উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
স্মরণ করি, কবি-দার্শনিক রবীন্দ্রনাথের উক্তি— ‘আজ যেখানে বর্ষশেষ, কালই সেখানে বর্ষারম্ভ— একই পাতার এ পৃষ্ঠায় সমাপ্তি, ও পৃষ্ঠায় সমারম্ভ— কেউ কাউকে পরিত্যাগ করে থাকতে পারে না। পূর্ব এবং পশ্চিম একটি অখণ্ড মণ্ডলের মধ্যে পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে, তাদের মধ্যে ভেদ নেই বিবাদ নেই— একদিকে যিনি শিশুর আর একদিকে তিনিই বৃদ্ধের। একদিকে তাঁর বিচিত্র রূপের দিকে তিনি আমাদের আশীর্বাদ করে পাঠিয়ে দিচ্ছেন, আর একদিকে তাঁর স্বরূপের দিকে আমাদের আশীর্বাদ করে আকর্ষণ করে নিচ্ছেন। ...সমস্তই যেখানে ফুরিয়ে যাচ্ছে সেখানে দেখছি একটি অফুরন্ত আবির্ভাব।’
সব দেশেই আছে নববর্ষবরণ, মাস বা দিনের বিভিন্নতায় এক এক নামে তার পরিচিতি। সেদিক থেকে মানবিক সংহতির এটিও একটি দিক।
বাংলায় ঠিক কবে থেকে চলে আসছে এই নববর্ষবরণ উৎসব, এর উত্তর পাওয়া কঠিন। মুঘল বাদশাদের আমলের প্রথম দিকেও বাংলায় নববর্ষ বলে কিছু ছিল না।
প্রকৃতপক্ষে বাংলা বর্ষপঞ্জির সূচনালগ্ন নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কারও মতে, রাজা শশাঙ্কর আমল থেকেই বঙ্গাব্দ চলে আসছে, কেউ মনে করেন সম্রাট হোসেন শা’র আমলেই এর সূচনা। অন্য একটি মত অনুসারে তিব্বতি শাসক স্রংসন গাম্পোর নাম থেকেই বাংলা সন-এর উৎপত্তি। আবার অনেকের ধারণা, বাংলায় নববর্ষ উৎসব শুরু হয় অনেক পরে, ইংরেজ আমলে, ইংরেজি নববর্ষের অনুকরণেই এই উৎসব।
অধিকাংশ ঐতিহাসিক অবশ্য সন, তারিখ আর সময়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সম্রাট আকবরকেই এর প্রবর্তকের সম্মান দিয়েছেন। মহামতি ছিলেন বলেই আমরা দেখি, তাঁর শাহী দরবারে সবেবরাত, ঈদ ইত্যাদির সঙ্গে হিন্দুদের দেওয়াল, দশেরা, শিবরাত্রির মতো উৎসবও চালু করেছিলেন তিনি। আমাদের দেশে তিনিই প্রচলন করেছিলেন পারস্যের নওরোজ-এর মতো নববর্ষ উৎসব। এ উৎসবের একটি প্রেক্ষাপট আছে অবশ্যই।
যুগটা ছিল কৃষির, খাজনা হিসেবে প্রজাদের দিতে হতো ফসল এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেই খাজনা জমা দিতে না পারলে তাদের কপালে জুটত অমানুষিক অত্যাচার। এদিকে আবার খাজনা সময়টা প্রজাদের পক্ষে উপযুক্ত ছিল না মোটেই, কারণ হিজরি মাস অনুযায়ী তা নির্ভর করত চাঁদের দেখা পাওয়ার ওপর। সম্রাট আকবর প্রজাদের এই দুর্দশার ব্যাপারটি এক সময় অনুধাবন করে সমস্যা সমাধানের ভার দেন তাঁর অর্থমন্ত্রী ও রাজজ্যোতিষী ফতেউল্লাহ সিরাজির ওপর। সিরাজি তখন চান্দ্রমাসের বদলে সৌরমাস গণনা করে ঋতুনির্ভর বাংলা সন পদ্ধতি চালু করার পরামর্শ দেন তাঁকে। সম্রাট সেইমতো ব্যবস্থা করে খাজনা আদায়ের দিনটিকে উৎসবের দিন হিসাবে ঘোষণা করেন। সেই থেকে চালু হয় বাংলা সন এবং কালক্রমে বাংলায় শুরু হয় পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন পর্ব।
বাংলা নববর্ষ নিয়ে মতভেদ যাই থাকুক, আগেকার দিনে যেহেতু কৃষিই ছিল আমাদের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ, রাজা-মহারাজাদের রাজস্বের প্রধান অংশই যেহেতু আসত কৃষি থেকে, তাই কৃষকের ঘরে ফসল ওঠার পরই নতুন বছর শুরু করা হয়েছিল। তাই অর্থবর্ষ আর বঙ্গাব্দের প্রবর্তন এদেশে যে পিঠোপিঠি সময়ে— এমন ভাবনা বোধ হয় অযৌক্তিক হবে না। যে হিন্দু সৌর পঞ্জিকা মতে বাংলায় বারো মাসের চল, সেই সৌরপঞ্জিকা শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকার এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে। হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিনটি অসম, বাংলা, কেরালা, তামিলনাড়ু, ওড়িশা, মণিপুর, ত্রিপুরা, পাঞ্জাব ও নেপালের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে বহু আগে থেকেই উদ্যাপিত হয়ে আসছে।
বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন আজ যেমন সর্বজনীন উৎসব, এমনটি আগে ছিল না। যেকালে নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখের উৎসব ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবেই উদ্যাপিত হতো। তখন এর মূল তাৎপর্যই ছিল কৃষি, কারণ, প্রযুক্তির প্রয়োগ শুরু না হওয়া পর্যন্ত কৃষককুলকে নির্ভর করতে হতো ঋতুর ওপরই। যে ঋতুতে যে ফসল ফলে এই হিসেবে।
পারস্য দেশে ‘নওরোজ’ ছিল আকর্ষণীয় সমারোহের বারো দিনের জাতীয় উৎসব। সেই মেজাজকেই হিন্দুস্তানে এনে আকবর বাদশা তার রূপ দিয়েছিলেন নববর্ষের উৎসবে, প্রথমদিকে যা ছিল টানা সাত দিন বা ন’দিনের এবং পরে উনিশ দিনের। আজ সে উৎসব একদিনের হলেও তা যথেষ্টই বর্ণবহুল। একদিন যা ছিল শুধুই হিসাব রক্ষার নীরস, কাঠখোট্টা দিন, বাঙালির উৎসবপ্রিয়তা তার সঙ্গে জড়িয়ে নিল রামধনুর বর্ণচ্ছটা। আজকের নববর্ষ বরণকালে তাই আমরা দেখি এর নানা ছবি। মাত্র একটি দিনকে ঘিরে কত না আয়োজন, উৎসাহ আর উদ্দীপনা!
নববর্ষবরণ প্রসঙ্গে আর একটি অধ্যায়ও ইতিহাসের পাতায় সমুদ্ভাসিত। এই অধ্যায়টিতে যে উৎসবের ছবি দেখি আমরা সেখানে অবশ্য রাজা-জমিদাররাই সব, জনসাধারণের যোগ তেমন ছিল না। বর্ষারম্ভের প্রথম দিনটি তখন খাজনা আদায়ের দিন হলেও তা পুণ্য দিন হয়েছিল কোন বিবেচনায়, ভাবতে গেলে ধন্দ লাগে। মনে হয়, যেন নিদারুণ রঙ্গভরা এক সমাজবীক্ষণ। দিনটির নাম দেওয়া হল কিনা ‘পুণ্যাহ’। পরে লোকমুখে তা হয়ে গেল ‘পুণ্যো’। জমিদারদের নববর্ষের প্রথম দিন, যেদিন খাজনা আদায় শুরু হতো সেদিনটি ‘পুণ্যাহ’ এবং প্রায়শই তা হতো আষাঢ় মাসে। দাশরথি রায় (১৮০৬-১৮৫৭)-এর পাঁচালি গানে উল্লেখ আছে এর— ‘মহাপুণ্যের ‘পুণ্যে’ করেন জমিদার মেহমান।’ ‘পুণ্যে’ এখানে পুণ্যাহ আর ‘মেহমান’ হলেন জমিদার। তাঁদের মতো পুণ্যবান মানুষরাই এমন উৎসব করতে পারেন।
প্রসঙ্গত, আমাদের প্রাচীন গান, লোকসাহিত্য, মঙ্গলকাব্য, গীতিকা এমনকী ঈশ্বর গুপ্তের কবিতাতেও অনেক উৎসবের কথা থাকলেও পয়লা বৈশাখের উৎসবের চিত্র বুঝি অমিল। পুণ্যাহ’র কথা আছে রবীন্দ্ররচনায়, তাঁর কবিতায়, গানে বাংলা নববর্ষের কতই না বিভঙ্গ।
এই প্রথাটি কিন্তু চালু করেছিলেন মুর্শিদকুলি খাঁ এবং তিনিই নাকি পয়লা বৈশাখ দিনটিকে পুণ্যাহের দিন হিসেবে মান্যতা দিয়ে প্রতিবছর এই দিনটিতে জাঁকজমক সহকারে উৎসবের আয়োজন করতেন। তাঁর আমন্ত্রণে সেদিন সারা বাংলার জমিদাররা অভিজাত পোশাক পরে বজরা সাজিয়ে নদীপথে মুখসুদাবাদ বা মুর্শিদাবাদে এসে যোগ দিতেন এই উৎসবে। নবাব মুর্শিদকুলি সে উৎসবে যেমন খানাপিনার এলাহি আয়োজন করতেন, খেতাব আর খিলাতও বিলোতেন দরাজ হস্তে। তারপর নবাব আলিবর্দিও এই উৎসবের ঐতিহ্য ও ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন। আবার দিল্লি থেকে দেওয়ানি পাওয়ার পর লর্ড ক্লাইভও কোম্পানির রাজস্ব সংগ্রহের জন্য এই দিনটিকেই বেছে নিয়েছিলেন। তিনিও খুব ধুমধামের সঙ্গেই পুণ্যাহ উদ্যাপন করতেন, এক্ষেত্রে কোনও কার্পণ্য ছিল না তাঁরও।
