফিলট্রেশন হবে। নায়ার বললেন, ইয়েস ম্যাডাম। ইন্দিরা মনে মনে পাকিস্তানের উপর মারাত্মক ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছেন। তবে, তার থেকেও বেশি রাগ হচ্ছে তাঁর আমেরিকার উপর। আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদতে ইয়াহিয়া খান এসব করতে সাহস পাচ্ছে। আসলে ওই নিক্সন-কিসিঙ্কার জুটি ইন্ডিয়াকে দুর্বল মনে করছে। একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার! ভাবলেন ইন্দিরা গান্ধী।
কী কী হয়েছে আগের দিন রাত থেকে ঢাকায়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’টি ব্লকে ঢুকে ছাত্রছাত্রীদের উপর গুলি চালানোর পর পাক সেনারা ট্যাঙ্ক দিয়ে গুঁড়িয়ে দিল বিল্ডিং। এবার লক্ষ্য দু’টি হল। জগন্নাথ হল হস্টেল। যেখানে থাকে হিন্দু পড়ুয়ার দল। ইকবাল হল হস্টেল— সেখানে থাকে মুসলিম পড়ুয়ারা। দু’টি হস্টেলে ঢোকার আগেই আলো নিভিয়ে দেওয়া হল। সার্চলাইট জ্বালিয়ে হস্টেলের আতঙ্কিত পড়ুয়াদের বলা হল লাইন করে দাঁড়াতে। তারপর র্যাট র্যাট র্যাট র্যাট..। গুলিবর্ষণ। টুপ টুপ করে মাটিতে পড়ছে পড়ুয়ার দল। পিছনের সারিতে থাকা ছাত্রদের গুলিতে নিহত হওয়ার আগের কাজ হল তাদের চোখের সামনে একটু আগে গুলিতে নিহত ক্লাসমেট, হস্টেলমেটদের মৃতদেহ সরিয়ে এক পাশে ডাঁই করতে হবে। সেই কাজ হয়ে যাওয়ার পর ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তারা যখন আবার লাইনে দাঁড়াচ্ছে, তখন তাদেরও গুলি করা হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছন দিকে পশ্চিমদিকের বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে স্টাফ কোয়ার্টার। সেখানে ২০টি পরিবার থাকে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করে। ঘরে ঘরে ঢুকে প্রত্যেককে বের করে আনা হল। বন্দুকের সামনে প্রথমেই পুরুষদের বুকে আর মুখে বাঁট আর জুতো দিয়ে মেরে বলা হল, বেঁচে থাকতে চাইলে, যা বলছি সেটাই কর। কী করতে হবে? জগন্নাথ হল, ইকবাল হল থেকে মৃতদেহগুলো বের করে নিয়ে আয়। বাইরে ওই গাছের নীচে জমা কর। সকলকে এই কাজ করতে হবে না। শক্তিশালী লোক চাই। ১৫ জন শক্তপোক্ত পুরুষকে বাছাই করা হল। যারা পারবে ডেডবডি বহন করে আনতে। সেই ১৫ জন কারা? কেউ নাইটগার্ড, কেউ সাফাই কর্মী, কেউ স্টেশনারি স্টাফ। তাদের পরিবারের সদস্যরা স্তব্ধ হয়ে আছে। তারা জানে না বাঁচবে কি না ঘরের পুরুষগুলো। যা বলছে করুক, অন্তত প্রাণে বাঁচিয়ে দিক। চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে। কাঁদলে যদি পাক সেনারা গুলি করে! তাই দাঁতে দাঁত চেপে ছাত্রদের ডেডবডিগুলো বাইরে এনে জড়ো করতে থাকল এই ১৫ জন। কিন্তু রাত পেরিয়ে সকাল, বেলা গড়িয়েছে। অথচ হস্টেলের মধ্যে শব্দ শেষ হচ্ছে না। গুলির শব্দ। তখনও চলছে হত্যালীলা।
পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত মানুষগুলি যখন মৃতদেহ বহন করে করে বাইরে পাহাড় তৈরি করে হাঁফাচ্ছে, তখন তাদের দেখে যেন মায়া হল পাক সেনাদের। বলল, আর যেতে হবে না। এবার লাইন করে দাঁড়াও। যে মৃতদেহ এতক্ষণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বহন করে তারা নিয়ে এসেছিল, সেই ডাঁই হওয়া শবের সামনে দাঁড়াল তারা। এবার নির্লিপ্ত মুখে এই নিরীহ মানুষগুলোকেও গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিল পাক সেনারা। যে মৃতদেহ বহন করে এনেছে এতক্ষণ, তার উপরই নিথর হয়ে নিজেরাও হয়ে গেল নতুন মৃতদেহ। তারপর রেডিও মেসেজ ট্রান্সমিটারে কাকে যেন পাক সেনারা বলল, এখানে কাজ শেষ জনাব...এবার কোথায় যাব? ওপ্রান্ত থেকে জবাব এল, তাঁতিবাজার চলে যাও দুটো রেজিমেন্ট। ওখানে কেউ যেন না বাঁচে। ঘর থেকে বের করে করে মারবে। উত্তর দেওয়া হল, জি জনাব! তারপর এই রেজিমেন্ট চলে গেল তাঁতিবাজারের হত্যা অভিযানে যোগ দিতে। কত জন মারা গেল? সাড়ে ৮ হাজার। ঢাকার ২৫টি বস্তিকে ঘিরে ফেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল। জীবন্ত মারা গেল এক হাজারের বেশি হতভাগ্য। হিন্দু ও মুসলিম উভয়পক্ষই। কোনও বাছবিচার করা হল না।
২৫ মার্চ। রাত সাড়ে ১২টা। অস্থির লাগছে শেখ মুজিবুর রহমানের। কারণ আশ্চর্য ব্যাপার, ফোন ডেড। বোঝা যাচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। ইন্ডিয়ান স্পাই লোকটি যেটা বলে গেল, সেটা কি সত্যি? এবার তাঁকেও গ্রেপ্তার করে মেরে ফেলবে পাক সেনা। আর তাঁকে হত্যা করা মানে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি সত্তা প্রতিষ্ঠার লড়াইটাই তো চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাবে! কিন্তু এখন কী করবেন তিনি? ফোন কাজ করছে না। বাইরে চরম এক অরাজকতা চলছে। জ্বলছে ঢাকা। তিনি খবর পাচ্ছিলেন ফোনে। তাহলে হঠাৎ কেন ফোন খারাপ হয়ে গেল?
রাত দেড়টা। গোঁ গোঁ শব্দ করে বাড়িটা ঘিরে ফেলল একঝাঁক মিলিটারি ট্রাক। গেট খোলার শব্দ। দুটো আর্মি জিপ তীব্র গতিতে আসছে। মুজিবুর রহমান বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। এসব কী হচ্ছে? তিনি ধমকে উঠলেন। নাইট গাউন পরা তিনি। আপনাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। বলল এক উর্দিপরা খান সেনা। মুজিব চমকে উঠলেন। তার মানে ঠিকই বলেছিল সেই ইন্ডিয়ান স্পাই। কিন্তু এখন উপায় নেই। শেখ মুজিবের দেহরক্ষী কিছুতেই নিয়ে যেতে দেবেন সাহেবকে। পাগলের মতো সে ধাক্কা দিচ্ছে পাক আর্মি জওয়ানদের। তিনজন পাক সেনা তাকে মাটিতে ফেলে বুট দিয়ে মারতে শুরু করল। অচেতন হওয়ার আগে পর্যন্ত সে লড়াই চালিয়ে গেল। মুজিবুর রহমান আগেই নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন যে, বাড়িতে অ্যাটাক হওয়ার আগেই যেন পরিবারের সদস্যরা পালায়। সেটাই হয়েছে।
মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নির্মীয়মাণ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বিল্ডিংয়ে। এরপর সরিয়ে দেওয়া হল ক্যান্টনমেন্টের আদমজি কলেজে। সেখানেও যেন মনে করা হল নিরাপদ নয়। ভারতীয় গুপ্তচররা যদি জেনে যায়! তাই আবার তাঁকে সরানো হল। এবার ফ্ল্যাগস্টাফ হাউসে। কিন্তু তার আগেই ইস্টার্ন কমান্ডের পাক আর্মি বেস থেকে করাচিতে এই সুসংবাদ দেওয়া হল। ইয়াহিয়া খানের কাছে গেল একটি গোপন কোডের বার্তা। ‘চিড়িয়া কো পাকড় লিয়া’। অর্থাৎ ‘পাখিকে ধরে ফেলেছি’।
পাকিস্তানের সেনা এবং প্রশাসন চেয়েছিল বাইরের জগতের কাছে এই গ্রেপ্তারির খবর যেন গোপন থাকে আপাতত। প্রথমেই ফাঁস করা হবে না। কারণ, মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হবে কি না সেটা এখনও স্থির হয়নি। আগে সেই সিদ্ধান্ত হোক। একবার যদি সিদ্ধান্ত হয়ে যায় যে, হত্যাই করা হবে, তাহলে তো বাইরের জগতের কাছে আগাম গ্রেপ্তারির সংবাদ জানানোর অর্থই হয় না। কিন্তু পাকিস্তানের মহাদুর্ভাগ্য। তাদের কোনও আইডিয়াই নেই ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার ডিকোডিং সেকশনের টেকনিক্যাল টিমের কাজের। ঢাকা থেকে করাচিতে ওই কোডেড মেসেজ যাওয়ার মাত্র ২৫ মিনিটের মধ্যেই ভারতের গুপ্তচর সংস্থা RAW ডিকোড করে ফেলল ওই মেসেজের অর্থ। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পৌঁছে গেল সেই মেসেজ, শেখ মুজিবুর রহমান অ্যারেস্টেড। আর রেডিও মারফত গোটা বিশ্ব জেনে গেল সেই সংবাদ। গোপন রাখতে পারল না পাকিস্তান! রাগে ফুঁসছেন ইয়াহিয়া খান। তিনি তাঁর কমান্ডার টিক্কা খানকে নির্দেশ পাঠালেন, গোটা ইস্ট পাকিস্তানেই চালাও গণহত্যা। শুনে রাখো, ডাক্তার, অধ্যাপক, শিক্ষক, আইনজীবী, রিসার্চ স্কলার আর রাজনীতিবিদ— এই গোটা সম্প্রদায়কে শেষ করে দিতে হবে। কিন্তু টিক্কা খানের থেকে একটা অদ্ভুত মেসেজ পেলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা নাকি দিকে দিকে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। বেশ কিছু এলাকায় অবিশ্বাস্য সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। এই বাঙালিদের সম্মিলিত ফোর্স পাকিস্তান ফোর্সকে কচুকাটা করেছে। কয়েকটি এলাকা থেকে খবর আসছে, ইস্ট পাকিস্তানিদের ভয়ে কিছু জেলায় পাক সেনারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরতে পারছে না। যারা বেরিয়েছিল এরিয়া ডমিনেশনের জন্য, তাদের নাকি গেরিলা বাহিনী অতর্কিতে আক্রমণ করে শুধু যে পরাস্ত করছে, তাই নয়, প্রচুর অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে। এত কিছু জানানোর পর টিক্কা খান সবশেষে মেসেজ পাঠিয়ে বললেন, জনাব, আমার মনে হয় ইন্ডিয়ান স্পাই এজেন্ট আমাদের ফোর্সে ঢুকে পড়েছে। না হলে অনেক খবর আগাম ফাঁস হয়ে যাচ্ছে কীভাবে? ইয়াহিয়া খান স্তব্ধ হয়ে গেলেন শুনে! জুন ১৯৭১। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন আর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে যখন চলছে স্নায়ু আর বিবৃতির লড়াই, তখন পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তগুলিতে জোর তৎপরতা। একদিকে দলে দলে উদ্বাস্তু আসছে ভারতে। আবার পাশাপাশি সেই উদ্বাস্তুদের ভিড়ে মিশে থাকত একঝাঁক বিশেষ মানুষ। বেশিরভাগই তরুণ, যুবক। পাক সেনার ভয়ে পলায়নরতদের ভিড়ে মিশে গিয়ে তারা ভারতে ঢুকে পড়ছে বটে। কিন্তু আশ্রয় তাদের লক্ষ্য নয়। তাদের উদ্দেশ্য ট্রেনিং। তাদের এভাবেই চলে আসতে বলেছে ভারতের স্পাই সংস্থা। রয়েছে কোনও গোপন প্ল্যান। ইতিমধ্যেই সংকর্ষণ নায়ারকে RAW প্রধান আর এন কাও বলেছেন, ক্যালকাটায় স্পেশাল টিম তৈরি করে মিটিং ডাকো। মাঝেমধ্যেই দুটো লোকেশনে মিটিং হবে। কলকাতা ও আগরতলা। কলকাতার হেড অব ইস্ট পাকিস্তান অ্যাফেয়ার্স পি এন ব্যানার্জি এক দুর্দান্ত অফিসার। তাঁর ব্যক্তিগত নেটওয়ার্ক ভারতের স্পাই এজেন্সিগুলির কাছে এক অ্যাসেট। প্রায় গোটা ইস্ট পাকিস্তানে তাঁর এজেন্ট ছড়ানো।
এছাড়া আছেন RAW-এর হেড অব টেকনিক্যাল ডিভিশন এম বি কে নায়ার। ঠিক হল, এবার থেকে ইস্ট পাকিস্তান বর্ডারে ট্যুর শুরু করতে হবে। RAW যে একটি স্পাই এজেন্সি সেটা সবাই জানে। কিন্তু এর কাজটা কী? এর অফিস কোথায়? কারা হয় এই স্পাই এজেন্সির অফিসার কিংবা কর্মী? এদের রিক্রুটমেন্ট কীভাবে হয়? এসব হল সবচেয়ে গোপন তথ্য। শুধু এই ইন্ডিয়ান স্পাই এজেন্সি নয়। প্রায় সব দেশের ইন্টারন্যাশনাল স্পাই এজেন্সি ঠিক কোন নিয়মে চলে সেটা জানা কঠিন। কারা কোন পজিশনে থাকা কোনও এক সরকারি কর্মী অথবা সাধারণ নিরীহ দেখতে মানুষ যে আসলে গোপন স্পাই সেটা বোঝা শক্ত। ডোমেস্টিক স্পাই এজেন্সি এবং ফরেন সার্ভিস। দু’রকমের গুপ্তচর সংস্থা হয় একটি দেশের। যারা দেশের মধ্যে চরবৃত্তির নজরদারি করে সেটা হল ডোমেস্টিক। ভারতের আইবি। ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো। আর বিদেশের মাটিতে ঘটে চলা ঘটনা পরম্পরা অথবা সন্দেহভাজনদের মনিটার করার কাজ RAW এজেন্সির। এই দুই স্পাই এজেন্সির মধ্যে সমন্বয় থাকে। কিন্তু একই সঙ্গে থাকে ঘোরতর প্রতিযোগিতা এবং শত্রুতাও। যা প্রতিটি দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ, স্পাইং-এর কাজে কোন সংস্থা কাকে টেক্কা দেবে এবং কোন সংস্থার এজেন্ট আসলে ডাবল এজেন্ট হয়ে কাজ করছে সেটা কেউ জানে না। তাই দু’পক্ষই থাকে সতর্ক। তৃতীয় একটি স্পাই সংস্থা থাকে গোপনে। সেটির নাম এম আই। মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স। তবে সেটির পৃথক সত্তা নেই। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীনেই কাজ করে এই বিভাগ। এই তিন সংস্থার মধ্যে আজও রয়ে গিয়েছে একটি যেমন সুন্দর কো-অর্ডিনেশন, ঠিক তেমনই চরম পেশাদারি প্রতিদ্বন্দ্বিতা। বহু ক্ষেত্রেই হয়েছে একটি স্পাই এজেন্সির সোর্স অথবা ইনফর্মারকে অন্য স্পাই এজেন্সি ডাবল ক্রস করে অন্য পক্ষের প্ল্যান ভেস্তে দিয়েছে।
