ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
শহরের লোক অনেকেই ভাবে আদিবাসী সহ প্রান্তিক মানুষদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন সংরক্ষণ, বহু যোজনা। সুযোগসুবিধে সব বুঝি তাদেরই জন্য। অল্প পড়াশোনা করলেই চাকরি পেয়ে যায় তারা। কিন্তু শহুরে লোকজন যা জানে না তা হল, প্রান্তিক মানুষ নিজেদের সামান্যতম সুযোগ বিষয়ে আদৌ সচেতন নয়। সেগুলো পেতে গেলে কী করতে হয় সে সম্পর্কেও তাদের ধারণা নেই। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরা ‘ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার’। তবে সে প্রসঙ্গ আজ থাক। বরং আজ জঙ্গলমহলের দু’জন মহিলার জীবনসংগ্রামের কথা বলি। পাশাপাশি জানাই কিছু সংগঠনের কথা।
দুই মহিলার প্রথমজন খুকুমণি ভুঁইয়া। লালগড়ের এই মেয়েটি যখন জঙ্গলমহল থেকে কলকাতায় আসে তখন বিস্ময় আর সঙ্কোচে তার মুখের কথাই হারিয়ে গিয়েছিল। নিজেকে পুরো গুটিয়ে রাখত সে। ওর বাবা প্রান্তিক চাষি, মা গৃহবধু। বাবা, মা, দুই দিদি ও এক ভাইয়ের সংসারে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ খুকুমণির জীবনটাও ওর দিদিদের মতোই ভেসে যেত গড্ডলিকা প্রবাহে। কিন্তু তেমনটা হল না। বাধ সাধল খুকুমণির জেদ। যার জোরে সে বাড়ি এবং সমাজের প্রবল চাপকে উপেক্ষা করতে পেরেছিল। আটকে দিতে পেরেছিল নিজের বিয়ে। তবে প্রবল মনের জোরের সঙ্গে আর একটা জিনিসও খুকুমণির সহায়ক হিসেবে কাজ করেছিল— ‘বাঁচবো’ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।
এই সংস্থার সাহায্যেই খুকু নিজের পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে। পড়াশোনার জন্য কন্যাশ্রী থেকে পাওয়া পঁচিশ হাজার টাকার মধ্যে পাঁচ হাজার টাকা সে শুধুমাত্র নিজের জন্য রাখতে পেরেছিল। বাকি টাকাটা ওর বাবা মা খরচ করেছেন দুই দিদির বিয়ে এবং ভাইয়ের কলেজে ভর্তির জন্য। আর তখনই খুকুকে সাহায্য করতে উপস্থিত হন ‘বাঁচবো’ সংস্থার সম্পাদক তপন সেন। তাঁরই হাত ধরে খুকুমণি কলকাতায় আসে এবং সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এক বছরের সার্টিফায়েড নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাডভান্সড কোর্সটি করতে শুরু করে। কলকাতায় থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থাও করে দেন তপনবাবু।
এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে
হয়নি খুকুকে। ছ’মাসের থিওরি কোর্সটি শেষ করে কলকাতার নামী হাসপাতালে বাকি ছ’মাসের প্র্যাকটিক্যাল কোর্স করার সুযোগ পায় সে। সেটাও সম্পূর্ণ করে। খুকুমণি আজ ইঞ্জেকশন দেওয়া, ইসিজি করা সহ নার্সিংয়ের প্রাথমিক বিভিন্ন কাজ নিজেই করতে জানে। ওর কাজের প্রশংসাও করেছেন বহু চিকিৎসক এবং সরকারি ও বেসরকারি স্তরে কার্যরত সিনিয়র নার্সরা। বর্তমানে খুকু নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে চাকরি করছে ‘বাঁচবো’-র অধীনে প্রবীণদের স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্রটিতে। প্রকল্পটির নাম ‘হিলিং টাচ’।
গোটা পৃথিবীতেই দিনদিন বেড়ে চলেছে বয়স্ক মানুষদের সংখ্যা। যাঁদের একটি বিরাট অংশ আবার নানা ধরনের অসুস্থতার শিকার। তাঁদের ঠিকমতো দেখাশোনার করার জন্য কেউ নেই। এমন সব বয়স্ক মানুষের সঠিক দেখভালের
জন্য সবসময়েই প্রয়োজন হচ্ছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্টদের। খুকুমণির মতো মেয়ের চাহিদা তাই ক্রমবর্ধমান। করোনার পর তো এই চাহিদা আরও বেড়ে গিয়েছে। চাহিদার তুলনায় জোগান এখনও অনেক কম। তবে এই ধরনের প্রশিক্ষণ যাতে আরও বেশি সংখ্যক মেয়ের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তার জন্য সদা সচেষ্ট ‘বাঁচবো’-র মতো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো। এই কাজে তারা মূলত লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে জঙ্গলমহলের মেয়েদের। নার্সিং