উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
এই অনুন্নয়নের জায়গাটাকে ধরতে পেরেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুঝেছিলেন, জঙ্গলমহলের উন্নয়ন করতে না পারলে মাওবাদীদের নাগপাশ থেকে তাকে বের করা যাবে না। তাই তিনি ক্ষমতায় এসেই জঙ্গলমহলের মুখে হাসি ফোটাতে সচেষ্ট হলেন। সেখানে আনলেন উন্নয়নের জোয়ার। আমরা হতদরিদ্র আমলাশোল, বেলপাহাড়ি দেখেছি। দেখেছি অভুক্ত দুখীরাম টুডু আর গুণধর বাস্কেদের। তৃণমূল সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর সেখানে নতুন ভাষ্যে উন্নয়নের প্রকাশ দেখতে পেলাম। ঝাঁ চকচকে রাস্তা, স্কুল, শিক্ষা, খাদ্য, বাসস্থান, চাকরির সুযোগ—সবকিছু দিয়ে এতদিনের বঞ্চিত আদিবাসী সমাজকে নতুন জীবনের স্বাদ এনে দিলেন মমতা।
সিপিএমের একচ্ছত্র আধিপত্যের মূল উপড়ে ফেললেন তিনি। সেই শূন্যস্থানে ধীরে ধীরে বিরোধী দল হিসেবে প্রবেশ করল বিজেপি। তারপর পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভালো ফল করে বিজেপি সেখানে পদ্ম ফোটাল। সেই ধারাবাহিকতা দেখা গেল লোকসভার নির্বাচনেও। আসলে সেদিন তৃণমূল নেতাদের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়েছিল জঙ্গলমহলের অধিকাংশ মানুষ। তাই তাঁরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর এক বছর কেটে গিয়েছে। ক্রমেই বিজেপির প্রতি বীতরাগ জন্মাচ্ছে সেখানকার ভূমিপুত্রদের। তাঁরা দেখেছেন, কীভাবে ধীরে ধীরে আরএসএসের নির্দেশে আদিবাসী সমাজকে হিন্দুত্বের গণ্ডিতে টেনে আনার চেষ্টা চলছে। আরএসএসের নির্দেশে বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক মন্দির তৈরি হচ্ছে। এতে মানসিকভাবে আঘাত লাগছে কুর্মি, মাহাত, সাঁওতাল-সহ আদিবাসীদের ধর্মীয় আবেগে। আদিবাসীরা মনে করছেন, আরএসএস এখন তাঁদের ধর্ম ও সংস্কৃতির উপর আগ্রাসী প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে।
এর মধ্যেই ছিল এনআরসি’র আতঙ্ক। ভারতের অন্যান্য এলাকার মতো আদিবাসী সমাজেও আতঙ্কের ঢেউ তুলল কেন্দ্রের এই পদক্ষেপ। এইসব দরিদ্র, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, আজীবন বঞ্চিত মানুষ তাঁদের ‘ডকুমেন্ট’ পাবেন কোথা থেকে? তাহলে কি তাঁদের আশ্রয় নিতে হবে কোনও এক ডিটেনশন ক্যাম্পে? ভিতরে ভিতরে ফুঁসছিলেন তাঁরা। আবার হয়তো একটা বীরসা মুন্ডা বা সিধুকানহোর ইতিহাস তৈরি হতো। লেখা হতো নতুন উলগুলানের গল্প।
আদিবাসী সমাজের এই মনোভাব বুঝেছে বিজেপি। বুঝেছে আদিবাসী সমাজের ক্রমে দূরে সরে যাওয়ার কারণও। তাই কিছুটা নরম হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। তারা বলেছিল, রামমন্দিরের ভূমিপূজনের জন্য বিভিন্ন জায়গায় মাটি ও জল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অযোধ্যায়। সাঁওতালদের পবিত্র ক্ষেত্র সারনা ও জাহের থানের মাটিও নিয়ে যাওয়া হবে রামজন্মভূমিতে। কিন্তু রামচন্দ্রের মন্দির নির্মাণের জন্য তাঁদের ধর্মস্থানের মাটি দিতে অস্বীকার