তিন স্পাই এজেন্সির মধ্যে অন্তহীন চলতে থাকা রুদ্ধশ্বাস প্রতিযোগিতার বিবরণ হয়তো অন্য কোনও সময় বলা যাবে, অন্য কোনও কাহিনিতে। এই ধারাবাহিকে সেটা বলতে গেলে মূল প্রতিপাদ্য থেকে সরে আসব আমরা। সুতরাং, দেখা যাক এই স্পাই এজেন্সিদের কীভাবে হ্যান্ডল করলেন ইন্দিরা গান্ধী। তিনি ১৯৭১ সালে তাঁর ‘মিশন ইস্ট পাকিস্তান’ অভিযানে প্রথমেই তিনটি স্পাই এজেন্সির প্রধানকে ডেকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য পক্ষের জুরিসডিকশনে প্রবেশ করে অথবা প্ল্যান নষ্ট করার সামান্যতম চেষ্টা করে, আমি গোটা ইউনিটকে কিন্তু সাসপেন্ড করে দেব। এই ‘অপারেশন ঢাকা’ আমাদের কাছে প্রেস্টিজ ফাইট। সুতরাং এনি হাউ আমাদের এই মিশন সাকসেসফুল করতেই হবে। তাঁর নির্দেশ পেয়ে তিন স্পাই এজেন্সির এজেন্টরা বিভিন্ন বর্ডারের মাধ্যমে ঢুকে পড়ল বাংলাদেশে। যোদ্ধা রিক্রুটের জন্য আর গোপন খবর পেতে। যে বাঙালি যোদ্ধারা পূর্ব পাকিস্তানে পাক বাহিনীকে প্রতিরোধ করছে তাদের নাম ‘মুক্তিযোদ্ধা’। সংক্ষেপে মুক্তি। যাদের কোনও সামরিক প্রশিক্ষণ নেই। কিন্তু স্রেফ মনের জোরে আর নতুন একটি বাঙালির নিজস্ব দেশ পেতে তারা প্রাণ তুচ্ছ করে নেমেছে লড়াইয়ের ময়দানে একটি সুবিন্যস্ত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। পাক সেনাবাহিনী। যাদের কাছে রয়েছে এয়ার ফোর্স, আর্মি আর নেভি। এছাড়া রাজাকার বাহিনী। যারা পাক সেনার শ্যাডো ফোর্স। সোজা কথায় এজেন্ট। তারা পথ দেখায়, বাড়ি চিনিয়ে দেয় পাক সেনাদের। তারপর সেইসব বাড়িতে হামলা চালায় পাক সেনা। সুতরাং যতটা ভয়ঙ্কর শত্রু পাক সেনা, ততটাই ঘরশত্রু বিভীষণ এই রাজাকার বাহিনী। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, ততই মুক্তির ছেলেরা ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে পাক সেনা আর রাজাকারদের মনে। কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। মুক্তিকে ট্রেনিং দিতে হবে। মিলিটারি ওয়ারফেয়ার শেখাতে হবে। মিনিমাম একটা কুশলতা না থাকলে নিছক আবেগ দিয়ে তো একটা আস্ত সেনাবাহিনীকে হারানো যায় না! অতএব ভারতের গুপ্তচর প্রধান আর এন কাও প্ল্যান করলেন, যতক্ষণ না ভারত যুদ্ধে নামছে, তার আগে, মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে একের পর এক অপারেশন করাতে হবে। প্রথম অপারেশনের নাম জ্যাকপট! কী সেটা? ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক এক অভিযান! পারবে কি মুক্তিবাহিনী? ভারতীয় সেনা সবরকম লজিস্টিক সাপোর্ট আর প্ল্যান দেবে। কিন্তু প্রয়োগ করতে হবে মুক্তিকে। কীভাবে তৈরি হল সেই প্ল্যান?
