ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
সন্দীপন বিশ্বাস: ছেলেবেলায় মনোরমাদিকে দেখে খুব ভয় পেতাম। মুখের একদিকটা পোড়া, চামড়া কুঁচকে চোখের অনেকটা বেরিয়ে এসেছে। গলার কাছেও চামড়া দলা পাকানো নারকোল দড়ির মতো। বিয়ের সময় অমন সুন্দর মনোরমাদি একদিন শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে এসেছিল বীভৎস পোড়া মুখ নিয়ে। শুনেছিলাম পণের জন্য স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি মিলে দিদিকে পুড়িয়ে মারতে গিয়েছিল। শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসার পর তার দাদাও বাড়িতে বেশিদিন আশ্রয় দেয়নি। মনোরমাদি কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল। অনেক পরে একদিন কলেজে যাওয়ার সময় মনোরমাদিকে দেখেছিলাম শিয়ালদহ স্টেশনের বাইরে ফুল বেচতে। মুখের পোড়া জায়গা কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছে। আমি তখন বড় হয়েছি। পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, ‘মনোরমাদি চিনতে পারছ?’ মুখ তুলে দিদি বিস্ময়ে তাকিয়েছিল। মুখেচোখে না চেনার ভাব। আমি বলেছিলাম, ‘দেখো আমি বিশু।’ বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া মনোরমাদির মুখে দেখেছিলাম ফুলের মতো হাসি।
আমাদের পাশের বাড়িতে থাকত বিজয়া। ছেলেবেলায় একসঙ্গে আমরা সবাই চোর-পুলিস খেলতাম। একটু বড় হয়ে একদিন বিজয়া বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল এক বন্ধুর সঙ্গে। প্রায় দু’মাস নিখোঁজ থাকার পর একদিন বিজয়াকে পাওয়া গেল। তবে জীবিত নয়, মৃত। বর্ধমানে কোনও এক ক্যানেলের ধারে তার দেহ উদ্ধার হয়েছিল। জানা গিয়েছিল, যাকে ভালোবেসে অনেক স্বপ্ন নিয়ে সে ঘর ছেড়েছিল, সে তাকে নিয়ে ব্যবসা করতে চেয়েছিল। বিক্রি করে দিতে চেয়েছিল। প্রতিবাদ করায় বিজয়াকে মেরে ফেলা হয়।
ছোট্ট পাঁচ বছরের ফুটফুটে ফুলের মতো মেয়েটা খুব চঞ্চল। পাশের বাড়ির অনিলকাকু তাকে খুব ভালোবাসে। একদিন সেই অনিলকাকু পাঁচ বছরের কন্যাসম মেয়েটিকে একা পেয়ে ধর্ষণ করল। শিশুটি কিছুই বোঝেনি, শুধু কয়েকটা দিন হাসপাতালে মরণপণ লড়াই করে ফিরে এসেছিল। অনিলকাকুর কপালে গণপিটুনি আর জেল হলেও ওই পাঁচ বছরের মেয়েটি সারাজীবন কোন দুঃস্বপ্নের স্মৃতি আর আতঙ্ক নিয়ে বেঁচে ছিল, তার খবর আমরা রাখিনি।
এমন অজস্র লাঞ্ছনা আজও আমাদের সমাজে ঘটে চলেছে। পুরাণে, মহাকাব্যে পৌরুষ কিংবা আধিপত্য প্রকাশ করতে নারীত্বের লাঞ্চনার যে ছবি ফুটে ওঠে, সেই ঘটনা আমরা দেখেছি প্রাচীন কিংবা মধ্যযুগেও। দেখেছি আধুনিক যুগের উন্নততর প্রেক্ষাপটে। নারী যেন পণ্য কিংবা দাস। রামায়ণে যখন লক্ষ্মণ শূর্পনখার নাক কেটে দেন, সেও এক নারী অবমাননা কিংবা সীতাকে যখন বনবাসে যেতে হয় অথবা অপমানে পাতাল প্রবেশ করতে হয়, তখন সেটাকেও নারীত্বের অবমাননা বলে আমরা মনে করতে পারি। মধ্যযুগে লাঞ্ছনা চরমে উঠেছিল। দেবদাসী প্রথার কথা আমরা জানি। ধর্মের অজুহাতে তাকে যৌনদাসী করে রাখার একটা প্রক্রিয়ামাত্র। সময় বদলালেও