আশঙ্কাই সত্যি হল। কেন্দ্র জানিয়ে দিল, রাজ্যগুলিকে জিএসটি-র বকেয়া মেটানো সম্ভব নয়। সিঁদুরে মেঘ আগেই দেখেছিলেন দূরদর্শী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্যের ন্যায্য পাওনা বকেয়া হয়েছে ৫৩ হাজার কোটি টাকা। বাম আমলে করা ধারের টাকা শোধ করে, ৫৩ হাজার কোটি টাকা ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়ে যে দশ কোটি মানুষের সংসার চালানো এক কঠিনতম কাজ—তা বোঝার জন্য অর্থনীতির ছাত্র হওয়ার প্রয়োজন নেই। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় একটি অঙ্গ রাজ্যকে এমন বিপদের মুখে ফেলে দিয়ে কেন্দ্র যে ‘বাংলার’ প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ করছে, তা বারবার বলছেন অনেকে। উম-পুনের মতো বিধ্বংসী ঝড়ের পর এক হাজার কোটি টাকার ললিপপ ছুঁইয়ে আর উচ্চবাচ্য করছেন না দিল্লির কর্তারা। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো চলছে করোনার তাণ্ডবলীলা। সেখানেও নানা নীতিকথা শুনিয়ে সাহায্যের দরজায় খিল তুলে দিয়েছে মোদি সরকার। এবার আর কোনও রাখঢাক না করে জানিয়ে দেওয়া হল, বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজ্যগুলিকে জিএসটি ক্ষতিপূরণ মেটানো সম্ভব নয়।
গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স অর্থাৎ জিএসটি বাবদ রাজ্যের প্রাপ্য অর্থটা কোনও দয়ার দান নয়। এটা রাজ্যের হকের পাওনা। জিএসটি চালুর আগে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছিল। তাই এর নির্ধারিত সমস্ত শর্তই সংবিধান স্বীকৃত। এক্ষেত্রে পাওনা টাকা না দিয়ে নির্ধারিত শর্তগুলিকেই কার্যত অমান্য করছে মোদি সরকার। তাই দেশের সরকার সংবিধানকে কতটা মান্যতা দেয় তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কেন্দ্রের বঞ্চনার তালিকায় জিএসটি বাবদ পাওনা না দেওয়ার বিষয়টি যুক্ত হওয়ার রাজ্যের কোষাগারে স্বাভাবিকভাবেই টান পড়বে। আর্থিক সঙ্কট বেড়ে যাবে। কারণ বাংলায় জিএসটি বাবদ আদায়ের পরিমাণ বেশ ভালো। তাই বকেয়া পাওনার পরিমাণও বেশি। এই বকেয়া পাওনা মেটানোর দাবিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরব হলেও প্রধানমন্ত্রী নিরুত্তর থেকে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি উপুড়হস্ত করতে চান না। এভাবে ভাতে মারার কৌশল নিয়ে রাজ্যের কোষাগার পঙ্গু করার চেষ্টা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠছে। কেন্দ্রের কার্যকলাপেই অভিযোগের যথার্থতার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
প্রতিটি রাজ্যের অর্থনীতির ভিত মজবুত না হলে কখনওই একটি দেশ উন্নত, শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে না। কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনীতির উপরেই দেশের অগ্রগতি নির্ভর করে। কিন্তু মোদি সরকারের আমলেই দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বেহাল দশা হয়েছে। জঙ্গিদের হাতে নগদ পৌঁছবে না বা কালো টাকার রমরমা বন্ধ হবে, এইসব যুক্তিতে নোটবন্দির সিদ্ধান্তটি যে সঠিক ছিল না তা এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে। বন্ধ হয়নি দেশে কালো টাকার রমরমা। জনজীবনে নোটবন্দির মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। দেশের অর্থনীতির শোচনীয় দশা। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এর কোনও দায়দায়িত্ব নেয়নি দেশের সরকার। উল্টে তারা বলছে, দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরছে। মোদি সরকারের নেওয়া একের পর এক জনবিরোধী অপরিকল্পিত নীতির জেরে ভুগতে হচ্ছে রাজ্যগুলিকে। তড়িঘড়ি জিএসটি চালুর জেরে উদ্ভুত নানা সমস্যার সামাল দিতে হয়েছে রাজ্যকে। জিএসটি বাবদ লাভের অঙ্ক কেন্দ্রের ঘরে পৌঁছলেও রাজ্যকে বঞ্চনার ধারা অব্যাহত রেখেছে তারা। এখন আবার তাদের অর্থনীতির ব্যর্থতা ঢাকতে লকডাউনকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করে বলছে, রাজ্যগুলিকে জিএসটির বকেয়া অর্থ মেটানো সম্ভব নয়। দায়িত্বটুকু পালনে কেন্দ্রের এতটা অনীহা কেন? উদ্দেশ্য স্পষ্ট। আসলে তিন মাসের লকডাউনের জেরে আরও মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতির হাল ফেরানোর যাবতীয় দায়িত্ব রাজ্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে তারা অব্যাহতি পেতে চাইছে। কেন্দ্রের ভ্রান্ত নীতির কারণেই এখন বাংলা সহ নানা রাজ্য চরম আর্থিক সঙ্কটের মুখোমুখি হতে চলেছে।
উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজ্য ক্ষমতায় এসেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেতৃত্বাধীন সরকার। রাজ্য জুড়ে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ চলছে। আরও উন্নয়নের জন্য অর্থের প্রয়োজন। এর মধ্যে করোনা যুদ্ধের খরচ আর উম-পুনে বিধ্বস্ত বাংলার পুনর্গঠনের খরচ জোগাতে এখন নাজেহাল রাজ্য। এই সঙ্কটকালে রাজ্যের ন্যায্য বকেয়া মিটিয়ে দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়াচ্ছে না কেন্দ্র। কোন রাজনৈতিক অভিসন্ধিতে রাজ্যকে প্রাপ্য অর্থ না দিয়ে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা হচ্ছে সেটাই এখন বিবেচ্য বিষয়।