সবার উপরে মানুষ সত্য। তাঁর এত বড় উপলব্ধির কথা কবি চণ্ডীদাস আমাদের সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন প্রায় ছ’শো বছর আগে। পৃথিবী তারপর বহু বহু দূর এগিয়ে গিয়েছে। জ্ঞানে বিজ্ঞানে চিন্তায় চেতনায়। পূর্বপুরুষদের অনেক চিন্তা উপলব্ধি সিদ্ধান্ত পরবর্তীকালে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। স্বভাবতই বাতিলও হয়েছে সেসব। আবার বহু উপলব্ধি ধ্রুব সত্য হয়ে রয়েছে। সেসব বাতিল হওয়া দূরে থাক, সেগুলির সামান্য পরিবর্তনের কথাও আমাদের মনে হয় না। তার মধ্যে একটি অবশ্যই চণ্ডীদাসের পরম উপলব্ধি—‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। সমাজ, দেশ, রাষ্ট্রসংঘ, বিশ্বব্যবস্থা সবটাই মানুষের কল্যাণচিন্তাকে কেন্দ্র করে। পরিবেশচিন্তায় বাতাস, অরণ্য, জলাভূমি এবং সমস্ত প্রাণীকে বাঁচানোর কথা বলা হচ্ছে। সেখানে যে জীবে প্রেমের ধারণা, তার মূলেও মানুষের কল্যাণ। সবকিছু বাঁচলে পরেই প্রকৃতি তার ভারসাম্য ধরে রাখতে সক্ষম হবে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারিয়ে যাওয়ার পরিণাম মানুষের জন্য অমঙ্গলের। মানবসভ্যতার সামনে এক বিরাট প্রশ্নচিহ্ন দাঁড়িয়ে পড়ে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে আমাদের খাদ্য তালিকা দীর্ঘ করতে হয়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে আপস করে বসতির বিস্তার ঘটাতে হয়েছে। কৃষি বিপ্লব, শ্বেত বিপ্লবের মতো একাধিক খাদ্য বিপ্লবের নামে কিছু কৃত্রিম ব্যবস্থাকে আত্মস্থ করতে হয়েছে। সেখানেও পদে পদে নিশ্চয়তা দিতে হয়েছে যে, শেষমেশ মানুষ সুরক্ষিতই থাকবে। চিকিৎসা, পরিবহণ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি প্রভৃতি সমস্ত প্রয়োজন মেটাতে গিয়েও চূড়ান্ত পর্যায়ে মানুষের জীবনের নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সাহিত্য, বিনোদন, সংবাদ প্রভৃতি ক্ষেত্রেও মানুষের কল্যাণচিন্তার সঙ্গে আপস করার কথা পরিত্যাগ করেছে সমস্ত সমাজ। সবচেয়ে বেশি এবং মারাত্মক মতভেদের জায়গাটি হল ধর্মাচরণ। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যে বিশ্বাসী ভারত মেনে নিয়েছে ‘যত মত তত পথ’। ধর্ম বিশ্বাসটা মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত। প্রতিটি মানুষ তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাস অনুসারে ধর্মাচরণ করুন। তাতে কোনও সমস্যা নেই। এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা কোনও প্রথাগত ধর্মে বিশ্বাস করেন না। তাঁদের কাছে ধর্ম একটাই—মানবধর্ম। তাঁদের এই ভিন্ন চিন্তাকেও ভারত সমান শ্রদ্ধা করে। বিভিন্ন ধর্ম নানাভাবে যত কথাই বলুক, সব কথার সার কথা হল—‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’।
মানুষের মনে একইসঙ্গে দু’রকম চিন্তা চলতে থাকে। সুচিন্তা ও কুচিন্তা। এই দুই চিন্তার দ্বন্দ্ব নিয়েই মানুষের দিন কাটে। সুচিন্তার প্রাবল্যেই মানুষ প্রতিদিন জয়ী হয়। কিন্তু যখন কুচিন্তা মানুষকে পুরো গ্রাস করে ফেলে তখন সে অপরাধ করে বসে। আবার এই অপরাধপ্রবণতা দূর হলেই একজন মানুষ প্রকৃত অর্থে সৎ বা সাধুতে রূপান্তরিত হতে পারেন। তাই আধুনিক সমাজবিজ্ঞান অপরাধীর বিনাশ চায় না, অপরাধপ্রবণ মনের বিনাশ চায়। মৃত্যুদণ্ড রদ করার পক্ষে এটাই তাঁদের যুক্তি। আমাদের দেশেও ‘জেল’ বা ‘কারাগার’ শব্দটির বদলে ‘সংশোধনাগার’ কথাটি ব্যবহারের যুক্তি এটাই। সংশোধিত মানুষকে মূল স্রোতে বরণ করে নেওয়াই আধুনিক শিক্ষা।
এত দূর এগিয়ে রয়েছে যে সমাজ সেই সমাজে করোনামুক্ত মানুষকে অচ্ছুৎ ভাবার হালফিল প্রবণতা দুর্ভাগ্যজনক। রোগমুক্ত মানুষকে অলিখিতভাবে বয়কটের তালিকায় রাখার এই প্রবণতা সংক্রামক ব্যাধির চেয়ে কোনও অংশে কম বিপজ্জনক নয়। সংখ্যায় এখনও কম হলেও এই ধরনের কিছু ঘটনা প্রশাসনের নজরে এসেছে। ‘রোগীর বিরুদ্ধে নয়, রোগের বিরুদ্ধে লড়াইটা’কে নিশ্চিত সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাই প্রচারের পাশাপাশি কিছু ইতিবাচক প্রশাসনিক পদক্ষেপও করেছে। যেমন হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়ার যে নীতি—‘ডিসচার্জ নীতি’ তাতে কিছু সংশোধনী এনেছে রাজ্য। রোগী সুস্থ হয়ে ওঠার বিস্তারিত তথ্য তাতে লেখা থাকবে। এরপর সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষকে নিয়ে পরিবার বা প্রতিবেশীদের আপত্তি করার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি থাকবে না। সরকারের এই মানবিক ও দায়বদ্ধতার নীতি প্রশংসনীয়। নাগরিকদের উচিত, এটাকে সর্বান্তকরণে শ্রদ্ধা করা। অন্যথায় লড়াইটা অকারণ জটিল ও কঠিন হয়ে উঠবে। সেটা কোনওভাবেই কাম্য হতে পারে না।