উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
হাঁক পারতেন বাবুর্চিকে বোলাও
বসে বসে দিলে গড়গড়াটিতে টান
রান্না হতো যে বিরিয়ানি দশ বারো খান
কর্তা বলেন আজ গিন্নিকে ডাকি
বাজার করব বল গো বিরিয়ানি রাঁধবে নাকি?
সে অনেক দিন আগের কথা। ভারতে তখনও ইংরেজদের রাজত্ব চলছে। বড়লাটের দাপটে ভারতীয়দের ওষ্ঠাগত প্রাণ। তবু বনেদি জমিদারি বাড়িতে নববর্ষের খাওয়া দাওয়ার ধুম লেগেই থাকত। সাবেকি বাঙালি ভোজ তো হতোই পাশাপাশি থাকত বিদেশি কিছু পদও। সেই সময় কয়েক পদ ইংরেজি রান্না ছাড়া বাঙালি উৎসব সম্পন্ন হতো না। তবে সেই সব রান্না বেশিরভাগই বাঙালি কেতায় রাঁধা হতো। বনেদি বাঙালি বাড়িতে বয় বাবুর্চি দিয়ে রান্না করানোর চল ছিল। তাঁরাই একেকজন একেকরকম বিদেশি রান্নায় হাত পাকাতেন। অনেক সময় বাড়ির গিন্নি বাঙালি পদ রাঁধলে বিদেশি ডেজার্টের ছোঁয়া আনতে বিদেশি রান্নায় পটু বাবুর্চির ডাক পড়ত হেঁশেলে। শুধু যে শেষ পাতের ডেজার্ট তাও নয়, নববর্ষে নতুন রকম শরবত থেকে শুরু করে স্বাদ বদলাতে বা বিদেশি অতিথি আপ্পায়নের জন্য স্টু, স্যুপ গোছের কিছু পদও এইসব বাবুর্চিদের দিয়ে রাঁধানো হতো।
নববর্ষ চিরকালই ব্যবসায়ীদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। নতুন হাল খাতা, নানা রকম মিষ্টান্ন সহ জমজমাট আয়োজন। পুরনো কলকাতায় সেই হালখাতার আয়োজনে মিষ্টিতে বিদেশি ছোঁয়া পাওয়া যেত না। সবই বাঙালি মিষ্টি। কড়া পাকের সন্দেশ, নরম পাকের জলভরা, কাঁচা গোল্লা, গোলাপ পাপড়ি সন্দেশ, আমের ফ্লেভার যুক্ত হালকা সবুজ আম সন্দেশ, রসগোল্লা, ছানার পায়েস, পান্তুয়া... বাঙালি মিষ্টির তালিকা যেন শেষই হতে চাইত না। সেই সময় হালখাতার মিষ্টির সঙ্গে নোনতা দেওয়ার রীতি ছিল না বললেই চলে। কখনও যদিও বা নোনতার আয়োজন করা হতো, সেই নোনতাতেও বাঙালিয়ানার ছোঁয়া। এই যেমন নিমকি, বাঙালি শিঙাড়া ইত্যাদি। তবে শরবত অবশ্যই দেওয়া হতো। শরবতে তালিকাতেও বাঙালি নামের ছড়াছড়ি। ডাবের মালাই শরবত ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। এছাড়াও গ্রীষ্মের দহন দিনে প্রাণ জুড়নো আম পোড়ার সরবত, লেবু চিনির মিষ্টি শরবত, লিচুর শরবত, ভাজা মশলার শরবত ইত্যাদির কদরও কিছু কম ছিল না। ব্যবসায়ীরা নিজের সামর্থ্য মতো খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করতেন।
