ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
তিনি ফোনে কথা বলছিলেন এতক্ষণ। একটু আগেই পাকিস্তানের নেভি সাবমেরিন পিএনএস গাজির ক্যাপ্টেন জাফর মহম্মদ খানকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। জাফর এসে দেখলেন ঘরে আরও কয়েকজন। চেনা মানুষ। পাকিস্তান নেভির ডেটা অপারেটর, কোড অ্যানালিস্ট এবং রেডিও ট্রান্সমিটার ডিরেক্টর জালালউদ্দিন। তাঁরা ইঙ্গিতে ক্যাপ্টেন জাফরকে বলেছেন, বসতে। ক্যাপ্টেন ভুমবাল টেলিফোনে কয়েকবার বললেন, জি জনাব...জি জনাব... জরুর জনাব। বোঝা গেল, ফোনের অন্য প্রান্তে কোনও এক রাজনীতিবিদ কিংবা পাকিস্তান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কেউ। তাই এত সন্ত্রস্ত ক্যাপ্টেন ভুমবাল!
ফোন রেখে ক্যাপ্টেন জাফরকে ক্যাপ্টেন ভুমবাল বললেন, জেন্টলম্যান, মনে হচ্ছে কিছুদিনের মধ্যেই আমরা ইন্ডিয়ার সঙ্গে একটা যুদ্ধে যাচ্ছি। সিচ্যুয়েশন সেদিকেই এগচ্ছে। আপনাদের তৈরি থাকতে হবে যে কোনও অবস্থার জন্য। আপনারা জানেন, যেভাবে ইন্ডিয়ান নেভির ডিরেক্ট ট্রেনিং আর ডিরেকশনে ইস্ট পাকিস্তানের মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের প্লাস একঝাঁক বিদেশি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে, এটা আমাদের কাছে এক আন্তর্জাতিক লজ্জা। তাই বদলা নিতে হবে। জনাব প্রেসিডেন্ট সেরকমই চাইছেন। আমরা পাল্টা এমন এক আঘাত করব ইন্ডিয়াকে যে, আসল যুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক আগেই ইন্ডিয়ার শক্তি দুর্বল হয়ে যাবে। তাই আমাদের টার্গেট ইন্ডিয়ার যুদ্ধজাহাজ আইএনএস বিক্রান্ত। আপনারা জানেন যে, ওই যুদ্ধজাহাজ ইন্ডিয়ার কাছে খুব প্রেস্টিজিয়াস। ওটাকে আমরা অ্যাটাক করতে পারলে মেন্টাল যুদ্ধে আমরা এগিয়ে যাব অনেকটাই। এই দায়িত্ব নেবে পিএনএস গাজি। যার ক্যাপ্টেন আপনি, জনাব জাফর।
জাফর মহম্মদ খান এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিলেন। এবার বললেন, জনাব, এটা এক ভয়ঙ্কর প্ল্যান। ইন্ডিয়ান নেভি সামান্যতম আঁচ পেলেই উল্টে আমাদের ডিরেক্ট অ্যাটাক করবে। তাই এই প্ল্যান যেন আমাদের আর্মি, এয়ারফোর্স আর নেভির মধ্যেও খুব বেশি কেউ না জানতে পারে।
ক্যাপ্টেন ভুমবাল আশ্বস্ত করলেন। বললেন, কেউ জানবে না। চিন্তা নেই। আমরা কয়েকজন। অপারেশনে থাকা ক্রু আর অফিসাররা। কোডিং ডিপার্টমেন্ট। ক্যাপ্টেন ভুমবাল তাঁর সামনেই রাখা একটি ফোল্ডার এগিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন জাফর মহম্মদ খানকে। বললেন, জাফর, এই ফোল্ডারে আপনি পাবেন আইএনএস বিক্রান্ত সম্পর্কে ডিটেইলস। ড্রট, ডেড ওয়েট, ফ্রিবোর্ড, ডিসপ্লেসমেন্ট, স্টিল প্লেট, অস্ত্রশস্ত্রের লোকেশন, ফুয়েল ট্যাঙ্ক সব দেওয়া আছে এখানে। ডায়াগ্রাম রয়েছে আলাদা করে। ঠিক কী ধরনের এয়ারক্র্যাফট ক্যারি করে এই বিক্রান্ত, সেটাও মেনশন করে দিয়েছে আমাদের এয়ারফোর্স। আপনি আজ এটা গো থ্রু করুন। তারপর নিজের টিম তৈরি করে ফাইনাল প্ল্যান জানান। আর শুনুন একটা কথা। এটাই কিন্তু আইডিয়াল টাইম বিক্রান্তকে ধ্বংস করার।
মহম্মদ জাফর বিস্মিত। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। তাঁর প্রশ্ন একথা কেন বলছেন ক্যাপ্টেন ভুমবাল! ক্যাপ্টেন প্রত্যেকের সামনে মাথাটা ঝুঁকিয়ে যেন গোপন তথ্য দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, বিক্রান্তের স্পিড গত এক বছর ধরে কমে গিয়েছে। শুনছি বয়লারে ক্র্যাক ধরা পড়েছে। ওরা ওটা মেরামতির চেষ্টা করছে।
ক্যাপ্টেন জাফর জানতে চাইলেন, স্যার, বিক্রান্তের এখন লোকেশন কোথায়?