RAW-এর অধীনে গোপন একটি প্যারামিলিটারি ফোর্স আছে। যা একমাত্র কোভার্ট অপারেশন করে থাকে। তার নাম স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স। এস এফ এফ। এই এস এফ এফ-কে বিশেষ ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। ছোটখাট ট্রেনিং নয়। ছোটখাট হামলা নয়। সরাসরি পাকিস্তানের নৌবাহিনীকে অ্যাটাক করতে হবে। তাই মুক্তিবাহিনীর মধ্যে থেকেই বাছাই করে নেওয়া হবে অসমসাহসী তরুণ আর পূর্ব পাকিস্তানের নৌবাহিনী, পুলিস অথবা বায়ুসেনার কর্মী অফিসারদের। যারা এখন মুক্তির সদস্য।
চারটি স্পট। চারটি বন্দর। যেখানে পাকিস্তানের নৌবাহিনীর নেতৃত্বে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মোংলা। ১৫ আগস্ট, ১৯৭১, অপারেশনের দিন স্থির হয়েছে। এই চার বন্দরে পাকিস্তানের চারটি যুদ্ধজাহাজে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ডুবিয়ে দিতে হবে। কীভাবে করতে হবে কাজটা? ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীতে ভেসে থাকতে হবে। সাঁতরাতে হবে হয়তো দু’দিন ধরে। এমনকী, টার্গেট করা জাহাজের লোকেশন চেঞ্জ হয়েও যেতে পারে। বুকে থাকবে নিমপেট মাইন লাগানো। তাই সাঁতরাতে হবে সতর্কভাবে। নচেৎ নিজেরাই বিস্ফোরণে মারা যাবে। এরপর গোপনে নিঃশব্দে পাকিস্তানের যুদ্ধজাহাজের নীচে পৌঁছনো। সেখানে রয়েছে কেবল বক্স। সেটাও শব্দ না করে বিশেষ ডিভাইস দিয়ে খুলে, নিখুঁতভাবে লাগাতে হবে বিস্ফোরক। থাকবে ম্যাগনেটিক সেল। ঠিক সেখানেই লাগাতে হবে মাইন।
তারপর অনেকটা দূরে সরে যেতে হবে দ্রুত। মনে রাখতে হবে সারাক্ষণ নদীবক্ষে পড়বে সার্চলাইট। ঘুরছে র্যাডার। সুতরাং ধরা পড়ার চান্স যে কোনও সময়। ধরেই নেওয়া যায় কেউই বেঁচে ফিরবে না। সুতরাং আসলে এটা সুইসাইড স্কোয়াড। পূর্ব পাকিস্তানের এই গেরিলা যোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের দায়িত্বে ভারতের নৌসেনা কমান্ডার এম এন সামানত এবং লেফটেন্যান্ট কমান্ডার জি এম মার্টিস। জুলাই। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর মনোনীত করা হল ২৯৯ জনকে। নদীয়া ও মুর্শিদাবাদের সীমান্তের একটি স্থান বেছে নেওয়া হল ট্রেনিংয়ের জন্য। জায়গাটার নাম পলাশি! ক্যাম্পের সাংকেতিক কোড-সি টু পি! শুরু হল ট্রেনিং! টার্গেট অপারেশন জ্যাকপট!
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে