ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
শুরুর কথা
ছোটবেলা থেকেই নাটক এবং অভিনয় নিয়ে আগ্রহ ছিল মিঠুর। তিনি এই বিষয়টি নিয়ে পড়াশোনাও করেন প্রচুর। গবেষণার সময় থেকেই মহিলাদের নিয়ে কাজ করার আগ্রহটা ক্রমশ দানা বাঁধতে শুরু করে তাঁর মনে। ততদিনে দেশের তো বটেই বিদেশের বিভিন্ন নাটক ও থিয়েটার নিয়েও প্রচুর পড়াশোনা করে ফেলেছেন তিনি। এবং জেনেছেন সেখানে কীভাবে কাজ হয়। বিস্ময়ের যে, আমাদের যাত্রাপালার সঙ্গে কিন্তু বিদেশি এলিজাবেথান থিয়েটারের প্রচুর মিল। পুরুষ অভিনেতাদের দিয়ে মহিলাদের চরিত্রে অভিনয় করানো থেকে শুরু করে মেকশিফট স্টেজ বাঁধা— সবই ওই এলিজাবেথান থিয়েটারের কায়দায় করা হতো আমাদের দেশের যাত্রাপালায়। কিন্তু সময় যতই এগিয়েছে, ততই বদলেছে চিন্তাধারা। আধুনিক হয়েছে জীবনযাপন। পুরুষতন্ত্রের দাপট কাটিয়ে উঠে এসেছে নারীবাদ। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তো মহিলাদের ক্ষমতায়ন নিয়েও প্রচুর লেখালিখি, আলোচনাচক্র চলে। অথচ নাটক বা অভিনয়ের ক্ষেত্রে যে কে সেই! আজও পুরুষ পরিচালকদের আধিপত্য লক্ষ্যণীয়। সেই গতানুগতিক প্রথাকেই ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন মিঠু। আর সেই নিয়েই তিনি কাজ শুরু করেন।
দশ বছরের প্রচেষ্টা
আমাদের দেশের বিভিন্ন শহরে তো বটেই, এমনকী গ্রামেগঞ্জে ঘুরেও মিঠু দেখেছেন যে বহু মহিলা নাটক লেখেন এবং নিজস্ব ছোট গণ্ডিতে তা পরিচালনাও করেন। তবু পুরুষতন্ত্রের চাপে তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সাহস পায় না। মহিলারা খ্যাতির আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন না, বরং অন্ধকারেই থেকে যান। সেই অন্ধকার থেকেই মেয়েদের কাজগুলোকে আলোয় তুলে ধরার চেষ্টা করছেন মিঠু দে। তার জন্য বিভিন্ন আলোচনাসভা এবং কর্মশালারও আয়োজন করেন তিনি। তাতেও নারীকেন্দ্রিক সমস্যার কথাই তিনি তুলে ধরেন। সেখানে যে শুধুই মহিলা নাট্যকর্মী বা নাট্যকার অথবা পরিচালকদের কথা বলেন তা নয়। সেখানে নারীর নানা প্রচেষ্টার কথা আলোচনা করা হয়। মেয়েদের উন্নতির দিশার খোঁজ করা হয়। এবং সেই খোঁজের মাধ্যমেই মেয়েদের নাট্যদলের কথা মাথায় আসে তাঁর। ‘নাটক বা থিয়েটারের গণ্ডিটাই বড্ড ছোট’, বললেন মিঠু। ‘তার মধ্যে আবার মেয়েরা আরও ছোট একটা অংশে বাস করে। ফলে সেখান থেকে প্রচারের আলোয় পৌঁছনো মেয়েদের পক্ষে বেশ কঠিন।’ সেই চেষ্টাটাই তিনি আপ্রাণ করে চলেছেন।
দেশের গণ্ডিতে কাজ
আপাতত দেশের মেয়েদের নিয়েই কাজ করছেন মিঠু। নাট্যজগতের নানা মহিলা পরিচালক— যাঁদের নাটক লেখা ও সেই নাটক অভিনয় করানোই অন্যতম স্বপ্ন। তাঁদের কেউ কেউ হয়তো খুবই অল্পবয়সি। কারও মাত্র উনিশ-কুড়ি বছর বয়স, পড়াশোনা করছেন। কিন্তু তারই ফাঁকে নিজের নেশা বা প্যাশনটাকেও জিইয়ে রাখতে ব্যস্ত। তাঁরা নিজেদের পাঠ্যক্রম এবং পারিপার্শ্বিক সমাজের ভিতরই নাটকের প্লট খুঁজে পান। সেই নাটক আমাদের সমাজজীবনের কথা বলে। সেখানে মেয়েদের বিভিন্ন সমস্যা বা ভালোলাগার কথা বলে। আর সেই ধরনের মহিলা পরিচালকদের প্রচারের আলোয় নিয়ে আসার কাজটাই করেন মিঠু। তাঁর মতে, কলকাতায় যে কাজটা হয় মহিলা নাট্যকর্মীদের নিয়ে তার থেকে নিজের কাজ নাকি ভিন্ন। কীভাবে? না, কলকাতার প্রচারিত মুখগুলোর বাইরেও যে অন্য মহিলারা আছেন যাঁরা কেউ শখে, কেউ ভালোবাসায় আবার কেউ বা পেশাগতভাবে নাটক লেখেন ও