উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
এই একটা ঘটনা থেকেই বাংলার ক্রীড়াক্ষেত্রের ভিতরের ছবিটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফুটবলের ইন্ডিয়ান সুপার লিগের সামনে তিনটি প্রশ্নচিহ্ন ঝুলে রয়েছে। কবে: নভেম্বর না জানুয়ারি? কোথায়: গোয়া না কেরল? কলকাতার ভূমিকা কী হবে? তবে, এখন ক্রিকেটই সারা ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। করোনার কারণে ভারতে ক্রিকেটের সমস্ত বড় ম্যাচ দীর্ঘদিন বন্ধ। অবশেষে ফিরছে আইপিএল। সূচনা ১৯ সেপ্টেম্বর। তবে বিদেশের মাটিতে। দর্শক-শূন্য স্টেডিয়ামে। আপাতত তিনটি ভেন্যু—শারজা, আবুধাবি ও দুবাই।
খেলা তো এখন আর বিনোদনমাত্র নয়। ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, আমেরিকা, এমনকী আমাদের পড়শি চীনও খেলাকে অর্থকরী শিল্প হিসেবে গ্রহণ করেছে। কৃষি, শিল্প এবং নানা ধরনের পরিষেবাকে আমরা যেভাবে আয়ের উৎস বলে মনে করি, ওরা স্পোর্টস ও গেমসের বিভিন্ন ইভেন্টকেও সেই বন্ধনীতে রাখে। ক্রীড়াও তাদের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক ক্ষেত্র। ওলিম্পিকস, এশিয়ান গেমস, ফুটবল বিশ্বকাপের সময় তফাতটা পরিষ্কার হয়। স্বভাবতই বিপন্ন ক্রীড়া অর্থনীতির সূত্রে ওইসব দেশের উপরে করোনার ধাক্কা অনেক বেশি পড়েছে। টোকিও ওলিম্পিকস ২০২০ স্থগিত হওয়ার কারণে বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হল জাপান। একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইউরোপ এবং লাতিন আমেরিকা—উয়েফা ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ এবং কোপা আমেরিকা ২০২০ এক বছর পিছিয়ে যাওয়ার কারণে। ফুটবল বিশ্বকাপ ২০২২-এর প্রাথমিক পর্বেও পড়েছে করোনার ছাপ।
এই প্রসঙ্গে জানানো যায়, রিও ওলিম্পিকস ২০১৬-র সৌজন্যে ব্রাজিল পাঁচ লক্ষাধিক পর্যটক পেয়েছিল। লন্ডন ওলিম্পিকস ২০১২-র দৌলতে ব্রিটেন পেয়েছিল লাখ ছয়েক বিদেশি পর্যটক। এছাড়া দেশীয় পর্যটক, খেলোয়াড় এবং অন্যান্য পেশার লোকদের মাধ্যমেও ওই দুই দেশের অর্থনীতি বিপুলভাবে লাভবান হয়েছিল। উন্নত অর্থনীতি ক্রীড়াক্ষেত্রকে ধরে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়। খেলার যে-কোনও মেগা ইভেন্ট পরিকাঠামো, পরিবহণ, হোটেল, পর্যটন, খাদ্য, পোশাক প্রভৃতি সমস্ত আর্থিক ক্ষেত্রকে একাই চাঙ্গা করে দেওয়ার শক্তি রাখে। গ্লোবাল স্পোর্টস মার্কেটের মাধ্যমে বছরে সরাসরি ৭৫৬ বিলিয়ন (মার্কিন) ডলারের হাতবদল হয়। এর মধ্যে আমেরিকার একার শেয়ার ৪২০ বিলিয়ন ডলার। ইউরোপ ২৫০ বিলিয়ন ডলার। বাকি সমস্ত আর্থিক ক্ষেত্রে এর যে উচ্ছ্বাস আছড়ে পড়ে তার পরিমাপ করা বাস্তবিকই অসম্ভব। কোভিড-পূর্ব জমানায় চীনকেই সবচেয়ে দ্রুতগতির স্পোর্টস মার্কেট বলে মনে করা হচ্ছিল। ২০২৫ সালের ভিতরে চীন ৩৫০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের স্পোর্টস ইন্ডাস্ট্রি গড়ার লক্ষ্য নিয়ে ছুটছিল। সবারই প্ল্যান হয়তো আপাতত থমকে গিয়েছে।
