উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
এখন বক্তব্য সব ইন্টারনেটে বা অন্তর্জালে। অমিত শাহ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সকলের সামনেই আজ ইলেক্ট্রনিক পর্দা। নেতা নেত্রীর বক্তব্য ভেসে যাচ্ছে ইন্টারনেটে। করোনা আবহে তাই মঞ্চঘেরা লাখো মানুষের গিজগিজে মাথা নেই। অন্যদিকে নেতা নেত্রীদের বক্তব্য শেষ হওয়া মাত্রই টেলিভিশনে বিরোধী রাজনৈতিক দলের টিকাটিপ্পনি। আগে মানুষ সমাবেশ থেকে ঘরে ফিরতেন অনেকটা সময় নিয়ে। ফেরার পথে দীর্ঘ রাজনৈতিক আলোচনা হতো। পাড়ায় পৌঁছে বিরোধী মতের মানুষের সঙ্গে তরজাও ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কোথাও কোথাও সভা সমাবেশে যাওয়া বা ফেরার সময় প্রাণঘাতী মারামারিও হয়েছে। তার ভালো-মন্দ বিচার করা সমাজবিজ্ঞানে অত্যন্ত কঠিন। মনে রাখতে হবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অসাধারণ বক্তার দীর্ঘ বক্তব্যের যে রেশ থাকত আগে অনেকটা সময় ধরে, অতিমারী পরিস্থিতিতে তা চ্যালেঞ্জের মুখে। আমরা সকলেই জানি যে-কোনও বক্তব্যের পরেই অন্য রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা সেই বক্তব্য কাটতে শুরু করেন। খোলা মঞ্চে সমর্থকরা নেতানেত্রীর বক্তব্য শুনে আগে যতটা উজ্জীবিত হতেন, সেরকমটা ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে কি না তা এখন দেখার বিষয়। একই বক্তব্য বিজেপির ক্ষেত্রেও সত্যি। বিশেষত তাদের নেতা অমিত শাহের বেশ কয়েকটি অন্তর্জাল বক্তৃতা দিয়েই শুরু হয়েছিল রাজনীতির এই নতুন ধারা। এখানে প্রশ্ন, সমস্ত চ্যানেল তো এই বক্তব্য সম্প্রচার করছে। চলছে অনন্ত তরজা। তাহলে আবার অন্তর্জালের গল্প কেন? এর কারণ সংবাদমাধ্যমকে দেখাতে হচ্ছে যে তারা নিরপেক্ষ। কয়েকজন বড় নেতার বক্তব্য তারা হয়তো সরাসরি সম্প্রচার করতে পারে। কিন্তু তাদের প্রেক্ষিত হচ্ছে রাজনৈতিক সভা সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশন, সেই সভার সম্প্রচার নয়। তাই রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে নিজেদের প্রয়োজনেই অন্তর্জালে নেতানেত্রীদের বাণী প্রচারের বিষয়টি চালু রাখতেই হবে। সে কেউ শুনুন বা নাই শুনুন।
রাজনীতি তো চলবেই। কিন্তু সঙ্গে অন্য একটা বাস্তবতাকেও ভুলে গেলে চলবে না। আমাদের দেশে মার্চ মাস থেকে যে কোভিড ইতিহাসের শুরু তা চতুর্থ পেরিয়ে পঞ্চম মাসে গড়াল। দেশনেতাদের কণ্ঠে এখনও শুধুই লড়াইয়ের স্লোগান, সমাধানের পথ নেই। যা বোঝা যাচ্ছে তাতে বিশবিশ সাল অতিমারীর আঘাতে জীবনকে দুর্বিষহ করে রাখবেই। মন শক্ত রেখে কাজ করে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন মনোবিদেরা। কিন্তু মন থাকলেও কাজ কোথায়? তার উপর এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে বৈষম্য বাড়ছে অনেকটা। ঠিক কোথায় সেই