ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
ইয়াহিয়া খান একটি মিটিং ডাকলেন। আর্মি কমান্ডার, নেভি অ্যাডমিরাল আর এয়ার ফোর্সের কয়েকজন বাছাই করা অফিসারকে ডাকা হল। এলেন জুলফিকার আলি ভুট্টোও। তিনিও মুজিবুর রহমানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া আটকাতে মরিয়া। কিন্তু নির্বাচনকে মেনে নিলে এছাড়া উপায় নেই। শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামি লিগ পূর্ব পাকিস্তানে পেয়েছে ১৬৭ আসন। ভুট্টোর দল পশ্চিম পাকিস্তানে মাত্র ৮৫। সুতরাং যে কোনও রীতিনীতি সংবিধান যাই বলা হোক, মুজিবুর রহমানই প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন।
কিন্তু সেটা হতে দেওয়া যাবে না। কীভাবে ঠেকানো যাবে, প্লট রচনা করা হল। মুজিবুর রহমান নির্বাচনে লড়াই করেছেন ছ’দফা দাবির ভিত্তিতে। যাকে বলা হচ্ছে সিক্স পয়েন্ট প্রোগ্রাম। সেই ছ’দফা দাবির মধ্যে রয়েছে প্রতিটি বাস্তব তথ্য। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৭৫ শতাংশ রপ্তানি হয়। সিংহভাগ বিদেশি মুদ্রা আয় হয় পূর্ব পাকিস্তানের মাধ্যমেই। অথচ সে পায় কতটুকু? ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। মাথাপিছু আয়ের ফারাক বেড়েই চলেছে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে। ৬২ শতাংশ। ধান থেকে নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের দাম পূর্ব পাকিস্তানে আকাশছোঁয়া। অথচ, পশ্চিম পাকিস্তানে কম। পাকিস্তানের ৯৪ শতাংশ প্রশাসনিক অফিসার পশ্চিম পাকিস্তানের। বিদেশ দপ্তরের চাকরিতে ৮৫ শতাংশই পশ্চিম পাকিস্তানের লোক। আর্মিতে নিয়োগ? ৯৫ শতাংশই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। এই তীব্র বৈষম্য মানবেন না মুজিব। অতএব এই ইস্যুতে তাঁর নির্বাচন লড়া এবং জয়। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী হলে সর্বাগ্রে এই বৈষম্য তিনি দূর করবেন। আর ঠিক সেটাই আটকাতে হবে। অতএব শেখ মুজিবকে ইয়াহিয়া খান বললেন, আপনাকে এসব দাবির অনেকটাই ছাড়তে হবে। না হলে পাকিস্তানের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হবে।
মুজিব নারাজ। বললেন, প্রশ্নই ওঠে না। একটিও দাবি অন্যায্য নয়। কেন প্রত্যাহার করব? ইয়াহিয়া খান ঠিক এই জবাবই চাইছিলেন। তিনি ওই দাবিগুলি পাকিস্তানে বলবৎ করতে দেবেন না। শুরু হল দড়ি টানাটানি। আর ঠিক এরকম সময়ে জুলফিকার আলি ভুট্টো বললেন, তিনি সংসদ বয়কট করবেন। পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য এই বৈষম্য মানা যাবে না। ব্যস! প্রধান বিরোধী দলের নেতাই যখন ঘোষণা করে দিয়েছেন যে, তাঁরা সংসদ বয়কট করবেন, তাহলে তো এটাই সবথেকে বড় সুযোগ। ইয়াহিয়া খান এই সুবর্ণ সুযোগটি নিতে মরিয়া হয়ে যে প্ল্যান করলেন, সেটিই স্থির হল একটু আগে বর্ণিত ওই গোপন মিটিং-এ।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেন আপাতত সংসদ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেওয়া হল। কবে চালু হবে? রেডিও ব্রডকাস্টে ইয়াহিয়া একটি তারিখের কথা বললেন। ২৫ মার্চ! চেষ্টা করা হবে সেদিন আবার সংসদ চালু করতে। তার আগে হবে সব পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা। আসলে কোনও আলাপ-আলোচনা নয়। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে যাবেন জুলফিকার আলি ভুট্টো। আর সেই সময়সীমায় ইয়াহিয়া খান বৃহত্তর একটি গেমপ্ল্যান নিয়ে এগবেন। কী সেই গেমপ্ল্যান? গণহত্যা!
