উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
কিছুদিন ধরে এই কথাটা আমি আমার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজন সবাইকে বলেছি। কী আছে একটি মিনিট মাত্র! এরকম একটা মিনিট তো ফেসবুক দেখে, অহেতুক কথা বলে, মাংসের যে হাড় কোনওদিন দাঁতে ভাঙা যাবে না, তাকে নিয়ে বা বন্ধুর বউয়ের সৌন্দর্য আর নিজের সন্তানের বুদ্ধির মিথ্যে প্রশংসা করে কাটিয়েছেন। আজ নয় আমার জন্য একটি মিনিট ব্যয় করলেন।
জানি, আমার কথায় আপনার খুব লেগেছে। অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছেন—একজন জীবিত মানুষের জন্য কীভাবে শোক পালন করবেন?
করুন না, যেভাবে মৃতমানুষের জন্য করেন। আপনার দুটি হাত দুপাশে রাখতে পারেন। বা পিছনে রেখে, চোখ স্থির বা বন্ধ করুন। মনে মনে আমাকে স্মরণ করুন। আমার আত্মার শান্তি কামনা করুন। অবশ্যই মোবাইল মিউট মোডে রাখবেন। বন্ধ করে দিলে আরও ভালো। কারণ দেখবেন, মোবাইলটা ঠিক এ সময়েই অপ্রস্তুত করে বেজে ওঠে।
এই সময়ে যদি মোবাইল ফোন মিউট বা বন্ধ না করে রাখেন হয়তো আমিই আপনাকে ফোন করে বসলাম। সবার সামনে আপনাকে অপ্রস্তুত করে দিলাম। আপনি যার কথা ভেবে শোক পালন করছেন, নীরবতায় মাখামাখি হয়ে আছেন, সে আপনাকে বেইজ্জত করছে। এমনটি হওয়া উচিত নয়।
আপনি ভাবছেন কেন আমার জন্য শোক প্রকাশ করবেন? করবেন কারণ, আমি হলাম, ফালতু! কিচ্ছু না! ধুসস!
কেন এমন হলাম জানেন, সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার। আমি যে স্কুলে পড়তাম তার নাম ছিল মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয় ফর বয়েজ। বুঝতে পেরেছেন, আমার গোড়ায় গলদ। সেই যে বালিকা বিদ্যালয় ফর বয়েজে আমি ঢুকেছি, তখন থেকে আমি কেমন যেন হয়ে গেছি। স্কুলটা ছিল ক্লাস এইট পর্যন্ত। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম অন্য স্কুল থেকে। ওই স্কুলের স্যার থেকে স্টুডেন্ট সবাই বলল—ওরা বালিকার ছাত্র!
ধুসস!
পড়লাম আর্টস। ক্লাসে ছেলে বলতে আমি আর অরূপ। অরূপ ক’দিনের মধ্যে গোপার সঙ্গে প্রেম করতে শুরু করল, তাই ও পুরুষ হয়ে গেল। আর আমি হলাম কিচ্ছু-না!তখন বিএ পড়ি। সারাদিন গোপা, সোমা, চাঁপা, অনিন্দিতা, শকুন্তলার পাশে পাশে থাকি। শকুন্তলাকে আমি চোখে হারায়, আকাশ পাতাল এক করে ভালোবাসি। আর শকুন্তলা হাঁ করে বসে থাকে অমিত স্যারের ক্লাস করার জন্য। অমিত স্যার বাংলা পড়াতেন। রবীন্দ্র সাহিত্য। অমিত স্যারের ক্লাস থাকলে যে যেখানে থাকত সব এসে জুটত। আমিও যেতাম, অমিত স্যার পড়াতেন না, কবিতার সঙ্গে গলে গলে পড়তেন। ওরা সবাই সারাদিন অমিত স্যারের কথা বলত। শকুন্তলা একদিন আমাকে বলল—ও অমিত স্যারকে বিয়ে করতে চায়। খুব কষ্ট হল। কিন্তু ভালোবাসা হল বোকা! মানুষকে অন্ধ করে দেয়। আমি পরদিন ক্লাসে উঠে দাঁড়িয়ে অমিত স্যারকে বললাম, ‘স্যার শকুন্তলা আপনাকে বিয়ে করতে চায়?’ স্যার বললেন, ‘আগে এই বিএটা পাশ করুক, তারপর অন্য-বিয়ের কথা ভাববে।’ সারা ক্লাস হো হো করে হাসছে। শকুন্তলা মুখ লাল করে বসে। আমি শকুন্তলার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি। ক্লাস শেষ হলে শকুন্তলা পারলে আমাকে মেরে শেষ করে দেয়, আমাকে পরিষ্কার বলে দিল—তুই খুব ফালতু!
