উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
১. মাকড়শার ডিজাইন সেন্স বা নকশা সম্পর্কে ধারণা রয়েছে।
২. মাকড়শার জাল শিকারকে মাঝপথে আটকায় না। তাকে বরং আকর্ষণ বা প্রলুব্ধ করে।
৩. মাকড়শার জালগুলো একটা কারণে চকচকে।
৪. মাকড়শাদের চলাফেরায় একটা গুপ্ত ভাব থাকে।
৫. মাকড়শারা বড় করে ভাবে।
৬. মাকড়াশারা সাধারণভাবে রোজই তার জাল পাল্টায়।
যদি আমার মতো করে ভাবেন তবে আপনি বলবেন যে, ‘ভীষণ ঠিকঠাক’! ভারত-চীন সীমান্তের ভয়ানক অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে তাদেরকেই যথাযথ বা ঠিকঠাক (অ্যাপ্রোপ্রিয়েট) বলে মনে হয়। করোনা ভাইররাসের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী যুদ্ধে আমাদের পরাজয়ের সামনে তাদেরকেই যথাযথ বলে মনে হয়। দ্রুত তলিয়ে যেতে থাকা অর্থনীতি এবং বেকারত্বের মোকাবিলা করতে নেমে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে হতাশার জন্ম হয়েছে, মাকড়শাদের যথাযথ বলে
মনে হয় সেখানেও। রাজস্থানে যে অনাবশ্যক লড়াইয়ের মধ্যে (লাক্সারি টাসল) প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল আটকে রইল সেখানেও এদেরকে যথাযথ বলে মনে হয়।
রাজস্থান
শচীন পাইলট একজন ইয়ং ম্যান। তাঁর বিরাট উচ্চাশা। এর মধ্যে কোনও দোষ নেই। কিন্তু যে সময়টাতে তিনি এমন পদক্ষেপ করলেন তাতে সবটাই ভুলে ভরা হয়ে গেল। রাজস্থান-সহ পুরো জাতি আজ এমন তিনটি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় ব্যস্ত যা অতীতে কখনও করতে হয়নি। অর্থনীতি এবং মহামারীর বিষয়ে, দল এবং সরকার—উভয় দিক থেকেই বিজেপি পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছে। চীনা হুমকির সামনে সরকার কিছু হাস্যকর কাণ্ড করে চলেছে, কিন্তু সীমান্তের প্রকৃত পরিস্থিতিটা খোলসা করছে না। অস্বীকার বা প্রতিবাদের ব্যাখ্যা দেওয়াটাই সরকারের মুখপাত্রদের নতুন একটা কাজ হয়েছে। অনুরাগ শ্রীবাস্তব যা বলেন সেটা লব আগরওয়াল যদি বুঝতে পারেন আমি অবাক হব। দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবার যে লক্ষণ (গ্রিন শুটস) অর্থমন্ত্রী প্রতি সপ্তাহে একবার করে দেখতে পান, ওই দু’জনের মধ্যে কোনও একজনের নজরে তা যদি ধরা পড়ে তাহলেও আমি অবাক হব।
শচীন পাইলট আর বিজেপির মানসিকতা এক নয়, অথবা এটা আমাদের বিশ্বাস। যে মানুষগুলো মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করছেন শচীনের সমস্ত শক্তি তাঁদের সাহায্যের জন্য ব্যয় করা উচিত। তাঁর সমস্ত শক্তি নিয়োজিত হোক রাজস্থান রাজ্যের অর্থনীতিকে নিজের পায়ে দাঁড় করাবার জন্যে। তাঁর সামনে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছেন অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার ব্যক্তিত্ব মোহনলাল সুখাড়িয়া। শচীন পাইলট লম্বা দৌড়ের জন্য প্রস্তুত হতে পারতেন। তাহলে তিনি হতে পারতেন মোহনলাল সুখাড়িয়ার মতোই দীর্ঘ মেয়াদের মুখ্যমন্ত্রী। এটা অস্বাভাবিক যে, তাঁর নকশা সম্পর্কে তাঁর কোনও জ্ঞানগম্যি নেই এবং শিকার জালে পড়ার মুখে তাকে আটকাবার চেষ্টা করলেন। ফলে কী হল? তিনি মাঝ সমুদ্রে—বুঝে উঠেত পারছেন না ঠিক কোন তীরে তাঁর তরী ভেড়াবেন!
