পিতার স্বাস্থ্যহানী হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
খেলা না থাকলে চৌরঙ্গি পাড়ায় গিয়ে সিনেমা দেখতেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর টালিগঞ্জ স্টুডিওপাড়ায় পার্টের জন্য দরবার। এখানে ছিলেন ভানুর গুরু-স্থানীয় পরিচালক সুশীল মজুমদার ও নির্মল দে। ভানুকে ফিল্মে প্রথম সুযোগ করে দেন ঢাকার বিপ্লবী ও পরে কলকাতার চিত্র প্রযোজক জীবন দত্ত। পরিচালক সুশীল মজুমদার, বিভূতি চক্রবর্তীর সঙ্গে ভানুর আলাপ করিয়ে দেন তিনিই। বিভূতি চক্রবর্তীর ‘জাগরণ’ ভানুর প্রথম ছবি। ওপার বাংলা থেকে আসা ‘বাঙাল’ ভানুকে শুধু চেহারা দেখেই নাকি ‘জাগরণ’ ছবির জন্য নির্বাচন করেছিলেন বিভূতি চক্রবর্তী। কারণ হিসেবে বলেছিলেন, ‘আমার ছবিতে দুর্ভিক্ষপীড়িত চিমসে চেহারার একটা চরিত্র আছে, সেটা তুমি করবে।’ পরে সুশীল মজুমদারের ছবি ‘সর্বহারা’ ভানুকে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। ভানুর দাদা-স্থানীয় সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায় ছিলেন ‘সর্বহারা’র সুরকার। সিদ্ধেশ্বরবাবুর কাছে গান শিখতেন নীলিমাদেবী। এই ছবিতে নীলিমাদেবীকে দিয়ে তিনটে গান গাওয়ান তিনি। পরবর্তীকালে সিদ্ধেশ্বরবাবুর মধ্যস্থতাতেই ভানু-নীলিমার বিয়ে হয়।
কমেডিয়ান হিসেবে জগদ্বিখ্যাত হলেও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিরিয়াস চরিত্রের প্রতি টান ছিল শুরু থেকেই। নির্মল দে’র কাছে ভানু একটা সিরিয়াস পার্ট চাইতে গিয়েছিলেন। ‘নতুন ইহুদি’ নাটকে ভানুর অভিনয় দেখে দারুণ খুশি হয়েছিলেন নির্মল দে। কিন্তু তিনি ভানুকে বললেন, ‘তোমাকে আমি কমেডি রোল দেব। ভালো মানাবে।’ ‘বসু পরিবার’ ছবিতে চান্স দিলেন। প্রায় ওই একই সময় ভানু পরিচালক সুধীর মুখোপাধ্যায়ের কাছেও একটা সিরিয়াস চরিত্রে কাস্ট করার অনুরোধ নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু উনিও কমেডি চরিত্রেই ‘পাশের বাড়ি’ ছবিতে ভানুকে নেন। এটাই ছিল ভানুর সত্যিকারের বড় ব্রেক। রাহুলদেব বর্মন একবার বম্বের কমেডিয়ান মেহমুদকে ভানুর সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে আসেন। মেহমুদ ভানুকে বলেন, ‘আমি পাশের বাড়ি ১০ বার দেখেছি। অসামান্য। এই ছবিটি আমি হিন্দিতে করছি এবং আপনার পার্টটা করব আমি। আশীর্বাদ করুন যাতে ভালো করতে পারি।’ মেহমুদের ‘পড়োশন’ ছবিটি ‘পাশের বাড়ি’ থেকেই তৈরি হয়েছিল।
এরপর নির্মল দে’র ছবি ‘সাড়ে ৭৪’। ম্যাসিভ হিট। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় রাতারাতি স্টার বনে গেলেন। যেটা সবচেয়ে গর্বের বিষয়, ছবিতে অতগুলো বাঘা বাঘা কমেডিয়ানের মধ্যে থেকে তিনিই সে বছর ওই ছবির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনয়ের জন্য ‘উল্টোরথ’ পুরস্কার পেলেন। দর্শকদের ভোটে এই পুরস্কার দেওয়া হতো। তাই এটা শিল্পীদের জন্য ছিল বিরাট সম্মানের। পরে যখন বম্বেতে তিনি ‘সাগিনা মাহাতো’র শ্যুটিং করতে গিয়েছিলেন তখন একদিন আড্ডায় কেষ্ট মুখার্জি তাঁকে বলেছিলেন, ‘দাদা সাড়ে ৭৪’ আপনার বেস্ট অ্যাক্টিং। এই ছবির একটা সিন যেখানে তাড়াতাড়ি আপনি পা থেকে চটি খোলার চেষ্টা করছেন কিন্তু খুলছেন না। এই আইডিয়াটা আমি একটা হিন্দি ছবিতে মেরে দিয়েছি।’