আমি সেই থেকে ফালতু!
সেই আমাকে নিয়েই ফালতু-আমি আজ শোকপ্রস্তাব এনেছি। সেই শোকপ্রস্তাব আমি একটু পরেই পাঠ করে শোনাব। পাঠ করতে করতে আমার গলা কাঁপবে, আস্তে আস্তে গলা বুজে আসবে অমিত স্যারের মতো। তবুও আমি পড়ব, আমার নিজের শোক প্রস্তাব—। কেউ যদি আমাকে বলে আগে নিজে মরো, তারপর নিজের শোকপ্রস্তাব আনবে—না, আমি মুখ লাল করব না। শকুন্তলার মতো লজ্জা পাব না। ওর মন চেয়েছে, আমি বলেছি। ভালোবসার জন্য এটুকু পারব না? কিন্তু ও এত লজ্জা পাবে কেন? আমারও মন চেয়েছে—সবাইকে দিয়ে শোকপালন করাব, আমি বলেছি, আমি নির্লজ্জ হব কেন?
আমি লজ্জা পাইওনি।
একবার গোপার বাবা আমাদের আটজনকে তাঁর রয়্যাল বেঙ্গল ক্লাবে লাঞ্চ করাতে নিয়ে গেলেন। তার আগে বলেছিলেন, সবাইকে টেরিকটের প্যান্ট পরতে হবে। আর ফুল শার্ট। আমি স্কুলের সাদা শার্ট পরে গিয়েছিলাম। বেশ লাগছিল। এখনকার দিন হলে সেলফি তুলে রাখতাম। ফেসবুকে দিলে বহুত লাইক পেতাম। তখন মোবাইল ছিল না, মোবাইল-ক্যামেরাও নয়। সারা টেবিল জুড়ে তিনটে তিনটে উইকেটের মতো করে ছুরি কাঁটা চামচ সাজানো। বসে আছি। গোপা বলল—কন্টি! আমি আমার ফুলশার্ট জামার একটা হাতা খুলে গুটিয়ে রাখলাম। এত ছুরি কাঁচি যখন কেটেকুটে খেতে হবে। তেল ঝোল লেগে যেতে পারে। খাবার আগেই দেখলাম টেবিলের ওপর সাদা বাটিতে সাদা সাদা সাবান রেখে গেল। বসে আছি। আমি অনিন্দিতাকে বললাম, ‘কী হাইজিনিক দেখেছিস, খাবার আগেই সাবান দিয়ে গেল। হাত ধুয়ে খেতে হবে।’ অনিন্দিতা আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। সবাই বসে আছি। হঠাৎ আমার কী মনে হল, এবার গোপাকে বললাম, ‘এই গোপা সাবান দিয়ে গেল, জল কোথায়?’ গোপা বলল, ‘সাবান! সাবান কোথায়?’ আমি সাদা বাটি দেখালাম। গোপা মুখ লাল করে বলল, ‘ধুসস—ওটা বাটার!’ সবাই হো হো করে হাসছে। ব্রেড এসে গেল। সবাই ব্রেডে বাটার লাগিয়ে খেল। আর আমি, ব্রেডে ধুসস লাগিয়ে খেলাম! না, আমি লজ্জা পাইনি। তারপরেও জীবন চলছে। সাঁতার জানি না, কিন্তু দিঘা পুরী সব সমুদ্রে হুটোপাটি করেছি। সাইকেল চালাতে পারি না, তাতে কি সাইকেলের সামনে পিছনে বসে গলি থেকে রাজপথ চষেছি। অরূপ খুব খেটে খুটে একটা সরকারি চাকরিও জুটিয়ে ফেলেছে। সোমা, চাঁপা, অনিন্দিতা, শকুন্তলার মতো মেয়েদের বাবারা নাকি ওকে বাবাজি বাবাজি করছে বিয়ের জন্য। না, গোপার বাবার মতো লোকেরা লাইনে নেই। গোপা অরূপকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে। ওর বর বড় ডাক্তার। অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। তবে অরূপও কম যায় দারুণ সুন্দরী একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে। বউ নিয়ে বেরুলে আমার সঙ্গে কথা বলে না। আমিও তাকাই না। সবাই ভালো আছে। ‘ভালো আছি ভালো থেকো/আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।’ এই গানটা আমার খুব প্রিয়, দোকানে বাজাই।
আমি এখন গড়িয়া মোড়ে লটারির টিকিট বিক্রি করি। তবে অরূপ মাঝে সাঝে আসে, দুজনে চা খাই। আমার সঙ্গে সবার যোগাযোগ আছে। এই তো গোপার বাবা আমার কাছ থেকে প্রায় টিকিট কেনে। পুরো সিরিজ কেনে। একবার পঁচিশহাজার টাকা লেগেছিল। আমাকে একশো টাকা দিতে চেয়েছিল মিষ্টি খেতে। আমি নিইনি। শুধু বলেছিলাম, ২৫ হাজার টাকা নিয়ে কী করবেন অ্যাঙ্কেল?