মেয়েদের অবমাননা বদলে যায়নি। আজও উত্তরপ্রদেশ, বিহারের বহু গ্রামে কন্যাসন্তান হলে কোথাও কোথাও জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই তাকে মেরে ফেলা হয়। শহরের শিক্ষিতদের মধ্যেও সেই মানসিকতা দেখা যায়। ভ্রুণ নির্ণয়ের পর যদি দেখা যায় কন্যাসন্তান, তাহলে জোর করে গর্ভপাতের ঘটনা ঘটানো হয়। বহুক্ষেত্রে মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও এই কাজ করানো হয়।
সুতরাং আমরা বিজ্ঞানে, ভোগসর্বস্বতায় আধুনিক হয়েছি। আধুনিক হয়েছি পোশাকে, জীবনযাপনে। আধুনিক হয়েছি বাহ্যিকতায় আর আড়ম্বরে। কিন্তু মননে আধুনিক হতে পারিনি। সংস্কারের আবর্ত থেকে মুক্তমন নিয়ে আলোকপ্রাপ্ত হতে পারিনি। যদি সত্যিই হতাম, তাহলে প্রতিদিন সংবাদপত্র খুললে নারীত্বের লাঞ্ছনার এত অনিঃশেষ উপাখ্যান চোখে পড়ত না। আমাদের পারিপার্শ্বিক ক্ষেত্রে মেয়েদের নিজস্ব আকাশ এতটা সঙ্কুচিত হয়ে থাকত না। সেই নারী লাঞ্ছনা শুধু বাইরেই নয়, অবিরত ঘটে চলেছে সংসারের চার দেওয়ালের মধ্যেও। পারিবারিক লাঞ্ছনা ও হননলীলার কুনাট্য লেখা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। গ্রাম থেকে শহর, শিক্ষিত থেকে অশিক্ষিত, বিত্তবান থেকে দরিদ্রের কুটির— সর্বত্র এই লাঞ্ছনা, অত্যাচার ঘটেই চলেছে। কত রকমের নিগ্রহ। পণপ্রথা, বাল্যবিবাহ, অ্যাসিড হানা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, খুন, সম্মান রক্ষার্থে হত্যা, ডাইনি প্রথা, নারী পাচার, অপহরণ সহ আরও কত অপরাধ আজও জলভাতের মতো। আইন দিয়ে তাকে বন্ধ করা যায়নি। আসলে মনের অন্ধকারটুকু দূর করতে না পারলে এই লাঞ্ছনা কোনওদিন বন্ধ হবে না।
পর্দা প্রথা, সতীদাহ প্রথা সহ বহু অন্যায় ব্যবস্থা একসময় আমাদের সমাজে মেয়েদের পায়ের বেড়ি হয়ে উঠেছিল। সেও এক তালিবানি ব্যবস্থা, যা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল আমাদের সমাজের বুকের উপর। সেই পাথর সরে যায়নি। মেয়েরা আজ কি সত্যিই মানসিকভাবে সেই যন্ত্রণা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে? ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর রিপোর্টেই দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছর কীভাবে জীবনের সবক্ষেত্রে মেয়েরা নিগৃহীত হচ্ছে। অবাক করা ব্যাপার হল, প্রতি বছর নিগ্রহের সংখ্যা বাড়ছেই।
অথচ কী বিরাট ভণ্ডামি আর বৈপরীত্য! আমরা মাতৃকাশক্তির আরাধনা করি। দেবী শক্তির কাছে নতজানু হয়ে বর প্রার্থনা করি— ধনং দেহি, রূপং দেহি, যশো দেহি। কিন্তু অনুভবের মধ্যে সেই মাতৃশক্তিকে বাস্তবজীবনে নিত্যদিন অপমানে, লাঞ্ছনায় বিদ্ধ করে চলেছি। এখন তো চারিদিকে ঘটা করে দেবীশক্তি আরাধনার উৎসব চলছে। দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো পেরিয়ে এসে আমরা কালীপুজোর আয়োজন করছি। দীপাবলির আলোয় ঘর সাজিয়ে আঁধার দূর করার চেষ্টা করছি। কিন্তু মনের দীপাবলি কবে যে হবে, তা আমরা জানি না। মনের আঁধারের ভিতরে বাস করা অশুভ শক্তিকে, অ-হিত শক্তিকে যেদিন উপলব্ধি করতে পারব সেদিনই হয়তো হবে প্রকৃত দীপাবলি, মনের সেই দীপাবলি নিয়ে আসবে নতুন দিন।