ক্যাপ্টেন ভুমবাল বললেন, ন্যাভাল ইন্টেলিজেন্সে সর্বশেষ যে রিপোর্ট দিয়েছে, সেটা থেকে জানা যাচ্ছে, বিক্রান্তকে লাস্ট দেখা গিয়েছে বম্বের কাছে। জাফর ভাই এই সুযোগ ছাড়া যাবে না। জাফর মহম্মদ খানের চোয়াল শক্ত হল একটু। এরকম চ্যালেঞ্জ নিতে তিনি পছন্দ করেন। অনেকদিন ধরেই শুনছেন, ইন্ডিয়ান নেভির ট্রেনিং আর প্ল্যানিংয়ে একের পর এক পাকিস্তান ওয়ারশিপ, কোস্টাল ফোর্সের বোট ধ্বংস হয়ে চলেছে। এসব করছে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা বাহিনী। কিন্তু আদতে পিছনে মস্তিষ্ক, ইনস্ট্রাকটার আর পরিকল্পনা সবই ইন্ডিয়ান নেভির। এবার পাকিস্তান চাইছে শিক্ষা দিতে ইন্ডিয়াকে। আর সেই কাজটা যে তাঁর হাতে এসে পড়বে এটা ভাবাই যায় না। পিএনএস গাজির নাম আগামী দিনে পাকিস্তানের ইতিহাসে অমর করে দেবেন তিনি। পিএনএস গাজির টিমের উপর ক্যাপ্টেন জাফরের সম্পূর্ণ ভরসা আছে। আমরা একাই আইএনএস বিক্রান্তকে ধ্বংস করে দিতে পারি। মনে মনে এই শপথবাক্য নিয়ে মিটিং থেকে উঠে পড়লেন পিএনএস গাজির ক্যাপ্টেন জাফর।
যারা ছুটিতে ছিল, তাদের সকলকেই জরুরি নির্দেশ দিয়ে বলা হল, ইমিডিয়েট জয়েন করতে গাজিতে। ক্যাপ্টেন জাফর, তাঁর টিম নিয়ে বসলেন বৈঠকে। কিছু কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এই ইনফর্মেশন চাই আমার। অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল! কোথায় আছে বিক্রান্ত? ক’জন ক্রু মেম্বার অপারেট করছে? কটা এয়ারক্র্যাফট এখন ক্যারি করছে সে? কোন স্কোয়াড্রন বিক্রান্তের পোস্টেড? লাস্ট মুভমেন্টের ডিটেইলস। আর এখন বিক্রান্তের স্পিড কত? শেষ প্রশ্নটার একেবারে সঠিক উত্তর আমাদের জানা দরকার। কুইক বয়েজ! ক্যাপ্টেন জাফর সকলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন, ইয়ে হামারে সবহিকে কেরিয়ার অওর পাকিস্তানকি শান কে লিয়ে গোল্ডেন চান্স হ্যায়। ইয়াদ রাখনা।
....