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে নিয়ে অসম্ভব ঠাট্টা করতে পারতেন, যেটা বড় অভিনেতার অন্যতম বড় লক্ষণ। তবে তাঁর আত্মসম্মানবোধও ছিল প্রবল। নির্মল দে প্রায় সব ছবিতেই ভানুকে নিতেন। ওঁর শেষ ছবি ‘বিয়ের খাতা’র অরিজিনাল কাস্ট লিস্টে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম ছিল। কিন্তু বাগড়া দিলেন তখনকার বিখ্যাত প্রোডাকশন ম্যানেজার বিমল ঘোষ। উনি নির্মল দে’কে বলেন, ‘কী ব্যাপার ভানু ছাড়া ছবিই করছেন না। আপনি কি ভানু-ম্যানিয়ায় ভুগছেন?’ ব্যস, ভানুকে আর নির্মলবাবু ছবিতে নিলেন না এবং কেন নিলেন না সে গল্পও বললেন। এর কিছুদিন বাদে বিমল ঘোষ ভানুর কাছে এলেন নতুন প্রজেক্ট নিয়ে। উনি একটি ছবি করছেন ‘বধূ’। তার একটি মুখ্য চরিত্রে ভানুকে নিতে চান। ভানু যেন মুখিয়েই ছিলেন এমন একটি সুযোগের জন্য। বিমল ঘোষকে বললেন, ‘সে কী কথা। আপনেই না নির্মল দারে ভানু ম্যানিয়া হইসে বইল্যা আমার রোলটা ক্যাঁচাইয়া দিসিলেন? আর অখন আমারে দিয়াই কাজ করাইতে আইসেন, আপনারও কি ভানু ম্যানিয়া হইল?’ বিমল ঘোষও চালাক লোক। বললেন, ‘না, না, সেকি। তোমার-আমার সম্পর্ক খারাপ করার জন্য শত্রুরা ইন্ডাস্ট্রিতে মিছে কথা কইছে।’
ভানুর একটা বড় গুণ ছিল কোনও দিন উপকারীর উপকার ভুলতেন না। বিকাশ রায় একবার ১৯৫০-’৫১ সালে রেশন তোলার জন্য ভানুকে ৪০ টাকা ধার দিয়েছিলেন। এই কথা তাঁর পরিচিতদের সবসময় বলতেন ভানু। এরপর বিকাশ রায় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে গেলে, ভানু সবসময় তাঁর পায়ের কাছে মাটিতে বসতেন। কোনও দিনও বিকাশ রায়ের পাশের চেয়ারে বসেননি। এই ঘটনায় বিকাশ রায় খুবই অস্বস্তিতে পড়তেন, কিন্তু ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে টলাতে পারেননি।
পরিচালক সুশীল মজুমদার ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রথম জীবনে অনেক ছবিতে চান্স দিয়েছেন। ভানুর তৃতীয় ছবি (প্রথম রিলিজ) ‘অভিযোগ’-এ সুযোগ দিয়েছিলেন। যদিও টাইটেলে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম ছিল না (প্রভৃতির মধ্যে ছিল)। পরেও ‘সর্বহারা’, ‘দিগভ্রান্ত’, ‘রাত্রির তপস্যা’ প্রভৃতি ছবিতে বেশ বড় চরিত্র দিয়েছিলেন। ১৯৭৩-’৭৪ সালে এহেন সুশীল মজুমদারের ফিল্মে যখন আর কাজটাজ নেই, ভানু তৎকালীন মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে ধরে সুশীল মজুমদারের জন্য দুটি সরকারি ডকুমেন্টারি জোগাড় করে দিয়েছিলেন। রবি ঘোষ যখন ‘নিধিরাম সর্দার’ ছবি করার কথা ভাবছেন, তখন তিনি প্রায়ই পরিচালনা, আর্টিস্ট সিলেকশন প্রভৃতি নিয়ে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করতেন। একদিন রবি ঘোষ বললেন, ‘আমার ছবিতে বয়স্ক ভিলেনের জন্য একজন আননোন ফেস, ভালো অভিনেতা দরকার।’ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় সঙ্গে সঙ্গে সুশীল মজুমদারের নাম প্রস্তাব করলেন। প্রথম দিকে রবি ঘোষ একটু দোনামোনা করছিলেন। কারণ এতদিন উনি অভিনয় করেননি। প্রথম দিন সুশীল মজুমদারের শ্যুটিংয়ের পর ভানু বন্দ্যোপাধ্যাকে ফোন করেন রবি ঘোষ। উচ্ছ্বসিতভাবে বলেন, ‘ভানুদা কী আর্টিস্ট দিয়েছেন। কী গলার মডিউলেশন, কী দারুণ বেস।’ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও খুব খুশি হয়ে বলেন, ‘এই জানবি! আমি বেস্ট লোক ছাড়া কখনও কাউকে রেফার করি না।’
নিজে যেমন অসাধারণ কমেডি অভিনয় করতেন, তেমনই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেন্স অব হিউমারও ছিল অতুলনীয়। বিশ্বররেণ্য পরিচালক হয়ে ওঠার আগেও সত্যজিৎ রায়কে বিলক্ষণ চিনতেন তিনি। আত্মকথা ‘ভানুসমগ্র’তে নিজেই লিখছেন, ‘ওঁকে সুকুমার রায়ের পুত্র ‘লম্বা মানিক’ হিসেবে চিনতাম।’ ‘পথের পাঁচালী’ দেখে অভিভূত ভানু একদিন বসুশ্রী সিনেমার অফিসঘরে ঢুকে দেখেন কর্ণধার মন্টু বসু ও আরও কয়েকজনের সঙ্গে বসে আছেন সত্যজিৎ। ঘরে ঢুকেই ভানু চেঁচিয়ে বললেন, ‘আরে মানিকবাবু এই সত্যজিৎ রায়টি কে? এ তো সাংঘাতিক ছবি বানিয়েছে।’ তৎক্ষণাৎ মন্টুবাবু বলে ওঠেন, ‘আরে মানিকবাবুই তো সত্যজিৎ রায়।’ সঙ্গে সঙ্গে ভানুর কণ্ঠ থেকে অমোঘ ভবিষ্যৎবাণী বেরোয়, ‘আরে মশাই, কী ছবি বানিয়েছেন। আপনি তো কাননবালার চেয়ে বেশি পপুলার হয়ে যাবেন।’
(ক্রমশ) অলংকরণ: চন্দন পাল