বৈষম্য? দেশের ১০ শতাংশ মানুষের কোনও অসুবিধে নেই, তাঁরা সচ্ছল। এঁদের মধ্যে অনেকেই সরকারি চাকরি করেন। পরিস্থিতি যতই জটিল হোক না কেন, কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার চটজলদি মাইনে বন্ধ করবে না। বাকি বেসরকারি ক্ষেত্র এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ধরে আরও ১০ শতাংশ মানুষ হয়তো সুখে আছেন। কৃষিক্ষেত্রে বড় চাষিরা চিরকালই সচ্ছল। তবে যতই শতাংশ যোগ করুন না কেন, এ দেশের ২৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ মোটামুটি ভালো আছেন এমনটা দেখাতে পারবেন, তার বেশি নয়। বাকি থাকল ১০৫ কোটি। এঁরা সকলেই মুশকিলে। কেউ কম, কেউ বেশি। রাজ্যবিশেষে চাল, ডাল, আটা পৌঁছচ্ছে এঁদের কাছে। তবে সব জায়গায় নয়। এটাই মাটি থেকে উঠে আসা ছবি। তবে মাটির কিছুটা উপরে সিমেন্টে গাঁথা যে সমাজটা সেখানেও কিন্তু অবস্থা বদলাচ্ছে। প্রান্তিক মানুষ ছাড়াও মধ্যবিত্তের গায়ে লাগতে শুরু করেছে কোভিডের আঁচ। এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। কারণ কোভিড পরিস্থিতির আগেই দেশের অর্থনীতির বৃদ্ধি নেমে দাঁড়িয়েছিল গত ১১ বছরের মধ্যে তলানিতে। সেটা মার্চ মাসের হিসেব। তার পরে নতুন আর্থিক বর্ষের তিন মাস কেটে গিয়েছে। সে ফল এরমধ্যে যখন বেরতে শুরু করবে তখন আঁতকে ওঠা ছাড়া আর উপায় থাকবে না।
টুকরো উদাহরণ দিয়ে রাজনীতি বা সমাজনীতির ধারা পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। তবে এক একটা ছোটখাটো ঘটনা অনেক বড় প্রেক্ষিতকে সামনে আনে। একেবারে ঘটমান বর্তমানের একটি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা পেশ করা যাক। বাড়ি বাড়িতে খবরের কাগজ বিলি করেন স্নাতকস্তরের এক ছাত্র। এই কাগজটিও পৌঁছেছে তাঁর মতোই কারও হাত ছুঁয়ে। সেই যুবককে অনেকটা রাত জেগে পড়াশোনা করে এখন আর শুতে যেতে হচ্ছে না। কারণ সময় হয়ে যাচ্ছে রাজপথের ধারে ডাঁই করা কাগজের ভাগ সাইকেলে গোছানোর। যে যুবকটির কথা বলছি, তিনি দু’বছর আগে উচ্চমাধ্যমিকে ৮৭ শতাংশ নম্বর পেয়ে নামী কলেজে পড়ছেন। যাঁর বাড়িতে কাগজ দেন, তিনি ৩০ বছর আগে ওই একই নম্বর পেয়ে উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম দশে ছিলেন। এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক। আর কাজ খুঁজছেন যুবকটি। কারণ তাঁর বাবার কাজ চলে গিয়েছে। অর্থাৎ চাকরিপ্রার্থী ছাত্রের সামনে অসহায় অধ্যাপক। কাগজের দাম দেওয়ার নাম করে যুবকের হাতে ৫০০ টাকার নোট ধরিয়ে সাময়িক স্বস্তি পেলেন সংবেদনশীল প্রৌঢ় মাস্টার মশায়। দীর্ঘমেয়াদি সমাধান, কিন্তু অলীক। আসলে আরও বেশি বেশি মানুষ মধ্যবিত্তের গণ্ডি ছাড়িয়ে পা দিচ্ছেন নিম্নবিত্তের আঙিনায়। বেসরকারি ক্ষেত্রে চাকরি টলমল করছে। শিক্ষার জায়গাটাও একেবারে গোলমেলে। প্রচুর নম্বর উঠছে। তার মানে এমন নয় সরকার অযাচিতভাবে গাদা গাদা নম্বর দিচ্ছে পড়ুয়াদের। আজকের দিনে বহু ছাত্রছাত্রী পড়াশোনায় ভালো। সেই কারণেই তাঁরা দারুণ ফল করছেন। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, পড়াশোনা শেষে চাকরি, সব জায়গাগুলোই জট পাকিয়ে গিয়েছে। সেই গিঁট খুলতে হবে সরকারকেই।
আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মৃত্যুর অসহায়তা। কোভিডের চিকিৎসায় অনেক নতুন বিষয় জানতে পারছেন চিকিৎসকেরা। মৃত্যুর হার আমাদের দেশে ২ বা ৩ শতাংশের মতো। অর্থাৎ সবাই যে পট করে মরে যাব এমনটা নয়। কিন্তু ভয়ের পরিস্থিতি মানুষকে এমন জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে যে সমাজ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে রোগীর দিক থেকে। এটা এখন একেবারেই পরিষ্কার যে কোভিড হলে পাড়া প্রতিবেশীর সাহায্যও পাওয়া মুশকিল। এই জায়গাটা বদলাতে হবে। পাড়ায় পাড়ায় যেমন অনেক সময় রাত-পাহারার দল থাকে, তেমনই যুবক যুবতীদের পথে নামাই আশু সমাধান। পরিসংখ্যান পরিষ্কার বলছে যে ১৮-২০-র সুস্থ ছেলেমেয়েদের কোভিড আক্রান্ত হয়ে বড় ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম, একেবারে শূন্যের কাছাকাছি। বাবা মায়ের আঁচল ছেড়ে তাঁরা যদি সাহস করে পথে নামতে পারেন, তাহলেই এই অমানবিকতা থেকে মুক্তির সম্ভাবনা আছে। টেলিভিশন চ্যানেল কিংবা সংবাদমাধ্যমে বয়স্ক খ্যাতনামা মানুষের বাক্যবাণী অসুস্থের পরিষেবায় কোনও কাজে আসবে না। মনে রাখতে হবে, এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিভিন্ন ক্লাবকে টাকা দিয়েছিলেন এক সময়। আজকেও সেই পদ্ধতিতেই বাংলার কয়েক হাজার ক্লাবকে নিয়ে কাজ শুরু করতে পারেন তিনি।
এই ধরনের কাজ এর মধ্যেই শুরু করেছে কিছু বামপন্থী দল। অতিমারী পরিস্থিতিতে তাদেরকে এই পরিকল্পনায় শামিল হতে ডাকলে রাজ্যেরই লাভ। কোভিড থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা কিছু যুবককে নিয়ে একটি প্রকল্প রাজ্য সরকার শুরু করেছেন। কিন্তু এখনও তা অপ্রতুল। প্রশ্ন হল, সামনের বছর বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে তৃণমূল আর বিজেপি নেতাদের মধ্যে যে তরজা চলছে, সেই সময়টুকু একটু অন্যভাবে ব্যবহার করলে ক্ষতি কী? মানুষ বড্ড ভয় পাচ্ছে, মানুষ এক্কেবারে নিঃসহায়। কিন্তু অবস্থাটা এতটা খারাপ হওয়ার কথা নয়। নিম্নবিত্তের মধ্যে খাদ্যশস্য পৌঁছনোর ক্ষেত্রে অনেকাংশেই সফল রাজ্য সরকার। অন্যদিকে চিকিৎসা এবং সেই সংক্রান্ত পরিষেবার ক্ষেত্রে ফাঁকফোকর অজস্র। কোভিডাক্রান্ত ফুসফুসে সাহস জোগাতে সরকারের সহযোগিতায় দলমত নির্বিশেষে আরও কিছুটা উদ্যোগ জরুরি। দ্রুততার সঙ্গে সে কাজ না-হলে আম জনতা বিপদে পড়বে। সমাজ ব্যর্থ হলে, অ্যাম্বুলেন্সে উঠতে না-পেরে অসুস্থের মৃত্যু রুখতে হবে নিঃসহায়ের রাজনীতিকেই।