অভিনয় করেন তাঁদের প্রচারের আলোয় নিয়ে আসাই মিঠুর কাজ। যাঁরা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মিডিয়ার দৌলতে প্রচার পেয়ে গিয়েছেন তাঁদের কথা আর নতুন করে বলা অমূলক বলে মনে করেন মিঠু। তাই তিনি এমন মহিলাদের নিয়ে কাজ করেন যাঁদের নাটক প্রচার পেলে হয়তো আমাদের দেশের সংস্কৃতি আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। এমন অনেক কাজ আছে যা আন্তর্জাতিক মান ছুঁতে পারে না শুধু প্রচারের অভাবে। সেই কাজগুলো যদি আমাদের শহুরে সমাজের সামনেও তুলে আনা যায় তাহলেও অনেকখানি সাহায্য হবে বলে মনে করেন মিঠু দে।
বিষয় নিয়ে আলোচনা
একটা নারীকেন্দ্রিক নাটক নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মিঠু বললেন, মেয়েদের এই যে জীবনযাপন, তার ভিতরেই নাটকের রসদ লুকিয়ে রয়েছে। পুজোর ঠিক আগেই সেই নাটকগুলো নিয়ে একটা উৎসবের আয়োজন করেছিলেন মিঠু। তার মধ্যে একটা নাটক ছিল জরায়ু। মহিলাদের সন্তানধারণ ও পালনের মধ্যে যে তুমুল সংগ্রাম রয়েছে সেই নিয়ে নাটক। বাচ্চা জন্মানোর পর সে বাবার পদবি ধারণ করে। পিতৃপরিচয়ে পরিচিত হয়ে ওঠে। কিন্তু মা যে ন’মাস ধরে সন্তানকে নিজের শরীরের সর্বস্ব দিয়ে লালন করেন সেকথা তো কই কেউ বলে না! মায়ের সেই লালন করার কথাই তুলে ধরা হয়েছে এই নাটকে। সেখানে বলা হয়েছে বাবা অবশ্যই সন্তানের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাঁর পরিচয় না থাকলে একটা বাচ্চাকে হেনস্তা করা হবে কেন? মা কি সন্তানের পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নন? বিদেশে যেমন সিঙ্গল মাদার এখন একটা সহজ বিষয় হয়ে উঠেছে, তেমনই আমাদের দেশেও তা হবে না কেন?
আবার পাশাপাশি প্রকৃতির সঙ্গে এক মহিলার প্রেমের গল্পও উঠে এসেছে নারীকেন্দ্রিক নাটকের বিষয় হয়ে। সামাজিক নাটকের ক্ষেত্রে করোনাকালে মেয়েদের জীবনসংগ্রামের বিষয় নিয়ে নাটক তৈরি হয়েছে। এই নাটকটি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রী মিলে লিখে অভিনয় করেছেন। ‘তাঁদের কাজের নিষ্ঠা এবং ভাবনার গভীরতা দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়’, বললেন মিঠু। আবার তারই সঙ্গে একেবারে ভিন্নধর্মী গল্প নিয়ে একটি নাটক, টেলিস্কোপও রাখা হয়েছিল। এটি এক ছোট মেয়ের জীবন নিয়ে লেখা। আঠারো বছর পেরিয়ে গেলে গ্রামাঞ্চলে অনেক মেয়েরই পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাদের বিয়ে দিয়ে দেন বাবা-মা। শহরে হয়তো চিত্রটা অন্য, কিন্তু আজও সর্বত্র কন্যা ‘দায়’ হিসেবেই বিবেচিত। মেয়েদের জন্মলগ্ন থেকেই বাবা-মা তার বিয়ের চিন্তা করেন। কিন্তু পুত্রের বেলায় তো তেমনটা হয় না! নারীজীবনের এই ধরনের টুকরো টুকরো ওঠাপড়াকেই নাটকের বিষয় হিসেবে বাছা হয়েছে। এই নাট্যোৎসব তাই নানা ধরনের স্বাদের নাটকে সমৃদ্ধ ছিল। সমাজের পাশাপাশি মেয়েদের মনোভাব, তাদের সংগ্রাম সবই তুলে ধরা হয়েছে নাটকে।
আগামী বছর বাংলাদেশ, ত্রিপুরা, অসম এই তিন জায়গার মেয়েদের নিয়ে নাটক করার ইচ্ছে রয়েছে মিঠুর। তিনি মনে করেন শহুরে মানুষদের চিন্তাধারা কোথাও কিছুটা বদলেছে ঠিকই, তবু এখনও মেয়েদের বিস্তর পথ চলা বাকি। নারীস্বাধীনতার জন্য তাই নিজের স্বপ্নগুলোকে লালন করে চলেছেন মিঠু। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস মেয়েরাও একদিন জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নেবে।