চীনের মতো লম্বা দৌড়ের ঘোড়া ভারতের ক্রীড়াক্ষেত্র নয়। তবুও ভারতের ক্রীড়া অর্থনীতি একেবারে এলেবেলে নয়। ইন্ডিয়ান স্পোর্টস স্পনসরশিপ ২০১৯-এ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছিল। ১৭ শতাংশ। স্পোর্টস স্পনসরশিপ ইন্ডাস্ট্রির অঙ্ক ৯১০৯ কোটি টাকা। এটাই সর্ববৃহৎ সাফল্য। স্পোর্টস অ্যাডভারটাইজিং সেক্টরে ক্রিকেটের অবিসংবাদিত প্রভাব। অন-গ্রাউন্ড স্পনসরশিপ এবং মিডিয়া সংক্রান্ত ব্যয়—দুটো ক্ষেত্রেই। প্রথম ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ছিল ২৫ শতাংশ। তার ফলে ২০০০ কোটি টাকার মাইলফলক অতিক্রম করে। এই ঘটনা ওটাই প্রথম। অন্যদিকে মিডিয়া সংক্রান্ত ব্যয় বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ১৮ শতাংশ। স্পনসরশিপের দরুন মোট বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ১৩৪৭ কোটি টাকা। যার মধ্যে মিডিয়া সংক্রান্ত ব্যয়ের পরিমাণ ৮০০ কোটি টাকা। নতুন ট্রেন্ড অনুযায়ী ডিজিটাল বিভাগে অগ্রগতি হয়েছিল ৮৪ শতাংশ। যা টাকার পরিমাপে ৪৭৫ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছিল ৮৭৫ কোটি। কনজ্যুমার মার্কেটিংয়ের দু’টো বড় দিক হল বিনোদন এবং ইন্টার্যাক্টিভিটি। ক্রীড়ামোদীদের জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তি এই ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করছিল। ফ্যান্টাসি স্পোর্টস অ্যাপলিকেশনসেরও শ্রীবৃদ্ধি দেখেছিল ২০১৯-এর ভারত। ২০২০-তে এই ক্ষেত্রে বিপুল অগ্রগতির প্রত্যাশা জেগেছিল। দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল বিসিসিআইয়ের হোম সিরিজের স্পোর্টস স্পনসরশিপ রেভিনিউ।
ক্রিকেটের বাইরে ভারতে সবচেয়ে উজ্জ্বল ক্ষেত্রটি হল ব্যাডমিন্টন। স্বভাবতই ব্র্যান্ড এনডোর্সমেন্টের ক্ষেত্রে পি ভি সিন্ধুর মতো শাটলাররা প্রথম সারির ক্রিকেটারদেরদের সঙ্গেই টক্কর দিচ্ছেন। এই প্রসঙ্গে অন্য কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাম হল—বক্সিং রিংয়ের রানি মেরি কম, ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের হিমা দাস, ওলিম্পিয়ান সাক্ষী মালিক প্রমুখ। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ইন্ডিয়ান স্পোর্টস ইন্ডাস্ট্রি প্রতি বছরই এগচ্ছে। ভারতের ক্রীড়াক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাবশালী ক্রিকেট তার আগের পাঁচ বছরে আড়ে-বহরে দ্বিগুণ হয়েছে। গত এক দশকে যথেষ্ট শক্তিশালী (প্রায় ১৩ শতাংশ) একটা কম্পাউন্ড অ্যানুয়াল গ্রোথ রেট (সিএজিআর) দেখা গিয়েছে ভারতের ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট ব্যবসা ক্ষেত্রে। ভারতের অর্থনীতিতে এই ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের ভূমিকা আজ আর মোটেই গৌণ বলা যাবে না। ২০১৯-এ স্পোর্টস ইন্ডাস্ট্রির ১৭ শতাংশ শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে যোগ হয়েছে সরকারের ‘খেলো ইন্ডিয়া’ এবং ‘ফিট ইন্ডিয়া’ আন্দোলন। ভারতীয়দের নিয়ে সত্যিকার ‘স্পোর্টিং নেশন’ গড়ে তোলার প্রশ্নে এই সামগ্রিক ব্যাপারটা বেশ আশাপ্রদ হয়ে উঠেছিল।