ঠিক যেদিন সংসদ স্থগিতের এই ঘোষণা করা হচ্ছে, সেদিনই ঢাকায় পৌঁছে গেল পাক আর্মির বালুচ রেজিমেন্ট। দলে দলে নেমে এল জওয়ান। হঠাৎ ভারতীয় সীমান্ত থেকে ঘুরিয়ে ঢাকার দিকে নিয়ে আসা হচ্ছে ট্যাঙ্ক। ঢাকার রাস্তায় বেড়ে যাচ্ছে ট্যাঙ্কের চলাফেরা। কী চাইছে পশ্চিম পাকিস্তান? ঢাকাবাসীর বুক কাঁপছে! ইয়াহিয়া খানের প্ল্যান হল— ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, মিলিটারি ব্যারাকগুলিতে যত বাঙালি রেজিমেন্ট আছে, তাদের সরিয়ে অথবা নিষ্ক্রিয় পোস্টিং-এ পাঠিয়ে আরও বেশি বেশি পশ্চিম পাকিস্তানের আর্মি জওয়ান পাঠানো হবে। যাদের পূর্ব পাকিস্তানিরা নাম দিয়েছে ‘খান সেনা’!
সেই প্ল্যান অনুযায়ী একের পর এক সি ওয়ান থার্টি এয়ারক্র্যাফট নামছে ঢাকায়, চট্টগ্রামে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে দলে দলে খান সেনা। তার আগের দিনই শেখ মুজিবুর রহমান ডেকেছেন ধর্মঘট। ২ মার্চ। পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে শুরু হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের এই গণতন্ত্র বিরোধী অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বিক্ষোভ আন্দোলন। আগুন জ্বলে উঠছে বাঙালির বুকে। এটাই তো চান ইয়াহিয়া খান। তিনি তাঁর সেনাবাহিনীর সবথেকে বিশ্বস্ত ও অনুগামী অফিসারকে পাঠালেন ঢাকায়। লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান! তাঁর নতুন পদের নাম মার্শাল আইন প্রশাসক। তাঁকে পাঠিয়ে সরিয়ে দেওয়া হল অ্যাডমিরাল এহসানকে। কেন? কারণ অ্যাডমিরাল এহসান বলেছিলেন, এভাবে নিজেদেরই দেশের মানুষের উপর দমনপীড়ন করার মাধ্যমে শাসন করা যায় না। যে কোনওদিন আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। যে কোনওদিন মানুষ বিদ্রোহ ঘোষণা করে হয়তো পৃথক রাষ্ট্র চেয়ে বসবে! ইয়াহিয়া খানকে এই সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন অ্যাডমিরাল এহসান।
আমেরিকা যাঁর বন্ধু, চীন যাঁর সহায়, সেই অসীম ক্ষমতাধর এই এক টুকরো পূর্ব পাকিস্তানের ভীরু বাঙালি জাতিকে এত গুরুত্ব দেবেন কেন? এরকমই ভাবলেন ক্ষমতার মদমত্তে আস্ফালনকারী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। তিনি পাল্টা নির্দেশিকায় এহসানকে বললেন, আপনাকে দিয়ে হবে না। ফিরে আসুন। টিক্কা খান ইয়াহিয়া খানের যোগ্য সঙ্গী। তিনি ঢাকায় পা দেওয়ার পরই দেখলেন লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ। শেখ মুজিবুর রহমানের সভায়।
টিক্কা খান সেই রিপোর্ট দিলেন ইয়াহিয়া খানকে। আর পাশাপাশি একটি আলাদা রিপোর্ট লিখলেন। সেখানে বললেন, আমাকে আরও ফোর্স পাঠান জেনারেল! মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় এই ‘বাঙালি বাচ্চাদের’ স্রেফ গুঁড়িয়ে দেব। জীবনে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। ইয়াহিয়া খান বেজায় খুশি। এই তো চাই। এরকমই একজন মার্শাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর চেয়েছিলেন তিনি। টিক্কা খানকে পাল্টা মেসেজ করলেন, ওয়েট করো! আমি দেখছি কত তাড়াতাড়ি পাঠানো সম্ভব ফোর্স!
