একটা নয়, একই দিনে দু’টো অনুষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাধারণত বলার সুযোগ পেলে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন। রবিবাসরীয় ‘মন কি বাত’ এবং ‘কার্গিল দিবস’ অনুষ্ঠানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। করোনা থেকে কার্গিল—মোদি ফের অননুকরণীয় ভঙ্গি ও শব্দ চয়নে অদ্বিতীয়। কিন্তু তাঁর মুখে চীনের নাম নেই! আছে শুধু পাকিস্তান। ২১ বছর আগে কার্গিল যুদ্ধ জয়ে সেনাদের ভূমিকার প্রশংসা করে তিনি ‘হানাদার’ প্রতিবেশী ইসলামাবাদকে তুলোধোনা করেছেন। কিন্তু এখনও নাকি লাদাখে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঘাঁটি গেড়ে আছে লাল সেনা। তা নিয়ে মুখে রা কাড়লেন না আমাদের প্রধানমন্ত্রী! পাকিস্তান, চীন—দুটোই ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। পড়শি দুই রাষ্ট্রের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ কয়েক যুগের ঘটনা। পাকিস্তানের জঙ্গি ও ব-কলমে তাদের সেনা প্রায় রোজই চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালাচ্ছে। ভারতীয় সেনারা তার যোগ্য জবাবও দিচ্ছে। কিন্তু পুলওয়ামা ঘটনার পর ভারতের কড়া মনোভাবে এবং নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে পাকিস্তান যেন কিছুটা স্তিমিত। বরং কয়েক মাসে ভারতীয় সীমান্তে যাবতীয় আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে লাদাখ ও ভারতের জমি দখল করে থাকা চীনের প্রসঙ্গ। সীমান্ত থেকে সেনা সরিয়ে নিতে দু’দেশের একাধিক বৈঠকও হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লাদাখ পরিদর্শনও করেছেন। লালফৌজের চোখে চোখ রাখতে সমরসজ্জাও কয়েকগুণ বাড়ানো হয়েছে। এত কিছুর পরে চীনের নাম নিলেন না প্রধানমন্ত্রী। অথচ চীনের বিরুদ্ধে ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে আমেরিকাসহ একাধিক শক্তিশালী রাষ্ট্র। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী কটাক্ষ করে বলেছেন, চীনকে কি ভয় পাচ্ছেন বলেই তাদের নাম নিচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রী? ঘটনা হল, অর্থনীতি ও সমরসজ্জার বিচারে চীনের ধারেপাশেও নেই পাকিস্তান। তাই পাকিস্তানের নাম জপ করার মতো বলে গেলেও হয়তো নানা কূটনৈতিক কারণেই চীনের নাম নেওয়ার প্রশ্নে নীরব থাকছেন মোদি। কিন্তু দেশের প্রধান যদি শত্রুর নাম ও পরিচয় প্রকাশ্যে বলেন তাহলে কি সেনা থেকে দেশবাসী আরও উদ্বুদ্ধ হয় না?
রবিবার অবশ্যই দিনটা ছিল শহিদ স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদনের দিন। কার্গিল দিবস, ভারতের বিজয় দিবস। এ দেশের বীর সেনারা দিনরাত এক করে ভারতের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে লড়াই করে জয়ীও হয়েছিলেন, যা আমাদের গর্বের বিষয়। তাঁদের বীরত্বের গৌরবগাথা তুলে ধরে ইসলামাবাদকে যে মোদি নিশানা করবেন তাতে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। দেশপ্রেমকে গেরুয়া শিবির কুক্ষিগত করার চেষ্টা করলেও আসলে তা সকলের। কার্গিল বা লাদাখ যেখানেই হোক ভারতীয় সেনার ভূমিকায় গর্ব অনুভব করে আপামর ভারতবাসী। কিন্তু রবিবারের মন কি বাতের ৩৪ মিনিটের ভাষণে একাধিকবার পাকিস্তানের নাম এলেও একটি বারের জন্যও পূর্ব লাদাখের গলওয়ানে বীর সেনাদের আত্মবলিদানের প্রসঙ্গ ঠাঁই পায়নি। যা অবাকই করে। চীনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটিবারের জন্যও কি সরব হওয়া যেত না? একথা ঠিক, বরাবরই পাকিস্তান বন্ধুত্বের বদলে ভারতের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, শত্রুতা করেছে। কিন্তু ভারত ভূখণ্ডে আগ্রাসনের অপরাধে অপরাধী চীনও। তাই একই অপরাধে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকায় এত দুমুখো নীতি বা বৈপরীত্য কেন? পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যোগ্য জবাব দিতে এতটুকু সময় নেয়নি ভারত। ঘরে ঢুকে মেরে আসারও হুঁশিয়ারি দিয়েছে। কিন্তু চীনের ক্ষেত্রে? আত্মনির্ভর ভারতের কথা বলে চীনা সামগ্রী বয়কটের যে কথা বলা হচ্ছে তা বাস্তবায়িত হল কতটা? বাস্তবে দেখা যায়, এখনও ভারতের বাজারে চীনা জিনিসেরই রমরমা।
তাই প্রশ্ন উঠবেই, চেনা শত্রুর নাম নিতে এত কুণ্ঠা কীসের? যদি এর পিছনে অন্য কারণ থাকে সে কথাও দেশবাসীর জানা উচিত। চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী কী ভাবছেন তা স্পষ্ট হওয়া দরকার। ধোঁয়াশা বিভ্রান্তি বাড়াচ্ছে।