অর্থনীতি
অর্থনীতির দিকে অথবা ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকান। আর্থিক মন্দার ব্যাপারে গোড়ার দিকে যা আশঙ্কা করা হয়েছিল আজকের বাস্তব পরিস্থিতি তার থেকে অনেক খারাপ, অনেক বেশি উদ্বেগজনক। প্রথম ত্রৈমাসিক পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু, নগদ জোগান বৃদ্ধির (ফিসকাল স্টিমুলাস) কোনও লক্ষণ নেই। এমনকী, পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা বাড়ানোর জন্য যে ধরনের উদ্যোগ সরকারের তরফে নেওয়া জরুরি তারও লক্ষণ নজরে আসেনি। যে-আর্থিক ব্যবস্থা সরকার নিয়েছে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার পক্ষে সেটাই যথেষ্ট হবে বলে যে-ক’জন মনে করেন তাঁরা হলেন—নির্মলা সীতারামন, কে ভি সুব্রহ্মণ্যম, রাজীব কুমার এবং প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ লেখক। তা সত্ত্বেও সব সিদ্ধান্তের মালিক একজনই—যৌথ ব্যবস্থায় বাকিদের ভূমিকা কিছু নেই। অর্থনীতি বাস্তবিকই ধসে পড়েছে। এসময় অর্থনীতির পুনর্গঠনের কৌশল সম্পর্কে শাসকদের পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। আর সেটা যদি অনুপস্থিত হয় তবে দৃঢ়তাশূন্য প্রতিটি ব্যবস্থাই নিষ্ফলা হবে।
করোনা ভাইরাস
মাকড়শার, সবটা না হলেও, কিছু বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে করোনা ভাইরাসের মিল রয়েছে। ভাইরাসটা চুপিসারে সব দেশে ঢুকেছে। এটা অনুপ্রবেশ করেছে ভারতের মতো বিরাট দেশেও। ভারতের সবক’টা রাজ্যে। সবক’টা জেলাতেও। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জনবিন্যাস (ডেমোগ্রাফি), আবহাওয়া, মানুষের অভ্যাস, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, আয়ের শ্রেণীবিন্যাস, প্রস্তুতি, সরকারের প্রশাসনিক দক্ষতা-ক্ষমতা প্রভৃতি আলাদা। প্রতিটা দেশের এই বিপুল বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে দিব্য মানিয়ে নিয়েছে এই ভাইরাস। মহাভারতের যুদ্ধটা ছিল আঠারো দিনের।
সেই অধ্যায়ের সঙ্গে তুলনা টেনে প্রধানমন্ত্রীর মতো ব্যক্তিত্ব ভারতবাসীকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে ভাইরাসের বিরুদ্ধে জয়টা হাসিল হবে মাত্র ২১ দিনে! ফলে, মানুষ সহজেই তা বিশ্বাস করেছিল। কেউ বুঝতে পারেনি যে এটা ছিল অসত্য, স্তোকবাক্য। না চিকিৎসা বিজ্ঞান, না মধ্যযুগীয় বিশ্বাস—কোনও কিছুরই উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না এই আশ্বাস। আমরা এখন জেনে গেছি যে যতক্ষণ না ভ্যাকসিন আবিষ্কার, প্রমাণিত ও বণ্টন হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা নিরস্ত্রই। কী কেন্দ্র, কী