ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
কলেজে পড়ান অনুরাধা সমাদ্দার। পড়াশোনা, চাকরি আর গবেষণা নিয়েই ব্যস্ত তিনি। আর তারই ফাঁকে সময় বয়ে গিয়েছে। বিয়েটা আর করা হয়নি। তাই বলে সংসার যে তাঁর নেই এমনটা যেন ভেবে বসবেন না। সত্যি বলতে কী, অনেক বিবাহিত মহিলার চেয়েও বেশি সংসারী অনুরাধা। পড়াশোনা আর চাকরি ছাড়াও মায়ের দায়িত্ব নেওয়া, বাড়ির টুকিটাকি বাজার দোকান, ফাইফরমাশ সামলানো, দস্যি ভাইপোর আবদার মেটানো এমন বিভিন্ন সাংসারিক কাজে তিনি মগ্ন থাকেন। বাপের বাড়ি ছেড়ে নিজের নামে ফ্ল্যাটও কিনেছেন লোন নিয়ে। আর সেই লোন নিতে গিয়েই প্রথম বিপত্তিটা ঘটেছিল। অনুরাধা যে একমেবদ্বিতীয়ম, মহিলা হয়েও তিনিই যে বাড়ির কর্তামশাই, এই সহজ সত্যটা মোটেও মেনে নিতে পারেননি স্টেট ব্যাঙ্কের জনৈক ম্যানেজার। তিনি লোনের চিঠিখানা তৈরি করে ফেললেন অনিরুদ্ধ সমাদ্দার-এর নামে। বোঝো কাণ্ড! অনুরাধার তো লোন স্যাংশনের চিঠি পেয়ে মাথায় হাত। এই নামে তো কোনও ব্যক্তিই নেই। তাঁর যাবতীয় নথিপত্র দেখে এবং যাচাই করে ব্যাঙ্ক হঠাৎ এমন মনগড়া একটা নাম স্থির করলই বা কেমন করে? বিরক্তিসূচক এহেন প্রশ্নের মুখে পড়ে একটু ঘাবড়ে গেলেন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার। তারপর আমতা আমতা করে বললেন, ওটা নাকি অভ্যাসের বশে হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, এখন অনেকেই জয়েন্ট লোন নেন বটে কিন্তু বাড়ি বা গাড়ির জন্য লোন নিতে হলে এখনও ফার্স্ট অ্যাপ্লিক্যান্ট সাধারণত পুরুষই হন। তাই অভ্যাসের বসেই তিনি অনুরাধার বদলে অনিরুদ্ধ পড়েছেন। তারপর অবশ্যই প্রভূত দুঃখপ্রকাশও করেন এবং এই ভুল যে সম্পূর্ণই অনিচ্ছাকৃত তাও বিস্তারে জানান। কিন্তু অনুরাধাকে আবারও ফ্রেশ লোনের জন্য দরখাস্ত করে তবেই অনুমোদন পেতে হয়েছিল। তবে ব্যাঙ্কের এই ‘অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি’-র কারণে দ্বিতীয় খেপে গোটা ব্যাপারটাই যে প্রচণ্ড ত্বরান্বিত হয়েছিল তা বলাই বাহুল্য। সাময়িক বিরক্তি এবং কিছু টানাপোড়েনের পর সব কাজ যথাযথভাবে মিটে গেলে রাগও নিজের নিয়মে একদিন পড়ে গেল। এখন অনুরাধার কাছে এই ঘটনা নিছকই মজার স্মৃতি।
গল্পটা একদিন কলেজ বন্ধুদের আড্ডায় বসে বেশ রসিয়েই বলছিলেন অনুরাধা। পাশ থেকে তাঁরই আর এক বান্ধবী বলে উঠলেন, ‘আরে এমন গপ্প তো আমার জীবনে প্রচুর আছে।’ বাকিরা স্বভাবতই বিস্মিত। এমন ঘটনা হামেশাই ঘটে— এ আবার কেমন ধারা কথা? ভদ্রমহিলা এবার তাঁর মজার গল্পের ডালি খুলে বসলেন। তাঁর নিজের নাম সুমন চৌধুরি। সুমন নামটা বড় গোলমেলে। পুরুষ নারীর বিভেদ নেই এই নামে। অতএব লিঙ্গ পক্ষপাতের নাকি পরিসরই নেই। অথচ তাঁর নামের আগে অবলীলায় ‘মিস্টার’ বসিয়ে দেওয়া হয়। এবং এই যে মিস্টার বনাম মিস-এর লড়াই তা নাকি বহু বছর ধরেই চলেছে তো চলেছেই। আড্ডায় হাসির রোল উঠল। সুমন বললেন, হাসি পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এতবার এই মিস্টার আর মিস-এর লড়াই সামলাতে হয়েছে যে এখন আর এতে হাসি পায় না। বরং ক্লান্ত লাগে। এটা নাকি তাঁর কাছে রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং প্রতিবারই সাময়িক অসুবিধার সৃষ্টি হয়, তাই আজকাল ক্লান্ত তো বটেই বিরক্তও লাগে একটু। একটা ঘটনার উল্লেখ করলেন সুমন। বললেন, ‘আমি তখন চাকরি বদল করব বলে হন্যে হয়ে উঠেছিলাম। কেরিয়ারের মাঝখানে এসে চাকরি বদল নেহাতও সহজ নয়। প্রোফাইল ম্যাচ করানো, স্যালারি হাইক চাওয়া সব কিছুই বেশ হিসেব কষে করতে হয়। ফলে সময়ও লাগে প্রচুর। এমন সময় একটা চাকরি আমার জুটেও গিয়েছিল কপালে। উত্তেজিত হয়ে ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। আর পৌঁছেই বিপত্তি!’ তাঁকে সামনাসামনি দেখে কর্মকর্তাদের মুখগুলো কেমন যেন পানসে মেরে গেল। তাঁরা খানিক ঢোক গিলে বললেন, ‘ওহ! আপনি সুমন চৌধুরি? আমরা আসলে অন্য কাউকে এক্সপেক্ট করেছিলাম।’ প্রথমে তো সুমন বুঝতেই পারেননি এই ‘অন্য কাউকে এক্সপেক্ট’ করার মানে। তারপর একটু ভাবতেই স্পষ্ট হয়ে গেল— সেই একই মিস্টার ও মিস-এর দ্বন্দ্বে পড়েছেন ইন্টারভিউ বোর্ডের সকলেই। যাই হোক, কথাবার্তা এগনোর পর চাকরিটা অবশ্য সুমনের পেতে কোনও অসুবিধে হয়নি। আড্ডায় এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। ‘যাক, জেন্ডার বায়াসের ফলে তোর কেরিয়ারের কোনও ক্ষতি তো হয়নি বল?’ প্রশ্ন করলেন সুমনের বন্ধু অর্ক। গম্ভীরভাবে সুমন জবাব দিলেন, ‘সে যাত্রা হয়নি ঠিকই, কিন্তু এই জেন্ডার বায়াস যে কী মারাত্মক হতে পারে তা বুঝেছিলাম একবার গাড়ির লোন নিতে গিয়ে। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার আমার ছবি দেখেও মানতে চাইছিলেন না যে আমি মহিলা! লোন মোটামুটি বাতিলই হতে বসেছিল। বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়েও সেই ব্যাঙ্ক থেকে লোন পাইনি। অন্য ব্যাঙ্কে নতুন দরখাস্ত জমা দিয়েছিলাম।’
আশ্চর্যই বটে! এযুগেও এমন হয়? প্রশ্ন শুনে অনুরাধার কলেজের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপিকা সুপর্ণা চক্রবর্তী বলেন, ‘এর জন্য বহুলাংশেই আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দায়ী। সেখানে পুরুষের স্থান সদাসর্বদা মহিলাদের ওপরে। সামাজিক সম্মানও পুরুষেরই বেশি। ফলে তাঁরাই সমাজ ও সংসারের ধারক ও বাহক। তাঁরাই সংসারের কর্তা। যাবতীয় অফিশিয়াল কাজকর্মে তাদেরই নাম থাকবে এটাই সমাজের কাছে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছে। আর সেই ধারণা ভাঙতে গিয়েই যত বিপত্তির মুখোমুখি হতে হয় মেয়েদের।’ এরপর একটু যেন সমাজের পক্ষেই সুর টেনে সুপর্ণা বললেন, ‘মেয়েদের এই যে স্বনির্ভরতা তা তো খুব বেশি দিনের নয়। ফলে তাঁদের একক কর্তৃত্ব তাও খুবই নতুন। সমাজ যে এখনও তাতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি তা তো খুব একটা অস্বাভাবিকও নয়। বড় চিত্রটা যদি কল্পনা করেন, তাহলে দেখবেন, সাধারণভাবে এখনও কিন্তু পুরুষেরই আধিপত্য লক্ষ করা যায়। এবং এই আধিপত্য মেয়েদের বিপুল স্বনির্ভরতা সত্ত্বেও বজায় রয়েছে। আর মেয়েরাও তাতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। ফলে সমাজের দিকে সব সময় আঙুল না তুলে বরং মেয়েদেরও মানসিকতায় বদল আনা দরকার তাই না?’