করল সাঁওতাল সমাজ। সারা ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহলের সুপ্রিমো রামচন্দ্র মুর্মু বললেন, আদিবাসী সমাজকে হিন্দু ধর্মে শামিল করার এটা একটা চক্রান্ত। আসলে মোহন ভাগবতরা দীর্ঘদিন ধরে চাইছেন হিন্দু জনসংখ্যা বাড়ানোর জন্য সাঁওতালদের হিন্দুত্বের তালিকায় নথিভুক্ত করতে। এতে দেশে হিন্দুত্বের সংখ্যা অনেক বেশি দেখানো যাবে। আরএসএসের এই ফাঁদে পা দিতে রাজি নয় আদিবাসী সমাজ। তাঁদের মতে, এই ফাঁদে পা দিলে সাঁওতাল আদিবাসীদের জাতি, ধর্ম, সমাজ সংস্কৃতি সব শেষ হয়ে যাবে। ক্রমে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এই দূরত্ব যত বাড়বে, জঙ্গলমহল থেকে বিজেপি ততই তার মাটি হারাবে। তা অনেকটা প্রকট হয়ে উঠছে। ধীরে ধীরে সবুজ হয়ে উঠছে জঙ্গলমহলের প্রকৃতি, মাটি ও মানুষ। ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী সমাজ বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা বিজেপিকে চায় না। সেখানে বিজেপি ক্ষমতা-বিচ্যুত। পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী সমাজের মানুষও তৈরি হয়েই আছে। শুধু ভোটের অপেক্ষা।
সেইসঙ্গে আছে জঙ্গলমহলে বিজেপির আপন ঘরের কোন্দল। যতদিন যাচ্ছে, একটু একটু করে ভাঙছে জঙ্গলমহলে বিজেপির সংগঠন। জঙ্গলমহলকে দখলে রাখতে বিজেপি সেখানে অনেক টাকা ঢেলেছে। সেই টাকা-পয়সার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু। দল, উপদল, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের এইসব চেনা গল্প জড়াচ্ছে বিজেপিকে ঘিরেও। দলে জন্ম নিচ্ছেন বিক্ষুব্ধরা। তাঁদের সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে। তারই ফলে জঙ্গলমহলে দল ভেঙে আবার সব ফিরে যাচ্ছেন তৃণমূলে। বিজেপির ভাষাতেই যাকে বলা যায় ঘরওয়াপসি। তৃণমূলের নেতাদের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ একদিন জঙ্গলমহলের মানুষকে বিজেপির দিকে ঠেলে দিয়েছিল, আজ বিজেপির দিকে তাকিয়ে তাঁদের মনে সেই একই ক্ষোভই জন্মাচ্ছে। ফলে আবার সবুজের আভা ফিরছে জঙ্গলমহলে। দল বেঁধে অনেকেই ফিরছেন তৃণমূলে। ঘাসফুল আবার সেখানে আশায় বুক বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নতুন করে সংগঠন সাজাচ্ছে।
এসব দেখে বিজেপি অনেকটাই আননার্ভড। তারা দিনে দিনে উপলব্ধি করছে যে, সেখান থেকে তাদের পায়ের তলার মাটি আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। তারাও তাই পাল্টা প্রচারে নেমেছে। গেরুয়া শিবির এখন জোরকদমে প্রচার চালিয়ে বলছে, ‘ওই দেখ, ছত্রধর মাহাতকে জঙ্গলমহলে গুরুত্ব দিচ্ছে তৃণমূল। ছত্রধরের ইতিহাস সবাই জানেন। উনি আসলে এখানে ফের মাওবাদী সংগঠন গড়ে তুলতে চান এবং সেটা তৃণমূলের পৃষ্ঠপোষকতায়।’ জঙ্গলমহলে এখন মাওবাদীদের ম-ও নেই। তৃণমূল সরকারের উন্নয়নের ঢেউয়ে জঙ্গলমহল নতুন আর একটা সকালের স্বপ্ন দেখছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, স্টেডিয়াম, যোগাযোগ ব্যবস্থা, হাতে হাতে কাজ, আবাসন প্রকল্প, পুষ্টিবাগান প্রকল্প ইত্যাদি ঘিরে দারুণ উৎসাহ। এর মধ্যে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। সাঁওতালি ভাষাতেই এবার নেওয়া যাবে ডিএলএড। এবছর প্রথম সাঁওতালি ভাষায় পরীক্ষা দিয়ে বেশ কয়েকজন ছাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করেছে। তাদের জন্য সাঁওতালি মাধ্যমে কলেজ খোলা হচ্ছে। রাজনীতির বাইরে এ এক অন্য আলো। যে আলো অনুন্নয়নকে ঘাড় ধরে বের করে মানুষের মধ্যে আলোর স্পর্শ এনে তাকে নতুন বোধে জাগিয়ে তোলে।
জঙ্গলমহলের মানুষ আগে সিপিএমকে বলত, চোর আর তৃণমূলকে বলত, ডাকাত। এখন বিজেপিকে বলছে, মাফিয়া। যে তোলাবাজির কারণে একসময় জঙ্গলমহল এলাকায় তূণমূলকে হার স্বীকার করতে হয়েছিল, যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে লোকসভা ভোটে বিজেপি ভালো ফল করেছিল, আজ সেই কারণে আদিবাসী সমাজ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে গেরুয়া শিবির থেকে।
একদিকে মমতার উন্নয়নের ইতিবাচক দিক, অন্যদিকে বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকারের নেতিবাচক দিক—এই দুইয়ের লড়াইয়ে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জঙ্গলমহলজুড়ে এখন ঘরে ঘরে ভাত ফোটার গন্ধ। জঙ্গলমহলজুড়ে এখন নতুন প্রজন্মের চোখে শিক্ষার স্বপ্ন, বড় হওয়ার স্বপ্ন। জঙ্গলমহলজুড়ে এখন মানুষের বেঁচে থাকার বিশ্বাসের স্বপ্ন। এই স্বপ্নের শক্তিকে নষ্ট করার মতো আর কোনও শক্তি আছে কি? অঞ্জনা সোরেন, ত্রিলোচন মাহাতরা এখন আর পিছু ফিরতে চাইছেন না। আবার সবুজ হয়ে ওঠা জঙ্গলমহলই ওদের নিশ্চিন্ত আশ্রয়।
ক্ষমতায় আসার পর যে উন্নয়নটুকু হয়েছিল, সেটা তৎকালীন তৃণমূলের নেতারা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারেননি। এর আগের বার উন্নয়নের সেই বাস্তবতাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়নি। এবার আর তৃণমূল সেই ভুল করতে রাজি নয়। উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রচারে নেমে তারা বুঝিয়ে দিয়েছে, ভুল থেকে তারা শিক্ষা নিয়েছে। প্রতিটি ব্লক ধরে তৈরি হচ্ছে উন্নয়নের তথ্যচিত্র। সেসব দেখে মানুষ মিলিয়ে নিতে পারবে, তাদের জন্য কী হয়েছে, এবং তথ্যচিত্রে কী দেখানো হচ্ছে। পরিস্থিতি আবার নতুন করে জঙ্গলমহলের মানুষকে ভাবাচ্ছে। তাদের মনের দিকবদল হচ্ছে।
তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার। আগের বার দলীয় নেতৃত্বের খেয়োখেয়ি, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব কিন্তু দলের পক্ষে অভিশাপ ডেকে এনেছিল। সেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব কিন্তু একেবারে নির্মূল হয়ে যায়নি। জঙ্গলমহলে তৃণমূল অনেকটা এগিয়ে থাকলেও তাকে পিছু টেনে ধরছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বই। জঙ্গলমহলে উন্নয়নের সোনালি প্রেক্ষাপটে তৃণমূলের অগ্রগতির মধ্যে এটাই কেবল একটা কাঁটার খোঁচা রয়ে গিয়েছে।