উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
প্রথমে দেখা যাক, এই জাতীয় শিক্ষা নীতি থেকে আমরা কী কী পেলাম। প্রথমেই বলতে হয় সরকারি স্কুলে প্রি-প্রাইমারি আবশ্যিক করা। আজকের দুনিয়ায় শহরাঞ্চলের প্রত্যেক বাবা-মা ছেলেমেয়েকে বছর তিনেক বয়স থেকেই স্কুলে ভর্তি করে দেন... মানে মন্টেসরি, কিন্ডারগার্টেন। লক্ষ্য কী? তাদের বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘রেডি’ করা। সেইসব স্কুলে কচিকাঁচারা বন্ধুত্ব পাতায়, খেলাধূলা করে, আর সেইসঙ্গে চলে বেসিক পড়াশোনা। অর্থাৎ, বাংলা ও ইংরেজি বর্ণমালা, ছবি দেখে জীবজন্তু চেনা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, কথোপকথন। মানে, বড় স্কুলে ইন্টারভিউ দিতে গেলে ফটাফট তারা যাতে ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। তাতে আলাদা ইমপ্রেশন তৈরি হবে। আর বড় স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে তারা হবে অটোমেটিক চয়েজ। এই গোটা প্রক্রিয়া থেকেই পরিষ্কার, আজকালকার বাবা-মায়েরা সন্তানদের ইংরেজি মিডিয়ামে দেওয়ার জন্য তৎপর। এবং তা অবশ্যই বেসরকারি। প্রাথমিক ধারণাটাই এমন যে, সরকারি স্কুলে আবার পড়াশোনা হয়
নাকি? হলেও গুটিকয় স্কুলে। এই প্রবণতা মোটেও সুখকর নয়।
দ্বিতীয়ত, ব্যাগের ওজন কমানো। এবার থেকে আর একগাদা বইপত্র নিয়ে স্কুলে যেতে হবে না। বইয়ের পাতা সংখ্যাও কমবে। কারণ সরকার বলছে, বাস্তব জীবনে প্রয়োজনে লাগে না, এমন সব কিছুই সিলেবাস থেকে ছেঁটে ফেলা হবে। বরং জোর দেওয়া হবে কোডিংয়ে। মানে পড়ুয়ারা ক্লাস সিক্স থেকেই অ্যান্ড্রয়েড, আইওএস জাতীয় প্ল্যাটফর্মের জন্য গেম বা অন্য অ্যাপ্লিকেশন বানাবে। বাড়তি নজর দেওয়া হবে অঙ্কেও। পড়াশোনা কেমন হচ্ছে, তার মূল্যায়ন করবে সহপাঠীরাও। আর তৃতীয়, ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণীতে নেওয়া হবে বিশেষ পরীক্ষা। এবং সবচেয়ে বড় কথা, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বা আইসিএসই-আইএসসির ধারণাটাই বাতিলের খাতায় চলে যাচ্ছে। তার জায়গায় আসছে ক্লাস নাইন থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত আটটা সেমেস্টার। সায়েন্স, আর্টস, কমার্সের দিনও শেষ। একজন পড়ুয়া চাইলে ফিজিক্সের সঙ্গে ফ্যাশন টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা করতেই পারে। কিংবা অঙ্কের সঙ্গে গান।
তৃতীয় প্রাপ্তি উচ্চশিক্ষায়। সম্পূর্ণ শিক্ষানীতি কার্যকর হলে শুরু হবে মাল্টি এক্সিট পলিসি। ফলে কলেজের প্রথম বর্ষ থেকে তৃতীয় বর্ষ, যখন খুশি পড়া ছেড়ে বেরিয়ে আসা যাবে। মিলবে সার্টিফিকেট বা ডিপ্লোমা। ডিগ্রি হবে চার বছরের। উঠে যাবে এমফিলও। সবচেয়ে বড় কথা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনায় এবার আসছে ক্রেডিট ব্যাঙ্ক। কেউ যদি মাঝপথে পড়া ছেড়ে দেন, তার প্রাপ্ত পয়েন্ট সেই ব্যাঙ্কে জমা থাকবে। পরবর্তীকালে আবার পড়াশোনা শুরু করলে তার পর থেকেই তিনি এগতে পারবেন। বিষয় নির্বাচনে স্বাধীনতা এবং ক্রেডিট ব্যাঙ্ক, দু’টো ভাবনাই বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সঙ্গে ব্যালান্স রাখার জন্য আনা হচ্ছে।