সুপর্ণার কথার সঙ্গে একেবারেই সহমত পোষণ করলেন না হিউম্যান রাইটস বিভাগের অধ্যাপিকা সুলগ্না মজুমদার। তাঁর কথায়, মেয়েদের দিকে আঙুল তোলা সহজ তাই তাদেরই সমালোচনা করা হয় সবসময়। কিন্তু স্বনির্ভরতার স্বাদ পেয়ে মেয়েরাও এখন মনেপ্রাণে স্বাধীন। ফলে তাঁদের মানসিকতার বদল দরকার, বা তাঁরাই নিজেদের অগ্রগতির ক্ষেত্রে পরিপন্থী— এমন মন্তব্য না করাই ভালো। বরং মেয়েদের মনোভাবের দিকে আঙুল তোলার আগে সমাজ একটু ভাবুক পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি কতটা এবং কীভাবে বদলানো যায়। এই প্রসঙ্গে সুলগ্না বললেন, ‘বাসে লেডিস সিট রাখা হবে কি না এই নিয়ে একসময় আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মাথাব্যথার শেষ ছিল না। মেয়েরা অগ্রগতির ঝান্ডা ওড়াবে এদিকে সবরকম সুবিধে ভোগ করবে তা কেমন করে সম্ভব? এই নিয়ে সমালোচনার ঝড় তুলতেও পিছপা হয়নি আমাদের সমাজ। পুরুষতান্ত্রিকতার ও তার দৃষ্টিভঙ্গি বা মতবাদের কোনও বদল হয়নি। অথচ সময় বদলে যাচ্ছে। আর সেই বদলের হাওয়া মেয়েদের গায়ে লেগেছে। তাঁরা তাই একাই রোজগেরে, স্বনির্ভর, সংসার সামলান তাও একা। আবার এখন তো অনেক মহিলা একা একাই মাতৃত্বও গ্রহণ করছেন। মেয়েদের এমন মানসিক অগ্রগতির সঙ্গে তাল রাখতে না পেরেই পুরুষতন্ত্র তাঁদের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে।’
আলোচনা ও সমালোচনার মাঝে অনুরাধাদের আড্ডাও বেশ জমে উঠেছে। হাসি গল্পের শেষ পর্যায় অনুরাধা নিজের জীবনের আর একটি এমনই হাস্যকর অভিজ্ঞতা বলতে শুরু করলেন। ‘আমাদের বাড়ির রান্নাঘরটা বেশি বড় নয়। আধুনিক ফ্ল্যাট বাড়িতে যেমনটা হয় আর কি। তাই রান্নার ধোঁয়া এড়াতে চিমনি ছাড়া গতি নেই। বহুদিন সার্ভিস দিয়ে পুরনো চিমনিটা যখন দেহ রাখল তখন আবারও একটি নাম করা চিমনি কোম্পানির দ্বারস্থ হলাম নতুন চিমনির খোঁজে। দর-দস্তুর, ডিজাইন পছন্দ ইত্যাদি সবই হয়ে গেল। এমনকী কেনার পালাও শেষ। ডেলিভারি পর্ব মিটলে এবার ইনস্টলেশন। চিমনি লাগাতে লোক আসবে আমার বাড়ি। একজন ফোন করলেন সেই মর্মে। প্রাথমিক কথার পর প্রশ্ন করলেন চিমনি লাগাতে যখন তিনি আসবেন তখন বাড়িতে ‘স্যার’ থাকবেন তো? আমি একটু অবাকই হলাম। বললাম, স্যার কেন? আমিই থাকব চিমনি লাগানোর সময়। ফোনের ওপারে খানিক নীরবতা। তারপর আবারও সেই একই প্রশ্ন ‘স্যার’ থাকবেন তো? আবারও তাঁকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম। আমিই থাকব। চিমনি লাগাতে কোনও অসুবিধে হবে না। কিন্তু তিনি নাছোড়। বারংবার স্যার-এর প্রসঙ্গ টেনে আনছেন কথোপকথনের মধ্যে। শেষে আমি একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, এ বাড়িতে আমিই ‘স্যার’। এবার ভদ্রলোকটি রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে ফোন ছেড়ে দিলেন। ব্যস, ওই শেষ। আমার রান্নাঘরে চিমনিটা কিন্তু আজও বাক্সবন্দি যেমনকার তেমনই পড়ে রয়েছে। সামান্য একজন ‘স্যার’ না থাকায় চিমনির মোড়ক এখনও খোলা হয়নি!’