পিতার স্বাস্থ্যহানী হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
সত্যজিৎ রায় পরে ভানুকে নিয়ে বলেছেন, ‘ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় অজস্র ছবিতে অভিনয় করেছেন এবং যেখানে বিশেষ কিছু করার নেই সেখানেও করেছেন। আশ্চর্য এই যে, যাই করেছেন, তা বহরে ছোট হোক বা বড়ই হোক, তারমধ্যে তাঁর সাবলীলতার পরিচয় রেখে গিয়েছেন। সর্বজন প্রশংসিত বিরল অভিনেতাদের মধ্যে ভানুবাবু একজন। আমার কোনও ছবিতে যে তিনি অভিনয় করেননি তার মানে এই নয় যে আমি তাঁর অভিনয়ের কদর করি না। প্রথমে মঞ্চে ‘নতুন ইহুদি’ এবং পরে চলচ্চিত্রে ‘বসু পরিবার’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর সময় থেকেই ভানুবাবুর সহজ ও বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করে এসেছে।’ আপামর জনসাধারণ তো বটেই, মানিকবাবুর মতো ব্যক্তিত্বও কেমন তাঁর অভিনয়ের গুণমুগ্ধ ছিলেন এই কথাই তার প্রমাণ।
ভানুর অভিনয়ে আসা কিন্তু একেবারেই আকস্মিক। স্টেজের নীচে দাঁড়িয়ে পাড়ার নাটক দেখছে ছোট্ট ভানু। ওপর থেকে কোনও এক খুদে অভিনেতা দুষ্টমি করে লাথি কষায় মাথায়।
—‘হালায় ওই লাথখান কোনওদিনও ভুলি নাই। ওই দিনই ঠিক কইরা নিছিলাম, অগ্যো দ্যাখাইয়া ছাড়ুম।’
ওয়াড়ি ক্লাবের ‘রণবীর’ নাটকে প্রথম সুযোগ এল। তখন সবে ক্লাস সিক্স। উদয়সিংহর চরিত্রে অভিনয় করলেন ভানু। কলকাতায় এসে পাড়ার নাটক ‘চন্দ্রগুপ্ত’য় চাণক্য সাজলেন। সে অভিনয় এতই সাড়া ফেলল যে পাড়ারই একজন ডাক্তার তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন তখনকার নামকরা পরিচালক সুশীল মজুমদারের কাছে।
তবে ভানুর প্রথম সিনেমায় অভিনয় কিন্তু বিয়ের পরে। এইজন্যে অনেকে বলতেন স্ত্রীভাগ্যেই নাকি ভানুর উত্থান। আর এখানেও একটা চমৎকার গল্প আছে।
বেতারশিল্পী নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ভানুর বিয়ে হয় ’৪৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। আর তার দিন তিনেক পরেই বিপত্তি। কী হয়েছিল? শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়ে এসেছে বাপের বাড়ি। অফিস থেকে ফিরে ভানুই নীলিমাদেবীকে তাঁর বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। স্ত্রীকে বলে গিয়েছেন, ‘রাধা ফিল্ম স্টুডিও থেকে আসছি। কাজ আছে।’ নীলিমাদেবীর বাড়িটা ছিল স্টুডিওপাড়াতেই। একেবারে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশের বাড়ি। নীলিমাদেবীর বাড়ির একদিকে ছিল রাধা ফিল্ম স্টুডিও। অন্যদিকে ভারতলক্ষ্মী স্টুডিও, যেটা এখনকার নবীনা সিনেমা।
ভানু পৌঁছে তো দিলেন, কিন্তু ফেরার নামটি নেই। শীতের বেলা। রাস্তাঘাটও শুনসান। একটু সন্ধে গড়াতেই অনেকটা রাত মনে হয়। বাড়ির সবাই একে একে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ছে। আর কিনা নতুন জামাই বেপাত্তা! শেষে বাধ্য হয়ে শ্বশুরমশাই জামাই খুঁজতে বেরলেন। স্টুডিওতে গিয়ে খোঁজ করতে দারোয়ান একটা লোকের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। কালিজুলি মাখা। চিটচিটে ছেঁড়া চট গায়ে জড়ানো। ভালো করে নজর করে বুঝলেন, এই লোকটিই তাঁর জামাই। কী একটা ফিল্মের নাকি শ্যুটিং হচ্ছে, আর তাতে অভিনয় করছে সে। কাজ শেষ হতে তখনও ঢের দেরি। রাগে গরগর করতে করতে নীলিমাদেবীর বাবা বাড়ি ফিরলেন। এমন বেআক্কেলে ছেলের সঙ্গেই কিনা শেষে মেয়ের বিয়ে দিলেন! এই ছবিই ছিল বিভূতি চক্রবর্তীর ‘জাগরণ’।
চল্লিশের দশকের শেষ। পূর্ববাংলা থেকে তখন দলে দলে উদ্বাস্তু আসছে। তাদের সাহায্য করতে সীমান্তে, স্টেশনে শিবির গড়ছে মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বাধীন ‘ইস্টবেঙ্গল রিলিফ কমিটি’। শয়ে শয়ে স্বেচ্ছাসেবক রাতদিন কাজ করছে। সেই দলে ছিলেন ভানুও। একটি অপেশাদার নাটকের দলও গড়েছিলেন। তারই এক সদস্য ছিলেন সলিল সেন। উদ্বাস্তুদের নিয়ে তিনি ‘নতুন ইহুদি’ নাটকটি লেখেন। সেখানে ভানুর অভিনয় তখনকার তাবড় অভিনেতাদের মন জয় করেছিল। নজরে পড়ে যান ছবি বিশ্বাসের। লোকে বলে, নতুন ইহুদির সাফল্যই ভানুকে পুরোদস্তুর অভিনেতা বানিয়ে দেয়।
‘নতুন ইহুদি’ নিয়ে আর একটা মজার ঘটনা আছে ভানুবাবুর জীবনে। আজকের প্রখ্যাত অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় তখন ফ্রক পরা মেয়ে। স্কুল ছুটির পর খালি পায়ে বন্ধুদের সঙ্গে বাঙাল ভাষায় কথা বলতে বলতে চলেছে। ভানুর নাটকের দলে তখন অভিনেত্রী চাই। রাস্তায় ছোট্ট সাবিত্রীকে মনে ধরে ভানুর। কাছে গিয়ে বললেন, ‘অভিনয় করবা?’ মেয়েটি কটমট করে তাকাল। তারপর বলল, ‘আমাকে বলছেন কেন, বাবাকে বলুন।’ তারপরই ট্রামে উঠে পালাল। এবার হন্যে হয়ে মেয়েটির বাড়ি খুঁজতে বেরলেন ভানু। শেষমেশ বাড়ি খুঁজে পেয়ে দেখলেন মেয়েটির বাবা সম্পর্কে ভানুর মামা হন। সেই সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম মঞ্চে নামা।
অলংকরণ: চন্দন পাল