সংক্রান্ত নানারকম প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের রোগী সেবায় পটু করে নেওয়াই এইসব স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্দেশ্য। সামান্য একটু সাহায্যের হাতটুকুই বুঝি প্রয়োজন ছিল সমাজের পিছিয়ে পড়া মেয়েদের। সেই সাহায্যটুকু পেয়ে তা দু’হাতে গ্রহণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে তারা। দক্ষতার সঙ্গে এই কাজে পারদর্শী হয়ে উঠছে। এই সাফল্যের অন্যতম কারণ হয়তো এদের পরিশ্রমী মনোভাব, সততা, কাজের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিবেদিত মন এবং অনুগত স্বভাব। এই গুণগুলি এই ধরনের সেবামূলক কাজে ভীষণ জরুরি।
২০১৫ সাল থেকে এক বছরের সার্টিফায়েড নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট কোর্সটি জঙ্গলমহল ও সুন্দরবনের মহিলাদের করাচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি। এইসব অঞ্চলে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ যুবতীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আত্মমর্যাদার সঙ্গে স্বনির্ভর হওয়ার পথে এগিয়ে যেতেও সাহায্য করেছে। নার্সিংয়ের পাশাপাশি করোনা রোগীদের বিশেষ যত্নের জন্য ‘কোভিড কেয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট কোর্স’-টিও করানো হচ্ছে। ‘বাঁচবো’-র পাশাপাশি এইসব প্রশিক্ষণ নিতে ওদের পাশে দাঁড়িয়েছে বহু শুভানুধ্যায়ী এবং প্রবাসী বাঙালিদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘বেঙ্গল হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’।
এবার আসা যাক আর এক মেয়ের কথায়। নাম তার লক্ষ্মী। লালগড়ের কাছে জঙ্গলমহলের কুসমাসুলীর মেয়ে লক্ষ্মী সোরেন। বাবা-মাকে হারানোর পর সংসারের হাল ধরতে তার বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। দুই দিদি ও এক বোন ও ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ওদের মধ্যে ও-ই একমাত্র মাধ্যমিক পাশ। কিন্তু আর্থিক কারণে আর পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কুসমাসুলীতেই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পরিচালিত প্রেমসেবা নামের একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ করত লক্ষ্মী। কিন্তু কোনও প্রশিক্ষণ ছাড়াই। তারপর তপনবাবুর সূত্র ধরে বাঁচবো-র সঙ্গে যোগাযোগ হয় ওর। কলকাতায় আসে এবং সম্পূর্ণ বিনামূল্যে থাকা-খাওয়া সহ এক বছরের সার্টিফায়েড নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট বেসিক ট্রেনিং নেয়। ট্রেনিং শেষ করে লক্ষ্মীও বাঁচবো-র অধীনে প্রবীণদের স্বাস্থ্য পরিষেবা কেেন্দ্র কর্মরত।
আত্মসম্মান ও মর্যাদা নিয়ে কাজ করে চলেছে সে। চল্লিশোর্ধ লক্ষ্মী আজ জীবনে বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পেয়েছে। খুকুমণি আর লক্ষ্মীদের দেখার পর সুপর্ণা দেব সিংহ, উমা ভুঁইয়া, গুরুমণি হাঁসদা, সরস্বতী ভূঁইয়া, সৌরভী মাহাতো সহ বহু মেয়ে সাহস করে এগিয়ে এসেছে বাঁচবো-র হাত ধরে জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায়।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই সমস্ত ছেলে মেয়ে আজ দেখিয়ে দিয়েছে একটু সুযোগ পেলে ওরাও কিন্তু সমান দক্ষতায় কাজ করতে পারে। দক্ষতার সঙ্গে মিশেছে পেশার প্রতি দায়বদ্ধতা ও ভালোবাসা। এছাড়াও ওদের মধ্যে মানবিকতা বোধও ভরপুর। কষ্ট করে কাজ করতে হয় বলে ওরা ভয় পায় না, পিছিয়েও যায় না, বরং সাহসভরে এগিয়ে আসে। বয়স্কদের প্রতি এরা দরদী। আন্তরিকতা দিয়ে ওরা তাঁদের সেবা করতে চায়। বাঁচবো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাত ধরে এমন প্রািন্তক ও প্রত্যন্ত এলাকার মেয়েরা আজ নতুন করে বাঁচতে শিখছে। ঘরের মধ্যে বন্দি ও পরনির্ভর জীবন না কাটিয়ে তারাও স্বাদ নিচ্ছে আর্থিক স্বাবলম্বনের। যোগাযোগ: www.banchbongo.org