দেশে একটা সংবিধান আছে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সংসদ আছে, অথচ ভারতীয় গণতন্ত্রের এই শক্তিশালী দুই স্তম্ভকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষণা করে দিল মোদি সরকার। বলা ভালো, করোনাকালের উদ্ভুত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নতুন শিক্ষানীতি চাপিয়ে দিল কেন্দ্র। সংবিধান অনুযায়ী শিক্ষা যৌথ তালিকাভুক্ত। অথচ রাজ্যগুলির সঙ্গে কোনও আলোচনা ছাড়াই নীরবে এই কাজ সেরে ফেলল নয়াদিল্লি। আবার বিরোধীদের সমালোচনা এড়াতে সংসদে পেশ করার আগেই ঘোষণা করে দেওয়া হল এই নীতি! এর থেকেই আশঙ্কা, এক দেশ এক ধর্মের মতো মোদি সরকার বোধহয় এক দেশ এক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চাইছে। নতুন শিক্ষানীতিতে ছত্রে ছত্রে যা বলা হয়েছে তাতে স্পষ্ট শিক্ষাক্ষেত্রে রাজ্যের ভূমিকা গৌণ হতে চলেছে। পড়ুয়াদের মনের বিকাশ বা মেধা সম্পদ তৈরি করা নয়, বরং স্কুল কলেজের প্রতিটি ধাপের পড়াশুনায় কর্পোরেটমুখী শিক্ষাপ্রদানকেই পাখির চোখ করা হয়েছে। নতুন শিক্ষানীতি কবে কীভাবে কার্যকর হবে বা তার উপযুক্ত পরিকাঠামো আছে কিনা—সেসব নিয়ে ধোঁয়াশা বিস্তর। তিন দশকের বেশি সময় পর মন্ত্রকের নাম মানব সম্পদ থেকে শিক্ষামন্ত্রকে ফিরিয়ে দিলেই ‘প্রকৃত শিক্ষার’ বিকাশ ঘটবে না। এরজন্য দরকার ছিল মানব সম্পদ তৈরি ও কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষার মধ্যে মেলবন্ধন ঘটানো। দুর্ভাগ্য, সংঘের আদর্শে পরিচালিত মোদি সরকারের শিক্ষানীতিতে তা অনুপস্থিত।
আসলে দলীয় নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই এগচ্ছে গেরুয়া শিবির। জাতীয় স্বার্থে দেশের সরকার নীতি-নির্ধারণ করবে—সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা যেন গণতন্ত্রকে সম্মান জানিয়ে হয়। গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে নয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক কিছু কাজে কর্মে ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। খণ্ডিত করা হচ্ছে রাজ্যগুলির অধিকার, যা বিপজ্জনক। নাগরিকতা আইন, এক দেশ এক রেশন কার্ডের মতোই গোটা দেশে অভিন্ন সিলেবাস তৈরির লক্ষ্যে যে পথে তারা হাঁটছে তাতে সুযোগ সন্ধানী মনোভাবই স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় তা একেবারে বেমানান। করোনাকে ঢাল করে এই সঙ্কটের দিনে তারা একতরফাভাবেই রাজ্যগুলির উপর নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি যে সময়ে চাপিয়ে দিল তখন দেশের প্রতিটি রাজ্য করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় চূড়ান্ত ব্যস্ত। বিক্ষোভ প্রতিবাদ আলোচনা সমালোচনার সুযোগও এসময়ে কম বা নেই বললেই চলে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাজ্যের অধিকারকে খর্ব করার চেষ্টা করল কেন্দ্র। উচ্চশিক্ষা পরিচালনায় নিয়ন্ত্রণ সংস্থা গড়ার যে কথা বলা হয়েছে তা কেন্দ্রীকরণেরই নামান্তর। যখন দেশের অধিকাংশ পড়ুয়া ইন্টারনেট পরিষেবার সুযোগ পায় না তখন পরিবেশ পরিস্থিতি পরিকাঠামো আছে কিনা তা বিবেচনা না করেই মোদির ডিজিটাল ইন্ডিয়ার স্বপ্নপূরণের চেষ্টা করা হল। শিক্ষায় বিপুল প্রযুক্তি ও অনলাইন শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হল। বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক কেমন পরিহাস? এতে কি ধনী দরিদ্র পড়ুয়ার মধ্যে বিভেদ তৈরি হবে না? তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে দরকার ছিল উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি করার দিকে নজর দেওয়া যা করেনি দেশের সরকার। উল্টে স্কুল শিক্ষায় (৫+৩+৩+৪) এতগুলি ধাপ রাখা হয়েছে যাতে স্কুল ছুটের প্রবণতা বৃদ্ধির আশঙ্কাও থাকছে।
সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষার বক্তব্যের মধ্যে কোনও নতুনত্ব নেই।
তা শিক্ষার মৌলিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। লজ্জার কথা যে স্বাধীনতার এত বছর পরেও দেশের সরকারকে ২০২৫ সালের টার্গেট বেঁধে
সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলতে হল। ২০২৪-এ লোকসভা নির্বাচন। নির্বাচনী বৈতরণী পেরনোর জন্য জাতীয়
শিক্ষানীতিতে এমন কিছু বিষয় আনা হয়েছে যা শাসকের আসল লক্ষ্য পূরণের সহায়ক হতে পারে। হিন্দু, হিন্দুস্তানের ধ্যান-ধারণাকে প্রাধান্য দিতে সুকৌশলে আঞ্চলিক ভাষাগুলির মধ্যে হিন্দিকে যেমন প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে ঠিক তেমনি মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার কথা বলে আমজনতার মন জয়েরই চেষ্টা হয়েছে।
জাতীয় এই শিক্ষানীতির কোনটা ভালো দিক আর কোনটা মন্দ তার চুলচেরা বিশ্লেষণ পরে হবে। নিশ্চয়ই কিছু ভালোর দিকও আছে। যেমন বৃত্তিমূলক বিষয়ে শিক্ষায় গুরুত্বদান। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারিকরণের পথ প্রশস্ত করে যেভাবে জাতীয় শিক্ষানীতি রাজ্যগুলির উপর চাপিয়ে দেওয়া হল তা একাধারে অসৌজন্য প্রদর্শন ও সুকৌশলে বিরোধী
বক্তব্য নস্যাৎ করার ঔদ্ধত্যের প্রকাশ। শিক্ষানীতি নির্ধারণে প্রথিতযশা বহু শিক্ষাবিদের বক্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগও আছে। নয়া শিক্ষানীতিতে পড়ুয়াদের মনের বিকাশ কতটা ঘটবে তা বলা শক্ত। তবে শিক্ষাক্ষেত্রে বাণিজ্যিকরণের পথ প্রশস্ত হবে। বলা যায় রাজ্যের ভূমিকাকে সঙ্কুচিত করে গেরুয়া শিবির তার বিশেষ রাজনৈতিক দর্শন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু করে দিল।