এ পর্যন্ত এই শিক্ষানীতিকে সাধুবাদ জানাতেই হবে। কিন্তু সমস্যা কোথায় হতে পারে? প্রথমত, ক্লাস ফাইভ (পারলে ক্লাস এইট) পর্যন্ত মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষা। ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের প্রতি যে অভিভাবকদের আলাদা আকর্ষণ আছে, তাঁরা কি এই পদ্ধতিতে সাড়া দেবেন? বোধহয় না। প্রত্যেকেই তাঁদের ছেলেমেয়েদের দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চান। সেক্ষেত্রে ইংরেজির থেকে ভালো মাধ্যম অন্য কিছু নেই। যে কোনও একটা বিষয়ে ইংরেজি ভাষায় যত ভালো বই রয়েছে, তা কোনও আঞ্চলিক ভাষায় নেই। সেক্ষেত্রে বাংলা, হিন্দি, তামিল, তেলুগু, ওড়িয়া ভাষায় সেইসব বই লিখতে হবে বা অনুবাদ করতে হবে। তারপরও তার গুণমান কি ‘অরিজিনাল’ বইয়ের মতো হবে? সম্ভাবনা কম।
কেন্দ্রীয় পলিসি বলছে, ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে শুরু হবে বিভিন্ন ভোকেশনাল কোর্স। অর্থাৎ, ছাত্রছাত্রীরা ওই পর্বে কাঠের কাজ, বাগান করা, বৈদ্যুতিন সামগ্রী মেরামত এসব শিখবে। উদ্যোগ মোটেই খারাপ নয়। কিন্তু যার বাবা নিজে কাঠের কাজ করেন, তিনি কি চাইবেন ছেলেকে বা মেয়েকে ওই পেশার জন্য তৈরি করতে? অনেক কৃষকই এমন রয়েছেন, যাঁরা জমির পাট্টা নিয়ে চাষ করেন। এবং সংসার চালাতে তাঁদের নাভিশ্বাস উঠে যায়। তাঁরা প্রার্থনা করেন, ঠাকুর আমার ছেলেটা বা মেয়েটাকে যেন এই কষ্ট না করতে হয়। তাই তাঁরা বহু অভাব-অনটন সত্ত্বেও ছেলেমেয়েকে স্কুলে ভর্তি করেন। স্বপ্ন দেখেন... ওরা কেউকেটা হবে। আজ থেকে কত বছর আগে রবি ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘যে-চাষা তাহার ছেলেকে প্রাইমারি স্কুলে পাঠায়, তাহার একটিমাত্র উদ্দেশ্য এই যে, তাহার ছেলে নিতান্ত চাষা না থাকিয়া কিঞ্চিৎ পরিমাণে ভদ্রসমাজ-ঘেঁষা হইবার যোগ্য হয়; চিঠিটা পত্রটা লিখিতে পারে, পড়িতেও পারে, জমিদারের কাছারিতে দাঁড়াইয়া কতকটা ভদ্রছাঁদে মোক্তারি করিতে পারে, গ্রামের মোড়লি করিবার যোগ্য হয়, ভদ্রলোকের মুখে শুনিতে পায় যে, তাইতো রে, তোর ছেলেটা তো বলিতে-কহিতে বেশ!’ আমরা প্রত্যেকেই এমনটা চাই। আমার মেয়ে, আমার ছেলে বাবা-মাকেও ছাপিয়ে যাবে...। তা আদৌ হবে তো? যদি হয়, তাহলে বেসরকারি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের মোহ ত্যাগ করে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তরাও ফিরবেন সরকারি বৃত্তে। তা কি আদৌ সম্ভব?
আশা ক্ষীণ। কারণ, নয়া এই শিক্ষানীতিতে কেন্দ্রীয় সরকার যে দক্ষযজ্ঞের ইঙ্গিত দিয়েছে, তা কত বছর বা কত দশকে সম্পূর্ণ করা যাবে, সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। সরকার নিজেও সন্দিহান। তাই নীতি কার্যকরে নির্দিষ্ট কোনও বছর বা লগ্নের উল্লেখ করা হয়নি। কিছু কিছু ‘লক্ষ্যমাত্রা’ স্থির করা হয়েছে। যেমন, ২০২৫ সালের মধ্যে প্রত্যেকের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং ২০৪০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ শিক্ষানীতি কার্যকর করা। প্রথম টার্গেটে আসা যাক। ২০২৫ সাল। মানে পাঁচ বছর। দেশের সব স্তরে প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে গেলে যে পরিকাঠামো প্রয়োজন, তা নেই। এবং প্রক্রিয়াও শুরু হয়নি। হয়তো একটা মাঝারি মানের ক্লাসঘরের অভাব হবে না। কিন্তু প্রযুক্তি সাজানো, দক্ষ শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ, সিলেবাস তৈরি এমন হাজারো কাজ রয়েছে। তার জন্য বিপুল অর্থ প্রয়োজন। চলতি