তবে এ দেশীয় হিন্দু রাজা ও জমিদারদের মধ্যে বাংলা নববর্ষের উৎসবটি প্রথম উদ্যাপন করেছিলেন বাদশা জাহাঙ্গিরের সমসাময়িক, নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদার। চৈত্রের কিস্তির টাকা নবাবকে মিটিয়ে দিয়ে তিনি তাঁর পছন্দমতো অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিনটিতে মহাসমারোহে এই নতুন বর্ষবরণ বা পুণ্যাহ উদ্যাপন করতেন। পরে সব জমিদারদের কাছারি বাড়িতেই আয়োজিত হতে থাকে এই উৎসব। এর পাশাপাশি ব্যবসাদার, দোকানদার, মহাজন, পাওনাদাররাও ক্রমে শামিল হয়ে যান এই উৎসবে।
নববর্ষের ভোরে লাল খেরোর খাতা আর পুজোর ডালি নিয়ে মন্দিরে মন্দিরে দোকানিদের পুজো দিয়ে হিসেবের নতুন খাতা খোলার ট্র্যাডিশন আজও চলেছে সমানে।
সম্ভবত বণিক সম্প্রদায়েরই দৌলতে এই হালখাতার উদ্ভব হলেও, ঠিক কবে আর কোথায়, সে খবর দিতে পারবেন হয়তো ইতিহাসবিদরা।
কিন্তু নাম কেন ‘হালখাতা’? হাল শব্দের একটি অর্থ, বর্তমান কাল, তাই বর্তমান সনের দোকানের হিসেবের খাতা হল হালখাতা। তোশক, বালিশের খোল হয় যে ধরনের মোটা সুতোর কাপড়ে, তাকে বলে খেরুয়া, খেরেয়া বা খেরো। লাল শালু দিয়ে এমন কাপড়ে মোড়া আটপৌরে যে খেরোর খাতা, সেটিকেই হালখাতা বা নতুন খাতা করে পয়লা বৈশাখ তার গায়ে সিঁদুর লেপে দিয়ে সিদ্ধিদাতা গণেশ, লক্ষ্মী, কালী ইত্যাদির পুজো করে দোকানিরা নিয়ে আসেন দোকানে। সারা বছরের হিসেবনিকেশ তুলে রাখা হয় তাতেই। হালখাতা উপলক্ষে চলে মিষ্টিমুখ।
নববর্ষবরণে সেই ১৯৩৮-৩৯ সাল থেকেই আকাশবাণী পরিবেশন করে আসছে নববর্ষের আড্ডা, গান, গীতি-আলেখ্যর অনুষ্ঠান। চল্লিশের দশকের শেষের দিকে কলকাতার বিখ্যাত কয়েকটি দোকান হালখাতা উপলক্ষে সন্ধ্যায় বসাত গানের আসর। মাইক্রোফোনের চল না থাকায় খালি গলাতেই গাইতেন তখনকার জনপ্রিয় শিল্পীরা। পাঁচ ও ছয়ের দশকে শুরু হয় বিচিত্রানুষ্ঠান পুরাতনী, বৈঠকি বা শাস্ত্রীয়সঙ্গীত ছাড়াও রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, আধুনিক গান আর কৌতুক পরিবেশন। দিন বদলায়, কিন্তু আজও এই পয়লা বৈশাখ আমাদের বাজায়। আসলে এক একটা দিন কেমন যেন পাল্টে দেয় আমাদের, ভিতরে ভিতরে একটু যেন অন্যরকম হয়ে পড়ি। কে যেন কানে কানে শুভ বুদ্ধির মন্ত্র দিয়ে পরস্পরকে বলতে শেখায় ‘ভালো থেকো’, ‘ভালো রেখো’। তাই অফুরান শুভেচ্ছা দিয়ে গানে গানে ভরিয়ে তুলে দিনটিকে গড়ে তুলি উৎসবেরই দিন হিসেবে।
প্রকৃতি যখন নতুন হয়ে উঠছে, তখনই যে এই উৎসব। আমরাও আজ তাই নতুন করে বাঁচার শপথ নিই মনে মনে। নববর্ষ তো প্রতীক্ষা আর প্রতীক্ষাই সবচেয়ে সম্ভাবনার, সবচেয়ে নবীন। তাই একে ঘিরেই আমাদের উৎসব, নবীনকে বরণ করবার উৎসব। সার্থকতার এক একটি শীর্ষ ছুঁয়ে ছুঁয়েই আমরা এগিয়ে যেতে চাই নতুন পথে, নতুন উদ্যমে।