—ইডিয়ট!
উনি চলে গেলেন। কাস্টমার ইজ কাস্টমার। সত্যিই আমি ইডিয়ট। ভুল করেছি। উনি চলে যেতে আমি ওনার যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে তিনবার কান মলা খেয়েছি। আর কোনওদিন কাউকে জিগ্যেস করব না।
কিন্তু তা বললে কি হয়, আমি না বললেও কেউ কেউ বলে। নিজেই বলে। এই যেমন, প্রত্যেকবার সপ্তাহে একটি করে টিকিট কেনে একটা আধময়লা বুড়ো। কোনওদিন নাম জানতে চাইনি। একদিন টিকিট কেনার পর ঝেঁপে বৃষ্টি এল। আমার দোকানের গায়ে এসে সেঁটে দাঁড়াল। আমি একটা চা খাওয়ালাম। একথা সেকথা হচ্ছে। হঠাৎ বুড়ো আমাকে বলল, ‘আচ্ছা তোমার দোকান থেকে কেউ কোনওদিন একলক্ষ টাকা পেয়েছে?’ প্রশ্ন শেষ করার আগেই আমি ঝপাত করে ঘাড় হেলিয়ে দিলাম। ‘পেয়েছে মানে, তিন তিনবার লাখ মেরেছি। একবার দশ লক্ষ। বাম্পার। এই আমার কাউন্টার থেকে।’ বুড়ো আমার কথা শুনে কপালে হাত ঠেকাল, বলল, ‘আমার এক লক্ষ টাকা হলেই হবে। বেশি চাই না, তাহলে বুড়িটার ব্যবস্থা করে ফেলি।’
আমি বুড়োর কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না। বললাম, ‘একটু ঝেড়ে কাসুন স্যার!’
বুড়ো বলল, ‘বারাসাতের দিকে একটা ভালো বৃদ্ধাশ্রম আছে বুঝলে, এক লপ্তে একলক্ষ টাকা দিয়ে দিলে সারাজীবন ওরা রেখে দেবে। বুড়িটাকে পাঠিয়ে দিতাম। বুড়ির খাওয়াদাওয়া, চিকিৎসা, টিভি, সুখে থাকবে। এখানে বড় অশান্তি, বড্ড অপমানের জীবন। ছেলে-বউয়ের সংসারে ঝিগিরি করেও, ওদের মন পোষাতে পারছে না, অসুস্থ মানুষ, খুব কথা শুনছে—।’
আমি বিড়বিড় করি, ‘আর আপনার? আপনার কি ব্যবস্থা করবেন?’
বুড়ো হাসল, ‘ধুসস! আমার আবার কি? আমি ফালতু! ইডিয়ট! আমি আমার কথা ভেবেই রেখেছি। পাঁচ টাকায় সেরে ফেলব। না, না, অফিসযাত্রীদের বিব্রত করব না। দেড়টা থেকে দুটো। মাহেন্দ্রক্ষণ বুঝলে। ঘরদোরে ঝামেলা থাকল না।’ বুড়ো হাসল, আর মাথার ওপর দিয়ে ঝমঝম করে মেট্রোরেল চলে গেল।
বুড়ো চলে গেল, ওর একলক্ষ টাকার দরকার বুড়ির জন্য, নিজের জন্য পাঁচ। আমি লটারির টিকিটগুলোতে হাত বোলাই—একটা লাকি নম্বর চাই। পাইনি। পাব কী করে, লটারির টিকিট বিক্রি করলেও, আমি লাকি নম্বর জানি না। জানার যোগ্যতা আমার নেই। আসলে, আমি ফালতু, কিচ্ছু-না, ধুসস!
বিশ্বাস করুন, তারপর থেকেই আমি আমার জন্য এই শোকপালনের প্রস্তাব নিয়ে ঘুরছি। আমি মানে, আমরা, ওই বুড়ো, ওই বুড়ি, এই ধুসস, কিচ্ছু-না, ফালতু, ইডিয়টদের জন্য এক মিনিট শোকপালন করতে হবে স্যার। আমি জানি, আমরা যেভাবেই মরি তাতে আপনাদের একটু হলেও অসুবিধে হবে। তাই তার আগে আপনাদের দিয়ে আমি আমাদের শোকপালন করিয়ে নিতে চাই।
মাত্র একমিনিটের নীরবতা! দয়া করে মোবাইল অফ করবেন। আসুন, শুরু করা যাক। শুরু—