রাজ্য—সরকারগুলির উপর মানুষের বিশ্বাস, আস্থা আর নেই। যাঁরা নিজেদের সংস্থান নিজেরা করতে পেরেছেন তাঁরা নিজেদেরকে পৃথক করে নিয়েছেন। আর যাঁরা সেটা পারেননি তাঁরা ভয়-ভীতি ঝেড়ে ফেলে দিয়েছেন। একটা নির্দিষ্ট মৃত্যুহার (কেস ফ্যাটালিটি রেশিও) সমেত জীবন একটা নতুন ‘স্বাভাবিকতা’য় (নিউ ‘নর্মাল’) ফিরে যাবে। ‘লক-আনলক’টা হল সরকারের মূর্ছারোগ লক্ষণের মতো—যার সম্পর্কে কিছুই আগাম অনুমান করা সম্ভব নয়, সেটা পুরোই ফালতু। সরকারগুলো কতবার তাদের কৌশল (মাকড়শার উদাহরণে ওয়েব বা জাল) পাল্টাল, তার কোনও গুরুত্ব নেই। তারা আলাদাভাবে কিছুই করতে পারবে না।
চীন
চীন হল একেবারে বিদঘুটে ধরনের মাকড়শা। একটা মাকড়শার ‘সব’ ধরনের বৈশিষ্ট্যই এর মধ্যে রয়েছে। সর্বোপরি, দেশটার চিন্তাভাবনা বড় এবং এর শিকারদেরকে আকৃষ্ট করে। ছ’বছরে চীনের নেতার সঙ্গে ১৮টা মিটিং। তার মধ্যে একটা রাষ্ট্রীয় সফর এবং তিনটে শীর্ষ সম্মেলন। এমন চোখ ধাঁধানো খতিয়ান যে-কোনও কঠোর তপস্বীকেও ‘ফ্ল্যাটার’ করার পক্ষে যথেষ্ট। নরেন্দ্র মোদি কোনও তপস্বী নন। তাঁর ভয়ানক ইগো (সব প্রধানমন্ত্রীরই থাকে) এবং তাঁর দলের জন্য আরও বেশি অহংবোধ। মোদিজির মাপটা একেবারে নিখুঁত নিয়েছিলেন জি জিনপিং। উচ্চ পর্যায়ের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি মোদিজিকে চটুল প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন। পারস্পরিক লগ্নিতে উৎসাহ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। জিনপিং আরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ২০২০-কে ‘ভারত-চীন সংস্কৃতি এবং মানুষে মানুষে ভাব বিনিময়ের বর্ষ’ হিসেবে উদযাপনের জন্য বিশ্বমানের মঞ্চ বানাবেন।
কিন্তু, ২০২০-র জানুয়ারিতে কী কাণ্ডটা করলেন তিনি? চীনের লাল ফৌজকে (পিএলএ) এগিয়ে দিলেন ভারতে হানা দেওয়ার জন্য! চীনের জন্য ভারত হচ্ছে আর একটা আগুন নিয়ে খেলা। যেমন আগুনে-খেলা জিনপিং শুরু করেছেন হংকং, তাইওয়ান, দক্ষিণ চীন সাগর, বেল্ট-অ্যান্ড-রোড ইনিশিয়েটিভ নিয়ে এবং ভূমিষ্ঠ হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে পাকিস্তান, তুর্কি ও ইরানকে নিয়ে তাঁদের চার দেশের নয়া ঘোঁট (কোয়াড)। এই আগুন যদি কিছুটা ঝলসে দেয় তবে, এটা হবেও, চীন বীরদর্পে এগিয়ে যাবে। নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন, ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ ডোনাল্ড ট্রাম্প ছাড়া আর কোনও বিশ্বনেতা কি ভারতের বিরুদ্ধে চীনের আগ্রাসনের নিন্দা করেছেন? চীন যদি ‘মাকড়শা’ হয় তো ভারত হল তার ‘শিকার’—যাকে তার জালে প্রলুব্ধ করেছিল।
মাকড়শারা চিরকাল বিরামহীন।