২০১৯-এ ভারতে হাজার দু’য়েক সিনেমা তৈরি হয়েছিল। তা থেকে বক্স অফিসের সংগ্রহের পরিমাণ ছিল ১.৪৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮-র নিরিখে বৃদ্ধির পরিমাণটা ছিল ১১.৬ শতাংশ। যা এ যাবৎ সর্বাধিক। বিশেষজ্ঞদের প্রত্যাশা ছিল, ২০২০ সালে বক্স অফিস রেভিনিউয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ১.৬৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু লকডাউনের চক্করে পড়ে হলিউডের মতো বলিউড-সহ সারা ভারতের চলচ্চিত্র শিল্প বিরাট ধাক্কা খেল। ধাক্কা খেল একইসঙ্গে সমস্ত ঘরানার সঙ্গীত, নাটক, থিয়েটারও। এর বাইরে প্রত্যেকটি রাজ্যের নিজস্ব কিছু বিনোদন ধারা আছে। যেমন বাংলার যাত্রা, কীর্তন, কবিগান, জারিগান, ঘেঁটু, ঝুমুর, ছৌ, পুতুলনাচ, কালীকীর্তন, রামযাত্রা প্রভৃতি। এ-যুগে এগুলো কারও বারোমাসের পেশা হয়তো নয়, তবু বহু গরিব পরিবারের কাছে অন্যতম আর্থিক অবলম্বন ছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এসব প্রান্তিক শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হাজার হাজার মানুষও এসময় বড় সমস্যায় পড়ে গেলেন। পুজোর আর দু’মাসও নেই। মনে করে দেখুন, আগে পুজো মানেই ছিল এই ধরনের বিনোদনের রমরমা। কলকাতায় এবং অন্যসকল ছোট-বড় শহরগুলোতেও উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ছিল জলসা—সারারাত ধরে গানের অনুষ্ঠান। কলকাতা ও মুম্বইয়ের জনপ্রিয় শিল্পীদের বুকিং এতদিনে শেষ হয়ে যেত। এবার কুমোরটুলি কত বায়না পেয়েছে? নিশ্চয় বেশি নয়। সর্বজনীন পুজো কিছু হলেও অন্যবারের জৌলুস যে কোনওভাবেই ছুঁতে পারবে না, তা এখনই বলে দেওয়া যায়।
আইপিএলের মতো লাইভ ইভেন্টগুলো আগের চেহারায় কবে ফিরবে—আমরা জানি না। একইভাবে অন্ধকারে আমরা সিনেমা, থিয়েটার চালু হওয়ার প্রশ্নেও। সিনেমা হলগুলো আগামী দু’-চার মাসের ভিতরে চালু হলেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বাধ্যবাধকতা থাকবেই। অর্ধেকের বেশি বুকিংয়ের অনুমতি মিলবে না বলেই অনুমান। সুতরাং বড় বাজেটের ছবি তৈরির সামনে অনির্দিষ্টকালের খাঁড়া ঝুলেই থাকবে। অনলাইন বা ডিজিটাল ফ্রন্ট বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মকে ধরে বিনোদন দুনিয়া ঘুরে দাঁড়াতে মরিয়া। নিঃসন্দেহে যুগোপযোগী এবং বিকল্প ভালো চিন্তা। কিন্তু, প্রথাগত বিনোদনের উপযুক্ত বিকল্প কিন্তু নয়। আরও খারাপ খবর হল, লকডাউনের অনুক্রমে ডিজিটাল দুনিয়াতেও গরিবির ধাক্কা। শুধু এপ্রিলেই সারা দেশে ৮২.৩১ লক্ষ গ্রাহক মোবাইল সিম ছেড়ে দিয়েছেন। সংখ্যাটা কলকাতার ক্ষেত্র ১.৮১ লক্ষ। পরবর্তী দু’মাসের ছবিটা অবশ্য ‘ট্রাই’ জানায়নি। যাই হোক, উলটপুরাণের যুগে ডিজিটাল এন্টারটেইনমেন্ট সম্পর্কে খুব আশাবাদী হওয়ার সুযোগ কই?
ভারতীয় স্পোর্টস মার্কেটের ক্ষতিটা ইউরোপ, আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা বা চীন-জাপানের মতো অবশ্যই নয়। কিন্তু এর সঙ্গে সিনেমার মতো বিনোদন ক্ষেত্রকে যোগ করলে ভারতের মোট ক্ষতির বহরটা বিপুল। প্রতিবেশী চীনের কথা দিয়ে শেষ করব। ওরা অবশ্যই হাত গুটিয়ে বসে নেই কিংবা হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদছে না। ভিতরে ভিতরে প্রস্তুত হচ্ছে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবার জন্যে। আমরা যদি অন্তর থেকে চীনকে প্রতিদ্বন্দ্বী মেনে থাকি, ভারত সরকার বলুক, আমাদের প্ল্যানটা ঠিক কী।
অঙ্কন: সুব্রত মাজী