আর্মি হেডকোয়ার্টার, রাওয়ালপিন্ডি। সেখানে সারাদিন, সারারাত, পরপর দু’দিন ধরে চলছে ফোর্স ডেপ্লয়মেন্ট আর রিসোর্স মনিটরিং মিটিং। পাকিস্তানের প্রতিটি প্রান্ত থেকে চাওয়া হয়েছে ডিটেইলস তথ্য। কোন ব্যারাক, কোন রেজিমেন্ট, কোন ক্যান্টনমেন্টে কত ফোর্স আছে? তাদের কত দ্রুত পাঠানো সম্ভব অন্যত্র? অন্যত্র মানে একটাই গন্তব্য! ঢাকা! দু’দিনের মিটিংয়ের শেষে তৃতীয় দিনে যে রিপোর্ট জমা পড়ল সেটাই পাঠানো হল টিক্কা খানের কাছে। বলা হল, অন্তত ১৯ দিন লাগবে সামগ্রিক ফোর্স মোতায়েন করতে। ঠিক আছে সময় লাগুক। ততদিনে মুজিবুর রহমানকে আলাপ-আলোচনায় ফাঁকি দিয়ে রাখতে হবে। ইয়াহিয়া খান এসে গেলেন ঢাকায়। আলাপ-আলোচনার আড়ালে আসলে মনিটরিং করছেন।
২৪ মার্চ। তিন ডিভিশন আর্মি এসে গিয়েছে। ২৫ হাজারের বেশি প্যারা মিলিটারি ফোর্সকে মোতায়েন করা হচ্ছে জেলায় জেলায়। দু’টি বিশেষ ফোর্স আছে। তাদের কাজে লাগানো হবে সাধারণ মানুষকে টার্গেট করার জন্য। বিহারী ও আনসারি বাহিনী। পাকিস্তান আর্মির ইস্টার্ন কমান্ড হেড কোয়ার্টার্সের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল স্টাফ বাকের সিদ্দিকিকে দেখা গেল প্রশস্ত একটা লনে অফিসারদের ব্রিফ করছেন। ঠিক কী কী করতে হবে এবং কীভাবে মেসেজ আসবে সেটার একটা ডেমনস্ট্রেশন চলছে। কী কারণে? সেটা এখনও এই অফিসাররা জানে না। তারা শুধু জানে কিছু একটা প্ল্যান আছে। এই ব্রিফিং এর পর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে ব্রিগেডিয়ার বললেন, স্যার, উই আর রেডি!
টিক্কা খান বললেন, ফোর্স ডেপ্লয়মেন্টে কতক্ষণ লাগবে?
ব্রিগেডিয়ার জানালেন, আড়াই ঘণ্টার মধ্যে এক্সিকিউট করা যাবে। কোথা থেকে শুরু করব স্যার!
টিক্কা খান বললেন, ইউনিভার্সিটি আর লিগ, এই দুটোকে আগে ক্র্যাকডাউন করবে। তারপর এরিয়া ডমিনেশন। কিন্তু কোনও বাছবিচার করবে না। মেজর একটা মানসিক ধাক্কা দেওয়াই কিন্তু আমাদের টার্গেট। সেটা যাতে মারাত্মক রকমের হয় সেটা কনফার্ম করবে।
ব্রিগেডিয়ার বললেন, জি জনাব! নাইনথ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন রেডি। এছাড়া ফোরটিন্থ আর সিক্সটিন্থ স্ট্যান্ড বাই। ফোর্স অফিসাররা বলছে, এটাই যথেষ্ট।
টিক্কা খান বললেন, তাহলে কবে মুভ করবে?
ব্রিগেডিয়ার বললেন, আগামী কাল?
টিক্কা খান একটু ভেবে বললেন, ঠিক হ্যায়। উসসে পহেলে জনাব জেনারেল করাচি পঁউছ যানা চাহিয়ে।
সেরকমই ঠিক হল। ইয়াহিয়া খানকে বলা হল, আগামী কাল, ২৫ মার্চ প্ল্যান করা হচ্ছে জনাব! আপনি তার আগেই ঢাকা থেকে বেরিয়ে যান। ইয়াহিয়া খান রাজি। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, টিক্কা, এমন শিক্ষা দাও যে আর জিন্দেগিতে কেউ মাথা তুলতে না পারে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে!