কিন্তু বাঙালি গৃহস্থ বাড়িতে কেমন ছিল নববর্ষের আয়োজন? সাধারণ মধ্যবিত্ত থেকে বনেদি পরিবার সর্বত্র বাঙালিয়ানার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকত খাওয়াদাওয়া। সেই রেওয়াজ বাঙালি আজও ছাড়তে পারেনি। খাবারের ধরন অবশ্য যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রচুর বদলেছে। সাবেককালে বাঙালি বাড়িতে উৎসবের মহাভোজে কালিয়া ও পোলাওয়ের প্রচলন ছিল। পেঁয়াজ, রসুন ও আদা বেটে রসঘন করে রান্নাকেই সেই সময় কালিয়া বলা হতো। এই কালিয়ার প্রচলন কিন্তু বাঙালি হেঁশেলে মুসলিম আমল থেকেই চলে আসছে। তবে বাঙালি হিন্দুরা সেই কালিয়ার ধরনটা সামান্য বদলে নিয়েছিলেন। অবাঙালি বা মুসলিম ঘরানায় কালিয়া বলতে শুধুই মাংস বোঝানো হয়। কিন্তু হিন্দু ঘরে আমিষ ও নিরামিষ দুই রকম কালিয়াই প্রচলিত। আমিষের মধ্যেও আবার আমরা মাংস ছাড়া মাছেরও কালিয়া বানাতে অভ্যস্ত। এছাড়াও নিরামিষ কালিয়ার সব্জির মধ্যে এঁচোড় খুবই জনপ্রিয়। এই কারণেই বোধহয় বাঙালিদের কাছে এঁচোড় গাছাপাঁঠা নামেও পরিচিত। আর পোলাও অর্থাৎ ঘিয়ে ভেজে ভাত রান্না। একটু মিষ্টির পরিমাণ এই রান্নায় বেশিই থাকে। তার সঙ্গে নানা রকম মোগলাই মশলা যুক্ত হয়ে এক অন্য ধরনের স্বাদ আসত রান্নায়।
আগেকার দিনে পোলাও বলতে ঘি ভাতকেই বোঝানো হতো। আজকাল অবশ্য অনেকেই ঘি চপচপে পোলাও খেতে চান না। কারও সামর্থ্যে কুলোয় না কেউ বা হজম হবে না ভেবে খান না। তাই পোলাওয়ের পরিবর্তে বাঙালি হেঁশেলে এখন ফ্রায়েড রাইস জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অল্প তেলে নানা ধরনের সব্জি দিয়ে রাঁধা হয় ফ্রায়েড রাইস। কিন্তু সাবেকি বাঙালি পরিবারে ফ্রায়েড রাইসের কোনও চলই ছিল না। সে যাই হোক, কথা হচ্ছিল সাবেকি কলকাতা বাঙালি হেঁশেলের মহাভোজ নিয়ে। ব্রিটিশ রাজত্বে দুই বাংলা যখন এক ছিল তখনও ওপার বাংলার খাওয়াদাওয়ার জমক এপার বাংলার চেয়ে বেশিই ছিল। আমিষ ও নিরামিষ দু’ধরনের পদই সেই সময় বাঙালি হেঁশেলে জনপ্রিয় ছিল। তার আগে, অর্থাৎ মোগল আমলে কিন্তু রান্নায় মাংসের পদই বেশি থাকত।
বাঙালি নববর্ষের মেনু শুরু হতো শাক সহ আরও বিভিন্ন ধরনের তরি তরকারি ভাজা দিয়ে। এরপর আসত নিরামিষ পদ। সর্ষে, পোস্ত, ডাল, দুধ, বড়ি ইত্যাদিতে মজিয়ে রাঁধা হতো নিরামিষ সেইসব পদ। একটু উদাহারণ দিলেই স্পষ্ট হবে। যেমন মানকচুর মরিচ বাটা, মটরডালের পাটভাজা, গন্ধ ভাদালির ঝাল, ঝাল রসা, মটরডালের চচ্চড়ি, ছানা দিয়ে মুগডালের চিলোয়া, ছানার কাটলেট, ছানা মগজ সহ অগুন্তি পদ। এছাড়াও অনেক বাড়িতে, বিশেষত বাঙাল বাড়িতে নিরামিষ তরকারি দিয়ে মাছ রান্নার রীতি ছিল। পুঁটিমাছ করলা দিয়ে তেতো চচ্চড়ি, শিম বেগুন ট্যাংরার ঝাল, শোলমাছ ও মুলোর কালিয়া ইত্যাদি। তবে নববর্ষে বা অন্য অনুষ্ঠানে এমন পদের প্রাধান্য কম ছিল। সেখানে থাকত জমকালো আমিষের আয়োজন। যেমন রুই মাছের টিকলি কালিয়া, ভাজা ঝালের চিংড়ি মাছ, চিতল গাদার জল বড়ার কালিয়া, যা পরে চিতল মাছের মুইঠ্যা নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এছাড়া