অর্থবর্ষে স্কুলশিক্ষায় কেন্দ্রীয় সরকার বাজেট বরাদ্দ করেছিল মোট জিডিপির দেড় শতাংশ। কিন্তু গোটা দেশে প্রি-প্রাইমারি ক্ষেত্রে পরিকাঠামো তৈরিতেই যা খরচ হবে, তাতেই এই বরাদ্দ কম পড়ে যেতে পারে। বলা হচ্ছে, শিক্ষায় বরাদ্দ হবে জিডিপির ৬ শতাংশ। তাহলে হয়তো এই সঙ্কট আসবে না। কিন্তু রাজ্য সরকারি স্কুলগুলির ক্ষেত্রে এটা কিন্তু হবে রেকারিং খরচ। তার উপর প্রত্যেকটা রাজ্যের যে শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, তারই খোলনলচে বদলে দিতে হবে। যা এক-দু’বছরে
করা সম্ভব নয়।
এছাড়া রয়েছে তিন ভাষার বেষ্টনী। মানে তিনটি ভাষা প্রাথমিক স্তরে পড়তে হবে—মাতৃভাষা, একটি ভারতীয় ভাষা এবং একটি বিদেশি ভাষা (ধরে নেওয়া যায় এটি ইংরেজি হবে)। যদিও লিখিত অর্ডারে বলা হচ্ছে, ভাষার ব্যাপারটা রাজ্য সরকার, স্কুল বা পড়ুয়া ঠিক করবে। কিন্তু এরপর একটা প্যাঁচ রয়েছে। ঘুরিয়ে বলা হয়েছে, প্রাথমিক এবং মধ্যশিক্ষায় সংস্কৃত পড়ানো হবে। এই ভাষা যদি সত্যিই বাধ্যতামূলক হয়, তাহলে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘আধুনিক’ ভাবনা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। কারণ, সংস্কৃত শিক্ষা ভবিষ্যতে একজন ছাত্রকে কী সুবিধা দেবে? যে পড়ুয়া সংস্কৃত নিয়ে রিসার্চ করবে, তার ক্ষেত্রে না হয় এই নীতি বেশ সুবিধাজনক। কিন্তু বাকিরা?
এবার আসা যাক মাল্টি ডিসিপ্লিনারি ব্যাচেলরস প্রোগ্রামে। চার বছরের কোর্স। আর এর জন্য আলাদা কলেজ তৈরি হবে। আর ভবিষ্যতে ধীরে ধীরে এখনকার কলেজ এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকেও ওই ছাঁদে ফেলা হবে। ততদিন? সেই দিশাও কিন্তু নেই নয়া পলিসিতে। বিষয় ধরে ধরে কমিটি হবে, কলেজগুলি স্বশাসন পেয়ে যাবে এবং তৈরি হবে নতুন একটি কমিশন... তার আওতায় চলে আসবে ইউজিসি, এআইসিটিইর মতো সংস্থাগুলি।
এই নীতি সার্বিকভাবে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার কতটা উন্নতিসাধন করতে পারবে... এত ভাবনা, আলোচনা, বিশ্লেষণের পরও কিন্তু আদপে তা
স্পষ্ট হচ্ছে না। স্বপ্ন আকাশছোঁয়া, কিন্তু সেখানে পৌঁছনোর পথ দেখা যাচ্ছে না। কতকটা রবি ঠাকুরের সেই বক্তব্যের মতো, ‘জামা কিনিতে গেলাম,
পাইলাম একপাটি মোজা; এখন ভাবিতেছি,
ঐটেকেই কাটিয়া ছাঁটিয়া কোনোমতে জামা করিয়া পরিব। ভাগ্য আমাদের সেই চেষ্টা দেখিয়া
অট্টহাস্য করিতেছে।’
রাজ্যগুলিও কিন্তু ধীরে ধীরে মুখ খুলছে। প্রথম অভিযোগ, কারও সঙ্গে এ নিয়ে কোনও আলোচনা করা হয়নি। দ্বিতীয় অভিযোগ ভাষা শিক্ষা সংক্রান্ত। যার উত্তরও কেন্দ্রের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। রাজ্য তাই নিজেরা কমিটি গঠন করছে... ব্যাপারটা বুঝতে চাইছে। সংবিধান অনুযায়ী শিক্ষা হল কেন্দ্র-রাজ্য দুয়েরই বিষয়। অর্থাৎ, কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার নিজেদের মতো করে শিক্ষা সংক্রান্ত নীতি বা আইন তৈরি করতে পারে। খুড়োর কল সামনে ঝুলছে। পাশাপাশি চলছে শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে পকেটে পুরে ফেলার কৌশল। কেন্দ্রের এই লম্বাচওড়া নজরদারি আদপে রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ নয় তো? নাকি এর পিছনেও রয়েছে কোনও অভিসন্ধি... বেসরকারিকরণ। যা মোদি সরকারের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।