দেবী কালিকার পুজো করলেও তার রূপ ও সাধনার মধ্য দিয়ে যে দর্শনটুকু প্রকাশ পেয়েছে, তা সত্যিই আমরা উপলব্ধি করতে পারিনি। কালী বললেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে তাঁর রূপ। ‘করাল বদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাং।/ কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুণ্ডমালা বিভূষিতাং।। / সদ্যশ্ছিন্ন শিরঃ খড়গ বামার্দ্ধ করাম্বুজাং। / অভয়ং বরদঞ্চৈব দক্ষিণোর্দ্ধঃ পানিকাং।।’ এই রূপের মধ্য দিয়ে শক্তি ও অভয়দানের দর্শন ব্যক্ত হয়েছে। তা আত্মস্থ করলেই নারীশক্তির উত্থান সম্ভব।
নারী এই পৃথিবীতে সৃষ্টি ও শক্তির আধার। সেই শক্তির বহু রূপ। নানা রূপের মধ্য দিয়ে আসলে তিনি অশুভ শক্তির বিনাশ করে সৃষ্টি ও কালের ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছেন। তবুও অসুরকুলের বিনাশ নেই। কেননা অসুরের উপস্থিতি বাইরে নয়, অসুরের অবস্থান আমাদের মনের ভিতরেই। নানা রিপু হয়ে তারা উৎপাত করেই চলেছে। সেই উৎপাতের একটা বড় টার্গেট মেয়েরা।
সত্যি কথা বলতে কী, মেয়েরাও সেই শক্তিমন্ত্রে জেগে উঠতে পারেনি। তারাও সেই দর্শনের বোধকে আত্মস্থ করতে পারেনি। হলে হয়তো এই সমাজ অন্যরকম হতো। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ প্রমুখ ব্যক্তিত্ব মেয়েদের মধ্যে যে শক্তির উদ্বোধন ঘটাতে চেয়েছিলেন, তা আজও সবক্ষেত্রে বাস্তব রূপ নেয়নি। আত্মিক উদ্বোধনই জাগরণের মূল মন্ত্র। সুতরাং জাগতে হবে উভয়কেই।
আমরা বুঝি না যে, এই বিশ্বসৃষ্টির যে অনন্ত লীলা নিঃশব্দে প্রবাহিত হয়ে চলেছে, তার পিছনে রয়েছে নারী ও পুরুষের যৌথ পদক্ষেপ। আসলে তা পুরুষ ও প্রকৃতিরই অনন্ত লীলা। অবশ্য এখানেও তর্কের অবকাশ থেকে যায়। কার শক্তি বেশি, পুরুষ না প্রকৃতির! কালীতত্ত্ব দিয়েই ব্যাপারটা বোঝা যেতে পারে।
শিব শান্ত, নিষ্ক্রিয়, নির্গুণ। কিন্তু শিব ও শক্তি একে অন্যের পরিপূরক। একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। শ্রীরামকৃষ্ণ তো বলেইছিলেন, ব্রহ্ম আর শক্তি অভিন্ন। একটিকে মানলে, অপরটিকে মানতেই হবে। যেমন অগ্নি ও তার দাহিকাশক্তি। অগ্নিকে স্বীকার করলেই দাহিকাশক্তিকে স্বীকার করতেই হবে। দাহিকাশক্তি ভিন্ন কি অগ্নিকে কল্পনা করা যায়! আবার দাহিকাশক্তির উৎস হল অগ্নি। সূর্যকে বাদ দিয়ে যেমন সূর্যরশ্মির কথা ভাবা যায় না, তেমনি এ হল এক নিরবচ্ছিন্ন যোগ বা মিলন।
এই তত্ত্বকথার বাইরে বাস্তব যে জগৎ আছে, সেখানে কেন এত পাপাচার? কেন এত নারীর অবমাননা? কেনই বা নারীশক্তির এত অবক্ষয়? সমাজে দুবৃত্তরা মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর ধর্ষিতারা মুখ লুকিয়ে নিজেদের সম্মান বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। তাঁদের মধ্যে এত মানসিক শক্তির অভাব কেন, কেন এত শিক্ষিত হয়েও সেই শক্তিতে জেগে উঠতে পারছেন না তাঁরা। কেন মনজুড়ে সংকোচের এত ঘনায়মান অন্ধকার?