কিছু কিছু বনেদি বাড়িতে আবার আমিষ পদে সামান্য মোগলাই ছোঁয়া আনতে চিজ শিক কাবাব, মাটন নার্গিস কাবাব, গুলি কাবাব, চিজ মাটন কাটলেট জাতীয় পদও রাঁধা হতো। বিদেশি শরবতের মধ্যে যেমন ছিল ফ্রুট ডিলাইট মকটেল, চিয়ার আপ মকটেল, টোম্যাটো মকটেল, জিরা লেমনেড ইত্যাদি। স্যুপ, স্যালাডের আয়োজন অবশ্য সাবেককালের নববর্ষের মহাভোজে থাকত না। তবে কখনও যদি একাধিক মাংসের পদ রাঁধা হতো তাহলে তারই একটা হতো মাটন স্টু। বিভিন্ন সব্জি দিয়ে মাংসের হালকা ঝোল। স্টুয়ের সব্জির ধরন অবশ্যই আলাদা। বিনস, গাজর, পেঁপে, আলু, পেঁয়াজ ও টোম্যাটো দিয়ে তৈরি হতো স্টু। এই রান্নার ফোড়নও সম্পূর্ণ ভিন্ন। গোটা গোলমরিচ, রসুন ও আদা কুচি দেওয়া হতো ফোড়নে।
নিরামিষের মধ্যে মাছের পাশাপাশি বাহারি মাটনের আয়োজন অবশ্যই থাকত। মাংসের মধ্যে কচি পাঁঠার বাঙালি ঝোল যেমন হতো তেমনই মুসুর গোস্ত, কালেজি দমপক্ত, শাহী মুরগা কোর্মা ইত্যাদিও হতো। পুরনো কলকাতায় নববর্ষের খাওয়া দাওয়ার আয়োজনে বিরিয়ানি রাঁধার রীতি ছিল না। বিরিয়ানি ছিল মুসলমানি রান্না। তাই বাঙালি হিন্দুদের উৎসবে সেই পদ কখনওই হতো না। বাঙালি হিন্দু পরিবারেও, বিশেষত জমিদার বা বনেদি পরিবারে, মাংসের পোলাও রাঁধা হতো। সেই পোলাওয়ের জন্য হাড় ছাড়ানো মাংসের সঙ্গে জায়ফল, জয়ত্রী, গরম মশলা, শাহী মশলা ও প্রচুর পরিমাণে ঘি আনানো হতো। শেষ পাতের জন্য দেশি বিদেশি সব ধরনের মিষ্টিরই আয়োজন থাকত। লাউয়ের বরফি, মালপোয়া, গোলাপজাম, আতার রাবড়ি, দুধ গাজরের হালুয়ার পাশাপাশি আবার ব্যানানা ডেজার্ট, মিল্ক বরফি, আপেল স্নো পুডিং, চকোলেট পুডিং, চায়না গ্রাস স্পেশাল পুডিং ইত্যাদিও বানানো হতো। তবে শেষ পাতে কুলফি বা আইক্রিমের প্রচলন ততটা ছিল না। কুলফি অবশ্য পরবর্তীকালে বনেদি বাড়ির নববর্ষে ভোজের অঙ্গ হয়ে ওঠে। জাফরানি কুলফি, দুধ মালাই কুলফি, মেওয়া কুলফি, বাদাম কুলফি, পাকা আমের কুলফির পাশাপাশি একটু ইংরেজি কেতা দূরস্ত পরিবারে ভ্যানিলা কুলফি, চকোলেট কুলফি, রোজ কুলফি ইত্যাদিও পরিবেশন করা হতো।
যুগের বদলের সঙ্গে বাঙালি খাওয়াদাওয়া আজ অনেকটাই পরিবর্তিত। এখন নববর্ষ থেকে শুরু করে অন্যান্য বিভিন্ন উৎসবের আয়োজনে বাঙালি পরিবারে হোটেলে খাওয়ার রীতি প্রচলিত। ঘর ও বাইরে একইসঙ্গে সামলানোর পর বাঙালি বধূরা আজ আর পঞ্চব্যঞ্জন রাঁধার ঝক্কি নিতে চান না। এখন তো বহু পরিবারে জামাইষষ্ঠীর আয়োজনও শাশুড়ি মা হোটেলেই সেরে ফেলেন। এছাড়াও নব্য যুগের বাঙালি আজ দেশির চেয়ে বিদেশি খানাপিনায় বেশি অভ্যস্ত। পরোটার বদলে তাই পিৎজার চল। তবু পুরনো কলকাতার পঞ্চব্যঞ্জনের গপ্পো আজও বাঙালি পরিবারে সমহিমায় উপস্থিত।