ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
পিয়ালী আমার প্রতিবেশী। বাজারে দোকানে, রাস্তাঘাটে দেখা হয় মাঝে মাঝেই। সেই সুবাদেই একদিন টোটোতে উঠে পিয়ালীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তোর সাইকেল কোথায়?’ উত্তরে সে বলে, ‘সাইকেল আছে ওই হাসপাতাল মোড়ে। সেখানে আমাকে নামিয়ে দিলেই হবে। বাবার ওষুধ কিনে সাইকেল নিয়ে ফিরব বাড়ি!’ একমুখ হেসে নেমে গেল। সালোয়ার কামিজ পরা মেয়েটা ক’দিন আগে এভারেস্ট জয় করতে গিয়েছিল। মাত্র ৪০০ মিটার দূর থেকে অধরা এভারেস্ট রেখে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল সে। তাও অর্থাভাবে। চন্দননগরের বহু মানুষের সক্রিয় সহযোগিতায় মেয়েটি এভারেস্ট অভিযানে গিয়েছিল। কিন্তু নেপালে বসে থাকতে হয়েছিল অনেকদিন। টাকার অভাব। তবু স্বপ্ন তো অভাব মানে না। মাথার ভেতরে তেনজিং নোরগের লড়াই। মাথার ভেতরে বরফ পাহাড় ডিঙোনোর নড়াচড়া তাকে স্থির থাকতে দেয় না কিছুতেই। উচ্চতা জয়ের তীব্র তাড়না তাড়া করে বেড়ায় পিয়ালীকে। মেয়েটার হাসিমাখা মুখ দেখলে কিন্তু জয়ের এই অদম্য ইচ্ছের কথা কিছুই বোঝা যায় না! বোঝা যায় না কত বড় চ্যালেঞ্জ নিজের সামনে নিজেই ছুঁড়ে দেয় সে প্রতিনিয়ত।
চন্দননগরের কানাইলাল স্কুলের প্রাথমিক বিভাগের শিক্ষিকা পিয়ালী বসাক। বোন তমালি একটি ছোট বেসরকারি পলিক্লিনিকে কাজ করে। বাবা বিভিন্ন রোগে শয্যাশায়ী। মা আছেন শত অভাবের লড়াইয়ে অতন্দ্র প্রহরী। চন্দননগর মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের অঙ্গনে পিয়ালী ছোট থেকে দেখেছে পাহাড়প্রেমী কিছু মানুষের অদম্য লড়াই। রক ক্লাইম্বিং ক্যাম্প, সিএমএ-এর আর্টিফিশিয়াল ওয়ালে শুরু পিয়ালীর ট্রেনিং। চন্দননগরের বাতাসে পাহাড়-পাহাড় গন্ধ উড়াউড়ি করার একটা ঐতিহ্য আছে। পিয়ালী সেই ঐতিহ্যের বাহক হিসেবে রক্তের ভেতরে নিয়েছে শৃঙ্গ জয়ের নেশা। ছ’বছর বয়সের মেয়ে যখন মায়ের শাড়ি জড়িয়ে খেলনাবাটি খেলে, পিয়ালী তখন থেকেই চিনেছে পাহাড়ের পথ। ক্যাম্প, টেন্ট, ক্লাইম্বিং, ওয়াল, রকফেস, রোপ, রোপফিক্স, ইত্যাদি নানা শব্দ শুনেছে সে ছোট থেকে। মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবে দেখছে স্লাইড শো। শৃঙ্গ জয়ের রোমহর্ষক গল্প শুনছে বড়দের মুখে।
আর এইভাবেই হিমালয়ান ইন্সস্টিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং-এর বেসিক ও অ্যাডভ্যান্স ট্রেনিং দু’টিও করে ফেলে পিয়ালী। মাথায় তখন অলক্ষ্যে হাত রেখেছেন তেনজিং নোরগে। পিয়ালীর পাহাড়-দেবতা।