নভেম্বর ১৯৭১। ভারতের যুদ্ধজাহাজ আইএনএস বিক্রান্তের ক্যাপ্টেন স্বরাজ প্রকাশ বসে আছেন এক কাপ কফি নিয়ে। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি উদ্বিগ্ন। কপালে দুটো ভাঁজ। মনে অস্থিরতা। তাঁর সামনের টেবিলে রাখা এক টুকরো কাগজ। এই কাগজে আছে চিফ ইঞ্জিনিয়ারের রিপোর্ট। যে রিপোর্টে বলা হয়েছে, আইএনএস বিক্রান্তের চারটে বয়লারই খারাপ হয়ে গিয়েছে। রিপ্লেসমেন্ট ছাড়া উপায় নেই। আর চারটে বয়লারকে সরিয়ে নতুন বয়লার লাগানোর প্রক্রিয়া অনেক সময় নেবে। অথচ এখনই বিক্রান্তকে ইস্টার্ন ফ্লিট এরিয়ায় যেতে হবে। কারণ, প্রথমত এতক্ষণে পাকিস্তান সম্ভবত জেনে গিয়েছে যে, বিক্রান্তের মধ্যে টেকনিক্যাল ফল্ট আছে। সেটা জানার পর তারা প্রাণপণের চেষ্টা করবে যেভাবেই হোক অ্যাটাক করে বিক্রান্তকে ধ্বংস করার। আরব সাগরে ওয়েস্টার্ন ফ্লিটে তাই বিক্রান্তকে রাখা নিরাপদ নয়। সরাতে হবে বঙ্গোপসাগরের দিকে। আর মনে হচ্ছে আগামী কিছুদিনের মধ্যেই বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরে রীতিমতো যুদ্ধজাহাজের সারি মোতায়েন করতে হবে। এখনও অফিসিয়ালি যুদ্ধ শুরু হয়নি বটে, তবে পাকিস্তানকে হেল্প করার জন্য শোনা যাচ্ছে ইতিমধ্যেই আমেরিকান ওয়ারশিপ আসতে পারে। পাশাপাশি দুটো সাবমেরিন। সেটা কি সত্যি?
ক্যাপ্টেন স্বরাজ প্রকাশ ভাবছিলেন আইএনএস বিক্রান্তের জার্নির কথা। ১৯৪৩ সালে ব্রিটেনে তৈরি হয়েছিল এই যুদ্ধজাহাজ। সেই সময় নাম ছিল এইচ এম এস হারকিউলিস। ব্রিটিশ নেভির অন্যতম শক্তি। এটা তৈরিই হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য। কিন্তু যতদিনে এটা পূর্ণভাবে ব্যবহারের উপযোগী হয়ে উঠেছে, ততদিনে প্রায় যুদ্ধ শেষ। অতএব বিশেষ যে কাজে লাগল হারকিউলিস তা নয়।
সেই হারকিউলিসকে ভারত সরকার কিনে নিয়েছিল ১৯৫৭ সালে। নতুন নাম দেওয়া হয় আইএনএস বিক্রান্ত। সমস্যা হল, বিক্রান্তের বয়স হয়েছে এখন। আর কতদিন পারবে শত্রুপক্ষের মোকাবিলা করতে। অনেক কাজ করাতে হবে। অথচ সময় নেই। ক্যাপ্টেন স্বরাজ প্রকাশের সঙ্গে গতকাল দেখা হয়েছিল অ্যাডমিরাল নন্দার। নেভি চিফ। কমান্ডার কনফারেন্সের ফাঁকে আচমকা তাঁকে ডেকে নিলেন অ্যাডমিরাল। জানতে চাইলেন, বিক্রান্ত কেমন কাজ করছে? স্পষ্টভাবেই জানালেন স্বরাজ প্রকাশ যে, স্যার, আশাপ্রদ নয়। অ্যাডমিরাল নন্দা তুখোড় এক নৌসেনা প্রধান। এই বিরাট ভারতীয় নৌসেনার প্রায় প্রতিটি যুদ্ধজাহাজ আর সাবমেরিনের গতিপ্রকৃতি তাঁর নখদর্পণে। তিনি ভুরু নাচিয়ে বললেন, দ্যাট বয়লার প্রবলেম? ক্যাপ্টেন প্রকাশ বললেন, ইয়েস স্যার। নন্দা জানতে চাইলেন, এখন কত নটস? অর্থাৎ আইএনএস বিক্রান্ত কত নটস গতিতে চলছে।
ক্যাপ্টেন প্রকাশ চিন্তিত কণ্ঠে বললেন, অনলি ফোরটিন স্যার। ইট মাস্ট বি টুয়েন্টি ফোর ইউ নো!