টিক্কা খানের চোখ জ্বলে উঠল। বললেন, জি জনাব! ২৪ ঘণ্টায় নিকেশ করে দেব। লিস্ট তৈরি করা হয়েছে। কীভাবে অপারেশন হবে। পূর্ব পাকিস্তানের এই বাঙালি নিধন যজ্ঞের ব্লু প্রিন্টের নাম দেওয়া হয়েছে অপারেশন সার্চলাইট। কোড নেম!
পাঁচটি খতম লিস্ট। ১) ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মিলিটারি ফোর্স আর ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস। একই সঙ্গে থানার পুলিস, প্যারা মিলিটারি। মুজাহিদি। ২) জেলা আর টাউনে বিশেষ করে টার্গেট করা হবে হিন্দু ফ্যামিলি যে পাড়ায় থাকে সেগুলিকে। কীভাবে বোঝা যাবে কারা হিন্দু? আগে থেকেই তাদের বাড়ির গায়ে ‘এইচ’ লেখা হবে। অর্থাৎ হিন্দু! ৩) আওয়ামি লিগের যে কোনও পার্টি অফিস আর নেতাদের বাড়ি। সে যে ধর্মেরই হোক ৪) কলেজ, ইনস্টিটিউট, ইউনিভার্সিটির হস্টেলের হিন্দু, মুসলিম বাঙালি ছাত্রছাত্রী আবাসিক, সকলকে মারতে হবে ৫) আর সর্বোপরি, অধ্যাপক, শিক্ষক, ডাক্তার, উকিল, লেখক, সমাজসেবী। অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। এই পাঁচ ক্যাটাগরির মানুষকে সম্পূর্ণ খতম করে দিতে পারলে আর কোনওভাবেই আগামী দিনে প্রশাসন পরিচালনা কিংবা রাজনীতিতেও মাথা তুলতে পারবে না এই জাতি। সুতরাং প্রত্যেকটি ডিভিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হল কে কোন ক্যাটাগরিকে খতম করার অভিযান কীভাবে শুরু করবে।
ইয়াহিয়া খান ঢাকা ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁর ফ্লাইট করাচিতে ল্যান্ড করার খবর এল। কিন্তু জুলফিকার আলি ভুট্টো ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে থেকে গেলেন। তিনি দেখতে চান অত্যাচারের দৃশ্য। ঢাকার ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার্স থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান নির্দেশ দিলেন, অ্যাটাক!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ধুম ধুম ধুম শব্দ হচ্ছে। আতঙ্কিত এবং কৌতূহলী ছাত্রছাত্রীরা হস্টেল থেকে বেরিয়ে আসছে লনের দিকে। কী হচ্ছে এসব? একটু দূর থেকে দেখা যাচ্ছে এম ওয়ান ওয়ান থ্রি আর্মারড পার্সোনাল কেরিয়ার আর একঝাঁক আসছে ইউনিভার্সিটির মধ্যে। প্রত্যেকটি জিপ মেশিন গান ফিটেড। সেগুলি ভিতরে ঢুকে আসছে কেন? ছাত্রছাত্রীরা বিস্মিত! পাকিস্তানি সেনা সেটা তো আন্দাজ করাই যায়। কিন্তু এখানে কেন? ট্যাঙ্ক, জিপ আর আর্মারড ভেহিকেল মিলে একটা কলাম তৈরি হয়ে গেল। ঠিক যেমন ইনফ্যান্ট্রি অ্যাটাকের সময় হয় যে কোনও যুদ্ধে। আর তারপর সামনে দাঁড়ানো একঝাঁক পড়ুয়া শুনতে পেল একটা চিৎকার! সেটা আসলে একটা নির্দেশ, ফায়ার! তৎক্ষণাৎ গর্জে উঠল মেশিন গান। নির্বিচারে। ছাত্রছাত্রীরা যতটা বিস্মিত, ততটাই অপ্রস্তুত। এভাবে যে ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে গুলি করতে পারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এটা কল্পনাই করা যায়নি। কিন্তু তাই ঘটছে। গুলি চলছে।
টুপ টুপ টুপ করে দেহগুলি পড়ে যাচ্ছে মাটিতে। ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পারছে ছুটছে। কেউ সিঁড়িতে, কেউ বাগানে, কেউ বারান্দা পেরিয়ে। ইউনিভার্সিটিতে এই ছেলেমেয়েরা পড়তে এসেছে ফরিদপুর থেকে, রাজশাহি থেকে, পাবনা থেকে, কিশোরগঞ্জ থেকে, বিক্রমপুর থেকে, বরিশাল থেকে...। গুলি লাগছে বুকে, পায়ে, মাথায়, পেটে...।
বি ব্লক ক্লিয়ার হো গয়া জনাব! চিৎকার শোনা গেল এক অফিসারের মুখে। ক্লিয়ার হো গয়া! মানে হল, আর কোনও ছাত্রছাত্রী বেঁচে নেই। সব খতম করা সম্পন্ন! সেই অফিসারের কপালে ঘাম। একটু যেন শ্বাস নিচ্ছেন। এতগুলো হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করা সোজা কাজ নয়। অন্য প্রান্ত থেকে শোনা গেল পাল্টা নির্দেশ, ঠিক হ্যায়, আব সি ব্লক টার্গেট করো। কেউ যেন বাঁচতে না পারে। গদ্দার বঙ্গালি!
