উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
ফেসবুক আসলে জলের মতন। যে পাত্রে ঢালা হয় তার আকার নেয় । মানে ফেসবুক বাঙালির কি কাজে লাগে, এর একটা উত্তর হয় না। যার যেমন দরকার ফেসবুক সেভাবে তার কাছে মেলে ধরে। যাদের জীবনে খেয়েদেয়ে কোনও কাজ নেই তাঁদের কর্মসংস্থানের সেরা ঠিকানা ফেসবুক। সারাদিন লাইক, শেয়ার করতে থাকুন। অবান্তর ছবি, ভিডিও ইত্যাদি পোস্ট করতে থাকুন। আর যদি পেটে কবিতা থাকে তাহলে তো কেল্লা ফতে! যত কঠিন কবিতা, যত বেশী অর্থহীন তত বেশী ‘মন ছুঁয়ে গেল’ পাবলিকের ভিড়। যিনি পোস্ট করছেন তিনি যদি লেখিকা হন তাহলে কিছু পুরুষ পাঠক একটু বেশীই প্রশংসা করেন। সেক্ষেত্রে বিড়াল নিয়ে পচা আদিখ্যেতাও কবিতা হয়ে যায় ! কিছুদিন এসব করার পর মেসেঞ্জারে –‘আপনি কি বেহিসেবি হতে চান’, ‘তোমার আঁচল পেতে দাও , আমি নাক মুছব’! ছোটগল্প হয়তো শেষ হয়েও হইল না শেষ। কারণ, সেখানে কুপ্রস্তাব থাকে না । কিন্তু, ফেসবুকের অনেক ছোট গল্প কুপ্রস্তাবে শেষ হয় । তারপর স্ক্রিনশটের তাস পড়তে থাকে । লেখকদের মহা জ্বালা । কারণ , বহু লোক কিছু লিখে তাঁদের পড়তে দেন। লেখকের দোষ তিনি কিছু মানুষের মনের কথা বলে ফেলেছেন! এর থেকে তিনি খাল কেটে কুমির আনলে বেঁচে যেতেন। কারণ , কুমীর ফেসবুক করে না , সে লেখাপড়া জানে না । কিন্তু, লেখক খাল কেটে পাঠক এনেছেন! এমন পাঠক যে লেখক হতে চায় । কারও স্বামী বাইরে থাকে বলে সময় কাটে না , কারও পায়ে হাজা , কারও পেটে গুড় গুড় , কারও শ্যালিকার বিয়ে হচ্ছে না , এসব কথা লেখককে জানাতে থাকেন কবিতা বা গদ্যের মাধ্যমে ।
আরও একটা মজা আছে ফেসবুকে। এখানে সবাইকেই সুখী মনে হয় । কেউ বিদেশে বউয়ের সঙ্গে সেকেন্ড হনিমুন করছেন, কেউ আমেরিকায় ফুলবাগানে মৌমাছির সঙ্গে সেলফি তুলছেন, কেউ ছেলে পুলে নিয়ে মায়ার সংসার করছেন । কারও জীবনে একটুও দুঃখ নেই । সেই দেখে বাকিরা ভাবে, ওরা কেন এতো সুখী! আর আছে খাবারের ছবি। আজ অবধি কখনও কোনও খাবারের ছবি খারাপ উঠেছে বলে অভিযোগ ওঠেনি । গোবরে পটাসিয়াম সায়ানাইড মিশিয়ে উপরে চেরি আর সাদা ক্রিম ছড়িয়ে দিয়ে সেটার ছবি পোস্ট করলে , কত লোক বলবে –‘আহা , জিভে জল এসে গেল । খুব লোভ দিলাম।’
তবে ফেসবুকে সবচেয়ে সাঙ্ঘাতিক হল বিপিও কর্মীরা । মানে বিশ্ব পাকা অরগ্যানাইজেশনের কর্মীরা । এরা জীবনে ঠিক কী চায়, বোঝা যায় না । তবে কঠিন কঠিন সব ব্যাপার পোস্ট করে । এরা একটা গোষ্ঠীতে থাকে । যে গোষ্ঠীর সকলেই পাকা এবং সব জানে ও বোঝে । এরা নিজেদের গোষ্ঠী বাদে বাকিদের খুব একটা পাত্তা দেয়না ।
যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন, ফেসবুক বাঙালির জীবনে কি করেছে, তাহলে তার উত্তরে বলতে হয় যে ফেসবুক বাঙালির জীবনের দাম খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছে । সংসারে অশান্তি , গার্লফ্রেন্ড ভাট বকে আর সারাক্ষণ ব্রেকআপ করে মাথার ঘিলুর চচ্চড়ি বানিয়ে দেয়, বস সারাক্ষণ অপমান করে, পটলের পেট টিপে কেনার সময় সব্জিওয়ালা গাল দেয় কিন্তু ফেসবুকে আপনি কবিতা পোস্ট করলে প্রজ্ঞাপারমিতার মন ছুঁয়ে যায়, ইপ্সিতা আঁতেলের চোখে জল আসে। জীবন আপনাকে যতই নিমেরপাঁচন গেলাক, আপনার ফেসবুক পোস্টে কয়েকশো লাইক আর ফেক অ্যাকাউন্ট নিঃসঙ্গ মানুষের সঙ্গে মেসেঞ্জারে আলাপচারিতা আপনার জীবনের ভ্যালু আপনার কাছেই বাড়িয়ে দেয়। কেমন একটা লেখক লেখক ভাব, আপনার মধ্যে একটা কেউকেটা সত্ত্বার জন্ম দেয় । এটা আপনাকে খানিকটা সুখ দেয়। তীব্র গরমে বিকেল আর সন্ধ্যার সন্ধিক্ষণে অজানা উৎস থেকে ভেসে আসা ঠাণ্ডা বাতাসের মতন । তবে লাইক পাবার লোভে অনেকেই ছুটছে । এখানেও এক ইঁদুর দৌড় ! যারা লাইকে ভিজেছিল তাঁরা বেঁচে গিয়েছে । যারা লাইক পায়নি, তাঁরা লড়ছে । নিজের পোস্টের সঙ্গে কয়েকজনকে ট্যাগ করছে , যাতে তাঁদের ভাগের লাইকগুলি ওঁর নিজের কপালে জোটে । তবে বাঙালির জীবনে ফেসবুক না থাকলে কয়েক হাজার যমের অরুচি কবিতা কম লেখা হতো ।
লেখার শেষে ফেসবুকে লেখা চুরি নিয়ে দু’চার কথা বলতে ইচ্ছে করছে । একটু আগে বলছিলাম,ফেসবুক আপনার মূল্য খানিকটা বাড়িয়ে দেয়। আপনার মূল্য বেড়ে যেতে দেখে অন্য কারও ইচ্ছে হতেই পারে যে তাঁরও মূল্য এবার খানিকটা বাড়ুক। এই ইচ্ছের বশবর্তী হয়ে সবাই যে কবিতা, গদ্য, ছবি (সবই খারাপ) পোস্ট করতে শুরু করেন তা কিন্তু নয় । একটা সহজ রাস্তা আছে । ‘চুপচাপ , লেখা ঝাঁপ’। চুরি করে নাও । ধরুন আপনি যাদবপুরে বসে ‘যদু’ নামে একটা লেখা পোস্ট করলেন । সেই লেখা দিব্যি ঝেড়ে ‘টুম্পা’ নাম দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করে দিলেন মেদিনীপুরের কেউ। আপনি জানতেই পারলেন না। অনেক সময় আপনার কোন ফেসবুকবন্ধু দেখে ফেলেন যে আপনার লেখা ঝেড়ে কেউ নাম কিনছে। লেখাচোরকে চেপে ধরলে তিনি পৃথিবীর সব চোরের মতন উত্তর দেন – ‘আমি চুরি করিনি।’ কেউ কেউ দাবি করেন যে একই লেখার আইডিয়া তাঁর মাথাতেও এসেছে । শুধু আইডিয়া এসেছে তা নয় , আইডিয়ার সঙ্গে একই রকম বাক্য, একই জায়গায় জায়গায় দাড়ি ,কমা,ড্যাশ, সেমিকোলন ফুল ফ্যামিলি এসেছে । এই তো সেদিন এক লেখাচোরকে চেপে ধরতে তিনি আবার দাবি করলেন, ‘ওই লেখা তারই । যাকে আসল লেখক বলে ভাবা হচ্ছে তিনিই আসলে চোর।’ আসল লেখা পোস্ট হয়েছিল ১৮ ই মার্চ , আর চোর সেই লেখা ঝেড়ে পোস্ট করেছে ২৩ শে মার্চ । তবু চোরের দাবি তারই লেখা চুরি হয়েছে । হয়তো আসল লেখক টাইম মেশিনে চড়ে প্রথমে ফিউচারে গিয়ে ২৩ তারিখ চোরের লেখা ঝাড়ে, তারপর আবার অতীতে ফিরে ১৮ তারিখ ফেসবুকে নিজের ওয়ালে সেই ঝাড়া লেখা পোস্ট করে । লেখাচোর বোধহয় এরকম কিছু একটা বলতে চাইছিলেন !