উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
কংগ্রেস বিধায়করা পরিষদীয় দলের বৈঠকে প্রস্তাব দিলেন, সোমেন মিত্রকে প্রার্থী করবেন। অন্য কোনও প্রার্থী হাইকমান্ড চাপিয়ে দিলে তাঁরা মানবেন না। কংগ্রেস পরিষদীয় দলের এই প্রস্তাব হাইকমান্ড মানল না। উল্টে তারা প্রার্থী করে দিল দেবপ্রসাদ রায়কে (মিঠু)। চটে লাল সোমেন। এবং, তাঁর অনুগামীরাও। আব্দুল মান্নান-শঙ্কর সিংরা ‘ছোড়দা’কে বুদ্ধি দিলেন মমতাকে ম্যানেজ করতে হবে। কিন্তু, সোমেনের সঙ্গে তখন মমতার সাপে-নেউলে সম্পর্ক। দেখা-সাক্ষাৎ তো বটেই, দু’জনের মধ্যে বাক্যালাপও পুরোপুরি বন্ধ।
এই টানাপোড়েনের মাঝে এক রাতে মমতার সঙ্গে সোমেনকে ফোনে কথা বলিয়ে দিলেন সমীর চক্রবর্তী (বুয়া)। কালীঘাটের অগ্নিকন্যাকে ‘দিদিভাই’ বলে সম্বোধন করতেন ছোড়দা। ফোনে তিনি কাতর কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘দিদিভাই আমি তোমার প্রতি অনেক অবিচার করেছি। কিন্তু একটিবার তোমার কাছে আর্জি জানাচ্ছি, আমাকে সমর্থন করো রাজ্যসভায়। আমি কংগ্রেস হাইকমান্ডকে ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে চাই।’ মমতাকে সেদিন আরও অনেক কথাই বলেছিলেন সোমেন। পরিণতিতে অগ্নিকন্যার ক্ষোভ কমে। বলতে গেলে, দু’জনের বিরোধের বরফ গলে জল হয়ে গিয়েছিল।
সোমেনের গেমপ্ল্যান অনুযায়ী, আব্দুল মান্নান-শঙ্কর সিংরা ‘নির্দল’ প্রার্থী হিসাবে জয়ন্ত ভট্টাচার্যকে রাজ্যসভা ভোটে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। জয়ন্তবাবু জিতেছিলেন ৪০-৩৭ ভোটে। মনে রাখতে হবে, খাতায়-কলমে তৃণমূলের বিধায়ক সংখ্যা ছিল মাত্র ৩। আসলে সোমেন-মমতা জোটের শক্তি সেদিন কংগ্রেসের অফিসিয়াল প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছিল।
রাজ্য-রাজনীতির এক বর্ণময় চরিত্র ছিলেন সোমেন মিত্র। প্রায় ৩০ বছর তাঁকে কাছ থেকে দেখেছি। সিরিয়াস বিষয় ছাড়াও, আমরা সোমেনের রাজনৈতিক জীবনের অনেক মজার ঘটনারও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাক্ষী। কংগ্রেস তখনও ভাঙেনি। মমতার সঙ্গে সোমেনের মিটমাটের চেষ্টা চলছে। আমহার্স্ট স্ট্রিটের ছোড়দাকে অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে মান্নানরা এক রাতে পাঠালেন কালীঘাটে দিদিভাইয়ের কাছে। অনেকেই হয়তো জানেন না, মমতা খুব ভালো সিন্থেসাইজার বাজাতে পারেন। সোমেন যখন কালীঘাটে মমতার ছোট্ট কুঠুরিতে ঢুকলেন তখন বাজনার রেওয়াজ চলছে। নেত্রীর সিন্থেসাইজার মন দিয়ে শুনছিলেন নেতা। হঠাৎ বাজনা থামিয়ে মমতা জানতে চাইলেন, ‘কী গান বাজাচ্ছি বলুন তো?’ সোমেন আমতা আমতা করে একটা গানের নাম বললেন। মিলল না। মমতা কিছুটা গম্ভীর হয়ে ফের রেওয়াজে ডুবে গেলেন। গভীর রাতে ফোন করে জানতে চাইলাম, ‘কী আলোচনা হল?’ সোমেনবাবু হেসে জবাব দিলেন, ‘কিছুই হল না, বাজনা শুনে গানের সঠিক নাম বলতে পারলুম না। তাতেই তো সব তাল কেটে গেল।’
বরকত গনি খান চৌধুরীকে নিয়ে তখন কংগ্রেস রাজনীতিতে উথাল-পাথাল চলছে। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং কংগ্রেসকে ভাঙতে চলেছেন। পশ্চিমবঙ্গে তাঁর প্রধান টার্গেট গনি খান। বরকত তখন বেজায় চটে আছেন হাইকমান্ডের উপর। কারণ, মন্ত্রিসভা থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ভি পি সিং তাঁর লোক অরুণ নেহরু, মাখনলাল ফোতেদারকে গনির পেছনে লাগিয়ে দিয়েছেন। আর হাইকমান্ড ভরসা করে আছে সোমেনের উপর।
একদিন বিকেলে কলকাতার আলিপুরে যে ফ্ল্যাটে বরকত থাকতেন সেখানে আমরা বসে আছি। গনি খানের উল্টো দিকের সোফায় আর একজন অচেনা ব্যক্তি রয়েছেন। তাঁর হাতে একটা পেল্লায় গানের রেকর্ড। তাতে আবার নিজের ছবি। সোমেন ঢুকলেন ঘরে। তাঁকে দেখামাত্র বরকত বলে উঠলেন, ‘আর আমি অপেক্ষা করতে রাজি নই। কাল রাতে অরুণ নেহরু ফোন করেছিল। চলো, আজকেই ঘোষণা করি, আমরা কংগ্রেস ছাড়ছি।’
সোমেন হয়তো উত্তেজনা প্রশমনের উদ্দেশ্যেই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন। ঘরে বসা অচেনা ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, ‘ইনি কে?’ বরকতও তাঁকে বললেন, ‘আপনি কী চান? এখন বাইরে যান তো, আমি সোমেনের সঙ্গে দু’টো গোপন কথা বলব।’ এই শুনে (সদ্যপ্রয়াত) প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির সরস মন্তব্য, ‘আর গোপন কথার কী বাকি রইল, সবই তো ওঁর সামনে বলে দিলেন!’
কলকাতার প্রাক্তন মেয়র প্রয়াত শিবকুমার খান্না খুব ভালোবাসতেন সোমেনকে। একরাতে বর্ষীয়ান সাংবাদিক মিহির গঙ্গোপাধ্যায়, আব্দুল মান্নান-সহ আমরা খান্নার বাড়িতে ডিনারে নিমন্ত্রণে গিয়েছি। অনেক গল্পের মাঝে কংগ্রেসের সেই বর্ষীয়ান নেতা মজা করে সোমেনের উদ্দেশে বললেন, ‘আমি তো রোজ সকালে সোমেনকে ফোন করি। অনেকক্ষণ ধরে কথা বলি। তবে, বুঝতে পারি, ফোনটা ধরে সোমেন রিসিভারটা বাদলকে (বাদল ভট্টাচার্য) দিয়ে দেয়। বাকি সময়টা সোমেনের বকলমে বাদল আমার কথায় ‘হ্যাঁ হ্যাঁ বলে যায়।’
লেখক বিধায়ক। মতামত ব্যক্তিগত