........
রাত ১১টা। ইউনাইটেড স্টেটস কনস্যুলেট অফিস, ঢাকা। আর্চার ব্লাড পাগলের মতো টাইপ করছেন। টেলিগ্রাম। তিনি এই অফিসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স। আজ এর আগেও টেলিগ্রাম মেসেজ করেছেন। আমেরিকায় স্টেট ডিপার্টমেন্টে। কোনও রেসপন্স নেই। আবার টেলিগ্রামে লিখছেন তিনি, ইয়াহিয়া খানকে এখনই বলুন এসব থামাতে। এখানে গণহত্যা করছে পাকিস্তানের সেনা। কিছু একটা করুন। দরজায় কেউ নক করছে। লিখতে লিখতেই আর্চার ব্লাড বলছেন, কাম ইন! ঘরে ঢুকলেন জেন ম্যাকব্রাইড। আমেরিকার এই ঢাকা দূতাবাসের থার্ড সেক্রেটারি। তাঁর চোখেমুখে আতঙ্ক। স্যার, রাস্তায় এম টুয়েন্টি ফোর ট্যাঙ্ক নেমেছে!
ব্লাড ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন। তিনি কী করতে পারেন? একটা কঠোর মেসেজ লিখতে বসলেন। যেখানে সরাসরি জানিয়ে দিলেন, আমেরিকা তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। এই চরম অত্যাচার কীভাবে মেনে নেওয়া যায়?...কিন্তু ওয়াশিংটন থেকে কোনও উত্তরই এল না।
শেখ মুজিবুর রহমান কোথায়? রাত আটটায় একজন রহস্যময় ব্যক্তি তাঁর বাড়িতে এসে একটা চিরকুট দিয়েছে। লোকটি ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার এক এজেন্ট! তিনি বলেছেন, মুজিবুর রহমানকে এখনই ঢাকা থেকে চলে যেতে। কারণ, গোপন রিপোর্ট আছে পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে পরিবারসহ হত্যা করতে আসছে। আপনি পালান। মুজিবুর রহমান রাজি নয়। তাঁর জবাব, আমাকে না পেলে এরা আরও ভয়ঙ্কর অত্যাচার করবে। আগুন জ্বালিয়ে দেবে ঢাকায়। আমি আমার নাগরিকদের ফেলে রেখে পালাতে পারি না। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দুটি জিপ ঝড়ের গতিতে ঢুকে পড়ল শেখ মুজিবের বাড়িতে! সোজা দুটি মেশিন গান নিশানা করা হল তাঁর দিকে। আমাদের সঙ্গে চলুন। কঠোর নির্দেশ। কোথায়? জানতে চাইছেন মুজিবুর রহমান। কমান্ডো বাহিনী জবাব দিল না।
ততক্ষণে রাজারবাগ থানায় যুদ্ধ শুরু হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের পুলিস বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর। অসম যুদ্ধ। একদিকে সামান্য কিছু বন্দুক আর পিস্তল নিয়ে বাঙালি ফোর্স। অন্যদিকে, পাক সেনাবাহিনী। থানার ছাদে শুয়ে ৫ হাজার সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছে পুলিসকর্মীরা। কতক্ষণ পারবে তাঁরা এই যুদ্ধ চালাতে? ঢাকাজুড়ে শুরু হয়েছে এক মহাযুদ্ধ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে পাড়া, গলি, মহল্লা।
........
মধ্যরাত পেরিয়ে গিয়েছে। ফোন বাজছে দিল্লিতে! ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে!
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে