ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
আমার বন্ধু গোপাল মনে মনে নীতার প্রেমে পড়ে গেল। একটুও দেরি না করে গোপাল একটা চিরকুটে কালিতে ডোবানো আরশোলার মতো দুর্বোধ্য হস্তাক্ষরে লিখে ফেলল, ‘আই লাভ ইউ’! বুকপকেটে সেই চিঠি রেখে গোপাল তক্কে তক্কে আছে, সুযোগ পেলেই সে সেটা নীতার হাতে ধরিয়ে দেবে! কিন্তু একটা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া গোপালকে অকালে ‘দেবদাস’ বানিয়ে দিল!
গোপালের বোন বা দিদি নেই। কাজেই সে ভাইফোঁটার দিন বেশ বেলাতেও নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুলেই গোপাল দেখল ‘দুয়ারে নীতা’, শ্যাম্পু করা খোলা চুল, তাঁতের শাড়ি, কপালে চন্দনের টিপ! নীতার হাতে পিতলের থালায় ভাইফোঁটার ‘তত্ত্ব’! গোপালকে দেখেই নীতা চেঁচিয়ে উঠল, ‘দাদা, আমি ফোঁটা দিতে চাই!’ বিপদ বুঝে গোপাল খিড়কি দিয়ে পালানোর কথা ভাবছে। ঠিক তখনই পিছন থেকে গোপালের মা বাঁজখাই গলায় বললেন, ‘ও মা! এ যে দেখছি রেডিমেড বোন গো। ভগবান এতদিনে মুখ তুলে চাইলেন। ও গোপু, ঝপ করে চানটা করে আয় বাবা, আমি আয়োজন করি’! কিছুক্ষণের মধ্যেই গোপাল নির্ধারিত আসনে এসে পদ্মাসনে বসে পড়ল। কালবিলম্ব না করে নীতা ধূপ-দীপ-জোকার সহযোগে প্রথমে গোপালের কপালে চন্দন লেপটে দিল। তারপর নীতা পানের পাতায় প্রদীপের ধোঁয়ার তৈরি ‘হার্বাল’ কাজল ঘষে দিল গোপালের দুই চোখে।
চোখের সামনে তার ‘হলেও হতে পারত’-কে ‘সে আমার ছোট বোন’-এ রূপান্তরিত হতে দেখে গোপালের অবস্থা তখন কিশোরের সেই গানটার মতো, ‘নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে, কত কী রয়েছে লেখা কাজলে কাজলে’! অগত্যা গোপাল প্রমাদ গুনল এই ভেবে যে, এভাবে যদি পাড়ার মেয়েরা এসে তাকে ভাইফোঁটা দিয়ে চলে যায়, তাহলে সে কাকে ‘আই লাভ ইউ’ বলবে! অসহায়, বিপন্ন গোপাল প্রাণপণে একটা স্ত্রী ভূমিকাবর্জিত, কঠোরভাবে পুরুষদের জন্য সংরক্ষিত ‘আসন’ খুঁজতে শুরু করল। পেয়েও গেল। এরপর থেকে ফি বছর ভাইফোঁটার দিন গোপাল পাড়ার নরেনকাকুর সেলুনে গিয়ে বসে থাকত। তখন তো আর এখনের মতো ‘উভলিঙ্গ’ সেলুন চালু হয়নি!
ভাইফোঁটায় এই পুংলিঙ্গ স্ত্রীলিঙ্গ ব্যাপারটা প্রথম বাজারে ছেড়েছিল দেবযানীদি। কলেজে ঢুকে পলিটিক্স শুরু করার পর থেকে ওকে আমাদের পাড়ার উঠতি আঁতেল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। দেবযানীদির উপর আবার আমাদের এলাকার কাউন্সিলর সুবিনয়দার খানিক ‘সুনজর’ ছিল। তো সে সেবার ঠিক করল পাড়ায় ‘গণ ভাইফোঁটা’ পালিত হবে। ঠিক হল, মাধ্যমিকে মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া পাড়ার ছেলে আবিরকে ফোঁটা দিয়ে ওই উৎসবের উদ্বোধন করবে দেবযানীদি। কিন্তু, নারী মর্যাদার স্বার্থে নামটা ভাইফোঁটার বদলে ‘বোনফোঁটা’ করতে হবে বলে গোঁ ধরল সে। সামাজিক উৎসব অনুষ্ঠান যে দেশ কাল লিঙ্গের ঊর্ধ্বে, সেটা দেবযানীদিকে বোঝাতে ব্যর্থ হল সুশীল সমাজ। অগত্যা এলাকার বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবীদের ডেকে পাড়ায় গণকনভেনশন বসানো হল। শেষমেশ ঠিক হল, এই উৎসবের শিরোনাম হবে ‘দিদি বোনেদের মর্যাদারক্ষায় গণ ভাইফোঁটা’! দেবযানীদি-সুবিনয়দা জুটি পাড়ায় হিট করে গেল। নিন্দুকরা অবশ্য আড়ালে আবডালে এই অনুষ্ঠানের নাম দিয়েছিল ‘মাল্টি লিঙ্গ-য়াল’ ভাইফোঁটা!
আমাদের মার্কিন মহল্লায় অবশ্য ভাইফোঁটার অন্য একটা নাম দিয়েছিল ঋজু, আমাদের বন্ধুদম্পতি সুদেব-তৃষিতার ছয় বছরের ছেলে। গতবার প্রতিপদ তিথিতে, আমেরিকায় তখন ভোররাত, ঋজুর হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সে পাশের ঘরে গিয়ে দেখল, বিছানায় আধশোয়া বাবা ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। ঋজু ঝুঁকে পড়ে দেখল, স্ক্রিনে পিসিয়া একটা ল্যাম্প হাতে নিয়ে স্পিন করছে, আর বলছে, ‘বাইয়ের কোফালে ডিলাম পোটা!’ ঋজু জানতে চাইল, ‘হোয়াটস গোয়িং অন, বাবা?’ বাবা বলল, ‘ভাইফোঁটা!’ এরপর পাশের ঘরে গিয়েও ঋজু দেখল, মা-ও একটা ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। স্ক্রিনে রাঙামামা হাঁটু বেন্ড করে বসে আছে ফ্লোরে। মা আবার স্ক্রিনে রিং ফিঙ্গার দিয়ে কি একটা লাগিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘বাইয়ের কোফালে ডিলাম পোটা!’ তারপর মা স্ক্রিনে নমো করল। ঋজু জিজ্ঞেস করল, ‘হোয়াটস দিস, মা? মা বলল, ‘ভাইফোঁটা!’ ঋজু কনফিউজড, বাবার আর মায়ের ভাইফোঁটা আলাদা দেখতে লাগছে কেন! ঋজুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘সো, ইজ ইট মিছিমিছি বাইপোটা!’ একরত্তি ছেলের মুখে এই কথাটা শুনে ঋজুর মায়ের দুই চোখে কয়েকটা রুপোলি বিন্দু ফুটে উঠল, ঠিক যেমন করে রাতের আকাশে ফুটে ওঠে একে একে তারা! প্রবাস তো এমনই, সে এক দূরতর দ্বীপ!
ঋজু, এই ‘মিছিমিছি’ ভাইফোঁটা আমারও ভালো লাগে না রে! একটা রূপকথার গল্প বলি শোন। সাতটি সাগর তেরোটি নদীর পাড়ে আমার একটা দিদি থাকে। যখন দেশে ছিলাম, প্রতি বছর আমি আমার দিদির বাড়ি যেতাম ভাইফোঁটা নিতে। মাটিতে একটা আসন পেতে দিদি আমাকে বসতে দিত। আমার সামনে একটা পিতলের থালায় সাজানো থাকতো শিউলি ফুল, শিশিরে ভেজা ঘাস, লক্ষ্মীবিলাস ধান, চন্দনবাটা আর পানপাতার মায়াকাজল। পাশেই একটা শিলনোড়া, জ্বলন্ত ধূপকাঠি আর মিষ্টির থালা। দিদি নিজের হাতে একটা মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে পিলসুজের ওপর রাখত।
এই পিলসুজটা মা দিয়েছিল দিদিকে। বিয়ের পরদিন দিদি শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে, মা তখন ওই পিলসুজটা ওকে দিয়ে বলেছিল, ‘এটা রাখ, এটায় ভাইফোঁটার প্রদীপ জ্বালাবি!’ প্রতিপদে এই প্রদীপটা জ্বালিয়ে আমার ‘শোলোক-বলা কাজলাদিদি’ আমার কপালে অনামিকা ছুঁইয়ে বলত, ‘যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা..., আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা!’ শুনতে শুনতে আমার দুই চোখ দুই নদী হয়ে যেত। দিদি আমার মাথায় হাত রাখত। আর ঠিক তখনই দিদির মেঘ-করা আকাশের মতো দুই চোখে বৃষ্টি নামত। আমি ভিজে যেতাম। ঠিক যেমন করে শরতের ভোররাতে বাড়ির উঠোনে দাঁড়ালে হিম হিম শিশিরে সিক্ত হয়ে যায় সমগ্র শরীর! ঋজু, অনলাইনের ওই সব ‘মিছিমিছি’ ভাইফোঁটা কি পারবে এ সব দিতে?
কী জানি, হয়তো পারবে! সবাই তো বলে, অ্যামাজন-এ সব পাওয়া যায়! আসলে মানুষের জীবনটাই তো এখন ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি! ভাইফোঁটাও তাই।
বাই ডিফল্ট!