মাথা নাড়লেন অ্যাডমিরাল নন্দা। বললেন, সি.ই কী বলছে?
প্রকাশ বললেন, অন্তত এক মাস তো বটেই।
ওহ! দ্যাটস ইমপসিবল! আমাদের হাতে অত সময় কোথায়?
স্বরাজ প্রকাশ বললেন, ইয়েস স্যার। কিন্তু কী করা উচিত? অ্যাডমিরাল নন্দা বললেন, কাল একবার টেকনিক্যাল টিমকে নিয়ে বোসো। আমাকে জানিও। পাকিস্তান ইস কুকিং সামথিং! আমাদের হাতে এতগুলো শিপ ধ্বংস নিশ্চয়ই চুপচাপ হজম করবে না। সামথিং ডার্টি মাস্ট বি ইন দেওয়ার মাইন্ড! বুঝতে পারছি না। বাট জানি না কী প্ল্যান করবে। বাট আমাদের রেডি থাকতে হবে ফর এনি কাইন্ড অব ইভেনচুয়ালিটি। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার? এতক্ষণে আরও কয়েকজন ক্যাপ্টেন আশপাশে এসে গিয়েছিলেন। হঠাৎ অ্যাডমিরালের এই উচ্চকণ্ঠের আহ্বানকে তাঁদের যেন মনে হল কমান্ড। তাই স্বভাবসিদ্ধভাবে প্রত্যেকেই চিৎকার করে উঠলেন, ইয়েস স্যার!
ক্যাপ্টেন স্বরাজ প্রকাশ তারপর থেকেই ভাবছেন কী করা উচিত। সবথেকে বড় সমস্যা ও চিন্তার বিষয় হল, পাকিস্তানের ড্যাফেন ক্লাস সাবমেরিন এতটাই উচ্চমানের যে, তাদের আক্রমণ এবং পালিয়ে যাওয়ার উভয় ক্ষমতাই অনেক শক্তিশালী। ভারতের পশ্চিমদিকে ওয়েস্টার্ন ফ্লিটে মোতায়েন থাকা দুটি সাবমেরিন আইএনএস করৌঞ্জ এবং আইএনএস কুরসুরাকে পাকিস্তানের সাবমেরিন টার্গেট করতেই পারে। ন্যাভাল ইনটেলিজেন্স বার্তা দিয়েছে আইএনএস বিক্রান্তকে ইস্টার্ন ফ্লিটে নিয়ে যাওয়া হোক। চট্টগ্রাম আর খুলনা বন্দরকে টার্গেট করা যাবে এই বিক্রান্ত থেকে। কারণ যে ৬টি এয়ারক্র্যাফটের স্কোয়াড্রন এই বিক্রান্তে মোতায়েন থাকবে, তাদের উপর দায়িত্ব রয়েছে, যে কোনও যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তৈরি হলে, চট্টগ্রাম আর খুলনার দিকে অগ্রসর হয়ে সেখানে মোতায়েন হওয়া পাকিস্তানের এয়ারক্র্যাফট কেরিয়ারে বম্বিং করতে হবে। কিন্তু সেটা তখনই সম্ভব হবে যখন আইএনএস বিক্রান্তের স্পিড বাড়বে। অন্তত ২৪ নট গতি না থাকলে এয়ারক্র্যাফট উড়তে পারবে না এই মাঝসমুদ্র থেকে। স্বরাজ প্রকাশ চিফ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে বৈঠকের জন্য বেরলেন।
....