২০১০ সাল থেকে পিয়ালী শুরু করেছে বরফশৃঙ্গে পদচারণা। পাঁচটি ছ’হাজার উচ্চতার পর্বতশৃঙ্গ জয় করেছে সে পরের সাত বছরে। ২০১৮ সালে প্রস্তুতি নেয় মানাসলু পর্বতশৃঙ্গ, যাকে আত্মার পর্বত বলা হয়, তা জয় করার। কিন্তু টাকার জোগাড়? নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের তা যে বড়ই বালাই। ততদিনে সে প্রাইমারি শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছে স্থানীয় নামকরা স্কুল কানাইলাল বিদ্যামন্দিরে। পার্সোনাল লোন নেয় ৮ লাখ টাকা। কিছু মানুষ এগিয়ে আসে সাহায্যে। সেইভাবেই হয় সে যাত্রার অর্থ জোগাড়। মানালসু পর্বতশৃঙ্গ ৮,১৬৫ মিটার মানে ২৬,৭৫৮ ফুট। পিয়ালী এগিয়ে চলল। অর্থকষ্ট ছাড়াও ছিল আন্ডারওয়েট হওয়ার সমস্যা। তবু পিয়ালী লোন নিয়ে একাই চলে গেল পাহাড়ে চড়তে এবং সমস্ত বাধা জয় করে ফিরেও এল। মুখে সেই অনাবিল হাসি। এই অসম্ভব জয়ের পরেও জীবন কিন্তু বদলায়নি একফোঁটা। শুধু রাজ্য সরকারের ক্রীড়া দপ্তর থেকে স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছিল ‘ছন্দা গায়েন সাহসিকতা পুরস্কার’। এখনও তাই সাইকেলে ঘুরে বেড়ায় সে রোদে-জলে। এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন ছিল ছোট থেকেই। সেই স্বপ্ন নিয়েই এভারেস্ট জয়ের জন্যে এগলেন পিয়ালী। চন্দননগরের মানুষও এগিয়ে এল তার সাহায্যে। ক্রাউড ফান্ডিং-এ উঠল প্রায় সাড়ে আট লাখ টাকা। খরচ ১৯ লক্ষ টাকা। আবার লোন বাকি ১১ লক্ষ টাকার জন্য। অল্প মাইনের চাকরি। ইএমআই সামলে হাতে থাকে না কিছুই। ইতিমধ্যে বাবাও অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার খরচে তখন জেরবার অবস্থা পিয়ালী ও তার পরিবারের। তবু পাহাড় জয়ের নেশা পিছু ছাড়ে না তাকে। এইভাবে যদি কোনও ভালো চাকরির অফার আসে! যদি আসে কোনও কোম্পানির স্পনসরশিপের অর্থ। তাই তো পিয়ালী ঝাঁপিয়ে পড়ল এভারেস্ট জয়ের নেশায়। কিন্তু শেষরক্ষা হল কই? মাত্র ৪০০ মিটার দূর থেকে ফিরে আসতে হল তাকে। পিয়ালীর কথায়, ‘আমাকে জয় করতে দেওয়া হয়নি।’ পাহাড়ের উপরের গল্প বরফকঠিন। শীতল। সেখানে কোনও ফুলের কোমলতা নেই। আছে হিংস্র ঈর্ষার ঠান্ডা স্রোত। কিন্তু হার মানলে চলে? তাই তো ২০২১-এর দেবীপক্ষে পৃথিবীর সপ্তম উচ্চতম ধৌলাগিরি শৃঙ্গ সাহায্যকারী অক্সিজেন ছাড়াই জয় করে ফিরে এল ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা পর্বতারোহী পিয়ালী বসাক। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোর মাথার উপর এই ধৌলাগিরি জয়ের পর লোনের পাহাড় তো চেপে বসল! শোধ করবি কী করে?’
স্বল্পবাক লাজুক মেয়েটা শূন্যে তাকায়, ‘জানি না! ধৌলাগিরির এজেন্সির টাকা দেওয়া হয়নি এখনও, বাকি আছে শেরপার ক্লাইম্বিংয়ের টাকা, বেস ক্যাম্পের টিপসের টাকাও।’ তবু আশাবাদী পিয়ালী বসাক। বলল, ‘আবার যাব। দেখা যাক, নিশ্চয়ই একদিন জিতে নেব সবকিছু... পাহাড়কে আমি সব দিয়েছি, পাহাড় নিশ্চয়ই আমাকে ঠকাবে না... ফিরিয়ে দেবে কিছু না কিছু।’ তারপর একটু থেমে আবারও বলে, ‘ইচ্ছে আছে অক্সিজেন ছাড়াই এভারেস্ট জয় করার!’
দুর্গম জয় করে ফিরে আসা দুর্গাদের কবে আমরা বোধন করব প্রকৃতভাবে? কবে বাধা অতিক্রমের অস্ত্র তুলে দেব তাদের হাতে?