আসলে, আজকের মেয়েরা আগের থেকে অনেকটা এগিয়েছে, এটা সত্যি। কিন্তু সমাজের একটা বিশাল অংশের মেয়ে এখনও অনেকটাই পিছনে পড়ে রয়েছে। শিক্ষায়, মানসিকতায়, সংস্কারে, শক্তিভাবনায় এবং আত্মবিশ্বাসে। পাশাপাশি এযুগের অসুররা অনেক বেশি দলবদ্ধ। তাদের পিছনে আছে অর্থশক্তি, রাজনৈতিক শক্তি এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে রাষ্ট্রশক্তিও। উত্তরপ্রদেশের হাতরাসের ঘটনার সময় আমরা দেখেছি, দলিত মেয়েটি ধর্ষিতা হওয়ার পর অপরাধের প্রমাণ লোপাটের জন্য রাষ্ট্রশক্তি কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে চেষ্টা করেছিল। এমন অজস্র প্রমাণ দেওয়া যায়। এতে অপরাধীরা প্রশ্রয় পায়। সমাজে রক্তবীজের সংখ্যা বাড়ে। কিন্তু যত শক্তিই থাক, অশুভ শক্তি কখনও জয়ী হতে পারে না। এই সেই সময়, যখন মেয়েদের আরও বেশি করে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে উঠতে হবে। নতুন করে শক্তিকে আহরণ করতে হবে। সেই শক্তি শুধু বাহুতে নয়, মননে, বোধে, বিশ্বাসে। আত্মবিশ্বাসী মানুষই সব থেকে শক্তিশালী।
এই সমাজ তো শুধু পুরুষের কিংবা নারীর নয়। কেউই একক লড়াইয়ে জয়ী হতে পারে না। নারী ও পুরুষের যৌথ প্রয়াসে এগিয়ে চলে সমাজ। স্বাধীনতা অবশ্যই দরকার। কিন্তু পুরুষবিচ্ছিন্ন স্বাধীনতার মধ্যে পূর্ণতা বলে কিছু থাকতে পারে না। কেননা তা প্রকৃতি বিরুদ্ধ। নারীর মধ্যেই যুগে যুগে সংহত হয়েছে শক্তি ও সৌন্দর্য। কখনও মাতা, কখনও কন্যা, কখনও জায়া আবার কখনও সে ভগিনী রূপে আত্মপ্রকাশ করে পুরুষের সঙ্গে বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। তারই মধ্যে সুপ্ত থাকে সৃষ্টি ও ধ্বংসের চাবিকাঠি। একের মধ্যে সেই পূর্ণতার প্রকাশ পায় না। উভয়ের মিলিত শক্তিতেই পূর্ণতার প্রাপ্তি। নারীর শক্তির পাশে পুরুষও তাই এক চালিকাশক্তি। দেবীর এই শক্তিতত্ত্বই হয়তো বা নতুন পথ দেখাতে পারে।