বম্বে বন্দরের কাছে হোটেল মাইকায় দু’জন বোর্ডার একটি ঘরে বসে আছে। ১২ নভেম্বর। হোটেলে বেছে বেছে এমন একটি রুম তারা নিয়েছে, যেখান থেকে সমুদ্র দেখা যায়। বিশেষ করে বন্দরকে। সঙ্গে রয়েছে বাইনোকুলার এবং হাই ফ্রিকোয়েন্সি একটি রেডিও ট্রান্সমিটার। বড় একটা জানলা থেকে সমুদ্রে বাতাস এসে আছড়ে পড়ছে। বাইনোকুলার চোখে লাগানো লোকটির নাম রজার। কোড নেম। তার সঙ্গী ইয়ান্নি। এটাও কোড নেম। ভারতীয় নামে তারা দুজনে এই হোটেলে ঢুকেছে। আসলে দুজনেই পাকিস্তানি চর। উদ্বাস্তু সেজে ঢুকেছে ত্রিপুরায়। সেখান থেকে মেঘালয় হয়ে বম্বেতে। মেঘালয়ে তারা লক্ষ করেছে ভারতীয় সেনা একঝাঁক ক্যাম্প করেছে। নতুন ক্যাম্প বোঝা যাচ্ছে। ইস্ট পাকিস্তান থেকে আসা বাঙালি উদ্বাস্তুদের এখান থেকে রিফিউজি সংক্রান্ত কিছু কার্ড ইস্যু করা হচ্ছে। সেখানে ঢুকে এই দুই ব্যক্তি দুটি রিফিউজি কার্ড নিয়েছে। তাদের যাওয়ার কথা ছিল অসমে। কিন্তু তারা চলে এসেছে বম্বে। তাদের ওপর দায়িত্ব আইএনএস বিক্রান্তকে চিহ্নিত করা। নজরদারি করা। জানা যাচ্ছে, মাদ্রাজ থেকে আইএনএস বিক্রান্ত এখন বম্বেতেই আছে। কিছু মেরামতির জন্য। গত পাঁচদিন ধরে। চতুর্থ দিন সকালে উঠে রজার বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চমকে উঠল।
রোজ সকাল-দুপুর-রাতে তারা যে লোকেট করে রাখে আইএনএস বিক্রান্তকে। সেইমতো এনক্রিপটেড মেসেজ পাঠায় ভারতের মধ্যেই। সেই মেসেজ চলে যায় ঢাকায়। তারপর করাচি ও রাওয়ালপিন্ডিতে। এই রেডিও ট্রান্সমিটারের ফ্রিকোয়েন্সির সঙ্গে মিল রয়েছে ভারতীয় উপকূলরক্ষীর মেসেজের। তাই ভারতীয় গুপ্তচর এবং গোয়েন্দাবাহিনীর ইন্টারসেপশনে এই মেসেজ ধরা পড়লেও খুব বেশি সন্দেহজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি না হলে, সেই মেসেজ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না। কিন্তু এ কী? কোথায় গেল বিক্রান্ত! দিশাহারা হয়ে গেল এই দুই পাকিস্তানি স্পাই!
করাচির ন্যাভাল হেডকোয়ার্টারে বসে সেই সময় একইরকম টেনশনে ক্যাপ্টেন ভুমবালু। জানা যাচ্ছে না কোথায় গেল বিক্রান্ত! এই তো ছিল বম্বেতে। তাহলে? ইন্ডিয়া কি কিছু জানতে পেরেছে?
