উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
স্মৃতিপটে আঁকা ছবি, ঝরা পাতা অমলিন।
আমার পিতৃদেব রামকুমার চট্টোপাধ্যায় সারা বছরে কোনওদিন বাজারে যেতেন না। কিন্তু পয়লা বৈশাখের দিন সকাল সকাল বাবা বাজার করতে যেতেন। বিভিন্ন রকমের মাছ কিনে আনতেন। বড়, ছোট কোনও মাছ বাদ থাকত না। আর বেজায় মুশকিলে পড়তেন মা। স্বাভাবিকভাবে রেগেও যেতেন কারণ রান্না সেই মাকেই তো করতে হতো। মজাটা হল এইখানে যে মায়ের ভারমুখ তাঁকে দেখতে হবে বাবা সেটা বিলক্ষণ জানতেন। কিন্তু পিছনে হাতে করে লুকিয়ে একটা শাড়ি নিয়ে আসতেন। লাল পাড় শাড়ি। বাবা জানতেন মা ওই একটি জিনিস পেলেই গলে জল হয়ে যাবেন। আমার মা ঘোমটা দিয়ে শাড়ি পরতেন। ঠাকুমা, দিদিমা ওভাবে পরতেন। পয়লা বৈশাখের দিন বাড়িতে নানা পদে রান্না হতো। বহু তাবড় তাবড় শিল্পী অনিল বাগচি থেকে শুরু করে জগন্ময় মিত্র কেউ বাদ থাকতেন না। সকলে আসতেন। সারাদিন ধরে গান বাজনা, খাওয়া দাওয়া চলত। সেই সকালে চা দিয়ে শুরু। একটু বেলা গড়ালে শরবৎ, তারপর দুপুরলো বিশাল খাওয়া দাওয়া— শুক্তো, মাছের মাথা দিয়ে ডাল, মাছভাজা, মাছের ঝোল, টক সব মা রান্না করতেন। যাঁরা আসতেন বাবা তাঁদের প্রত্যেককে নতুন জামাকাপড় দিতেন। হইহুল্লোড় চলত। আজকের দিনে আর সেসব দেখি না। আমারও তো প্রায় ৭০ বছর বয়স হল। আমার মনে হয় বাংলা নববর্ষের বদলে এখন ইংরেজি বর্ষশুরুর দিনটাতেই বাঙালিরা বেশি মাতামাতি, আমোদ আহ্লাদ করে। বিদেশি ইনস্ট্রুমেন্ট দিয়ে গান হয় এখন। সবকিছুই কেমন বদলে যাচ্ছে। বাবা যেমন তবলা, হারমোনিয়াম নিয়ে গান করে এসেছেন এখন সেসব প্রায় বিরল। পুণ্যাহ বলে আলাদা করে কিছু নেই, বাংলা ক্যালেন্ডারে নববর্ষ আলাদা করে থাকে বটে কিন্তু ক’জন বাঙালি সেটা মানে!
আমার বাবার মামার বাড়ি হল সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বাড়ি। আমার ঠাকুরমা ওই বাড়ির নাতনি। ওই বাড়ি থেকেই ঠাকুরমা দুটি জিনিস তুলে এনেছিলেন। একটি দুর্গাপুজো। আর দ্বিতীয়টি হল পুণ্যাহ। আমাদের বাড়িতে এখনও এইদিন কেউ এলে তাঁদের অভ্যর্থনা করতে থালায় ফুল, মিষ্টি থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাঙালির বাঙালিত্ব তো দিন দিন তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। আমরা এখনও যারা ধুতি পাঞ্জাবি পরা বাঙালি, আমরা সেই ব্যাপারটা বাঙালিদের মখ্যে আর দেখতে পাই না। শিল্পীরা সবাই ধুতি পাঞ্জাবি পরতেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্রদা, সতীনাথদা, আমার বাবা সকলেই ধুতি পাঞ্জাবি পরতেন। দেখা হলে সকলেই আড্ডায় মেতে উঠতেন। রসিকতা চলত সারাদিন। সন্ধেবেলা গানের আসর বসত বিভিন্ন রাজবাড়ি বা জমিদার বাড়িতে। বাবা বাজার রেখে প্রতি বছর বাগবাজারে মায়ের বাড়ি গিয়ে নিজের আপনমনে গাইতেন। কে শুনল না শুনল, বাবা গ্রাহ্যই করতেন না। মাকে গান শোনাতেন। কোনও বছর বাদ যায়নি। মারা যাওয়ার আগে বছর দুই আর যেতে পারেননি। এটা আমাদের বাড়ির ট্র্যাডিশন ছিল। আমিও সেই ধারা বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু এখন তো রামকৃষ্ণ মিশনের অনেক রীতি-নীতি হয়েছে। এখন আর অনুমতি পাওয়া যায় না। পয়লা বৈশাখ নিয়ে নানা ধরনের গান লেখা হতো। নিধুবাবু গেয়েছেন, গোপাল উড়ে, দাশরথি রায় এই নিয়ে নানা গান লিখে গিয়েছেন। লেখা শুরুর গানটিও দাশরথি রায়ের লেখা । শোভাবাজার রাজবাড়ি, হাটখোলা দত্তবাড়ি বা মার্বেল প্যালেসে বাবার ডাক পড়ত। গানের আসরে বাবার সঙ্গে থাকতেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। সঙ্গে রাধাকান্ত নন্দীর তবলা। কণ্ঠসহযোগিতায় আমিও থাকতাম। এরকম আসর দিনের পর দিন আমার দেখা। ওগুলো আজকের দিনে খুব মিস করি।