অন্যদিকে, কলকাতার ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টারে কর্মরত এক অফিসার ৩৬ ঘণ্টা ধরে কোয়ার্টারে ফিরছেন না। তাঁর নাম মেজর ধরম দেব দত্ত! তাঁকে তাঁর সহকর্মীরা সম্বোধন করেন একটি বিশেষ নামে। থ্রি ডি। থ্রি ডি একটি কাজে সাংঘাতিক পারদর্শী। যে কোনও গোপন মেসেজ ডিকোড করতে। গত একমাস ধরেই তাঁকে বলা হয়েছে আরও বেশি সতর্ক থাকতে। কারণ, পাকিস্তানের দিক থেকে কোনও একটা প্ল্যান করা হতে পারে। ভারত যেন অপ্রস্তুত না হয়। থ্রি ডি তাই অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। সত্যিই তাই। হঠাৎ গ্রুন্ডিগ টেপ রেকর্ডারে অনেক বেশি রেডিও মেসেজ এসে জড়ো হচ্ছে। মেসেজের প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে কেন? বিশেষ করে ইস্টার্ন বর্ডার থেকে পাওয়া যাচ্ছে লোকেশন। র্যাকাল আর এ ওয়ান ফিফটি রেডিও রিসিভারের নব ঘোরাচ্ছেন থ্রি ডি। পাঁচটি থেকে ছটি স্প্যানিশ শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। যেগুলো আগে কখনও শোনা যায়নি। কী মানে এসবের? থ্রি ডি বুঝতে পারছেন না। তবে করাচি এবং ঢাকার মধ্যে চালাচালি হচ্ছে এসব মেসেজ, সেটা বোঝা যাচ্ছে। ধরম দেব দত্ত হাল ছাড়ছেন না। এটাই তাঁর বৈশিষ্ট্য। তিনি সীমান্তের যুদ্ধে একটি পা হারিয়েছেন। এখন তাই নন ডিসএবেলড অফিসার হিসেবে এই ডিকোডিং সেকশনে তাঁর কাজ। তাঁর পা নেই বলে তিনি যে অপদার্থ নয়, এটা প্রমাণ করার মরিয়া প্রয়াস সর্বদাই তাঁকে উত্তেজিত করে রাখে। সুতরাং এই মেসেজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা গোপন বার্তা তিনি পাবেন না, এটা হতে পারে না। ৩৬ ঘণ্টা ধরে অফিসেই থাকছেন। ঘুম নেই চোখে।
চারদিন হয়ে গেল। আচমকা ১৩ নভেম্বর রাত সাড়ে ৯টায় একটি মেসেজ ধরা পড়ল রেডিও রিসিভারে। শেষ উচ্চারণটি রজার! রজার? এটা কয়েকদিন আগেও পাওয়া যাচ্ছে। সেনডার্স ভয়েস! তারপর হু হু করে একসঙ্গে চারটি বাক্য! এবার আলোর রেখা। বোঝা যাচ্ছে কিছুটা। খুব তাড়াতাড়ি উত্তেজিত কণ্ঠে কিছু বলতে গিয়ে স্প্যানিশ আর রাশিয়ানের মধ্যে ঢুকে পড়ছে ইন্ডিয়ান উপমহাদেশের কিছু শব্দ। তিনবার শোনার পর টের পাওয়া গেল মেসেজের অর্থ। হাসি ফুটছে মেজর ধরম দেব দত্তের মুখে। আইএনএস বিক্রান্তের কথা বলা হচ্ছে। আর একটি শব্দের অর্থ হল, মিসিং! অর্থাৎ বিক্রান্তকে কেউ খুঁজছে? কে খুঁজছে? ঢাকা থেকে করাচি মেসেজ। থ্রি ডি রিপোর্ট লিখলেন, বিক্রান্ত ইন টার্গেট! তার মধ্যেই ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল জেকবকে জানিয়েছে, আরবসাগরের উপর দিয়ে দুটি পশ্চিমী বিমান উড়ে গিয়েছে সম্প্রতি। সেটা ছবি তুলেছে কিছু। কাদের এই পশ্চিমী বিমান? কীসের ছবি তুলেছে? আইএনএস বিক্রান্তের ছবি তুলেছে তারা। পাঠিয়েছে পাকিস্তানকে। অর্থাৎ লোকেশন আইডেন্টিফাই করতে পাকিস্তানকে সাহায্য করছে একটি বিশেষ বিদেশি রাষ্ট্র! কারা তারা? কিন্তু সেই ছবি পেয়ে লাভ হল না পাকিস্তানের। কারণ, সেই ছবি পাঠানোর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই দেখা গেল বম্বে হারবার থেকে আইএনএস বিক্রান্ত উধাও! আশ্চর্য তো! রাতারাতি কোথায় গেল একটা আস্ত যুদ্ধজাহাজ!