পিতার স্বাস্থ্যহানী হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
—আবার কী হল? রুমির একটা কথা মানে একশোটি কথার বাঞ্চ। সবটাই বিভাস বিষয়ক। এটা সবিতা জানেন। বনিবনা হচ্ছে না। শ্বশুরবাড়ির সহায়তা নেই। পরপর দুটি মেয়ের কারণে বিভাসের বাবা-মা’র নাতির আশায় ছাই পড়েছে। ছেলে-বউয়ের লাগাম ছাড়া কোন্দলে তাই উদ্বেগ নেই।
রুমি বলল, কী হল মা— চুপ করে গেলে যে!
—না না ধরেই তো আছি— বল!
—আমার পক্ষে আর অ্যাডজাস্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। এবার একটা ডিসিশন নিতেই হচ্ছে।
সবিতা বললেন, স্বামী-স্ত্রী ঝগড়া হয়েই থাকে। তোদের একটু ঘন ঘন হচ্ছে, এই যা। কী কারণে হচ্ছে, তোরা তোদের যতটা বুঝিস— অন্যে তো অত বুঝবে না! তাই দু’জনকেই এক হয়ে ঠান্ডা মাথায় ঠিক করে নিতে হবে।
রুমি বলল, বুঝেছি। এগুলো সব বাবা-মা’রই কথা। ঝেড়ে ফেলার জন্য। ভুলে যেও না আমারও কিছু শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে। প্ল্যাটফর্ম আমিও একটা করে নিতে পারব। তোমাদের মতামত চাইনি। সামান্য সহায়তা চেয়েছি দু-একদিনের জন্য। যাকগে, সেটা যে পাব না— আমি জানতাম। মায়ের কথা ছেঁচকি পোড়ার মতো ছুঁড়ে দিয়ে ফোন কেটে দিয়েছে রুমি।
সামান্য চুপসে গেলেন সবিতা। কী এমন হল! এই তো দিন কয়েক আগে মেয়ে-জামাই এসে ঘুরে গেল। প্রচলিত দৃশ্যে মেয়েরা যেভাবে বাপের বাড়ি আসে। হাসি-খুশি মেয়ের পিছু পিছু নম্রমুখ জামাই। রুমি এসেই চানাচুর, আচারের বোয়াম হাতড়াল। বিভাসের জন্য তার, অন্য নির্দেশ— মা বেশি কিছু করবে না। বাবাকে বল ক’টা চিকেন পকোড়া আনতে আর কফি করে দাও ব্যস— মিষ্টি বিভাস খায় না।
তিন্নি, টুনাকে তাদের গ্রানির কাছে রেখে আসার জন্য এক ঘণ্টার অবস্থানে রাতের খাওয়া বাদ।
অমর জামাই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, তো সবিতা নাতনিদের না আসার খেদে অস্থির। জামাই-মেয়ের আহার-পর্ব বাদ যাবার ক্ষুণ্ণতা, এসব অনুযোগের উত্তরে রুমির যেমন হাত নেড়ে নেড়ে নানা বিস্তার দেওয়া আর ওদিকে বিভাসের মুখ টিপে টিপে হাসি—দুটোই খুব মুগ্ধ করে সবিতাকে। এরপর একজন উঠল তো অন্যজনও খাড়া।
তাহলে!
ফোন নামিয়ে রান্নাঘরে ছোটেন সবিতা। সময়টা বড় তড়বড়ে। কড়াতে চড়বড় করছে চচ্চড়ি। বাজার থেকে সাধের মোটা দাঁড়ার কাঁকড়া এসেছে। দাঁড়াগুলো ভেঙে গুটিয়ে আর বিশ্রী খোলটা ছাড়িয়ে এনেছে অবশ্য। ছুটির দিনে চুটিয়ে কাগজ পড়ার মতোই মৌজ করে অমরের কাঁকড়া চিবনো চলবে। সবিতা মনের অস্বস্তি নিয়ে কী করবেন ভেবে পেলেন না। নাইটির হাতায় মুখের ঘাম মুছলেন দু-একবার। কিছুটা গজগজ করে হয়তো স্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেত। কিন্তু তাতে সময় নষ্ট ছাড়া লাভ হতো না কিছু। টাইম-ম্যানেজের ব্যাপারটা তাঁকে সব সময় মাথায় রাখতে হয় কিনা। অনেকের মতো রান্নার লোক নেই তাঁর। সন্তোষপুরে তাঁর জা বন্দনার দুটো মানুষের জন্য তিনটে কাজের লোক। রান্না, বাসন মাজা আর ফার্নিচার পরিষ্কার করা। ড্রাইভার তো আছেই। অবশ্য এত ব্যবস্থার কারণ— বন্দনার মাটিতে পা পড়ে না আর্থ্রাইটিসে, দেমাকে নয়।
সবিতার শুধু সোদপুরে গঙ্গা ফেসিং এক টুকরো মাথা গোঁজার ঠাঁই ছাড়া আর কিছু নেই। অমরের ছোট প্রাইভেট ফার্মে চাকরি। মেয়ের বিয়ে দিয়ে অনেকটাই কাতরতা এসেছে। এসবের বিপরীতে বিভাসের পারিবারিক অবস্থা— তার দেড় হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটের— আধুনিকতায় মোড়া লিভিং থেকে কিচেন। সেই মাফিক যাবতীয় আসবাব গ্যাজেটস গাড়ি। এসব তাদের মতো পাত্রী তরফের চোখ ধাঁধানোর পক্ষে যথেষ্ট। তবে কিনা বিয়েটা রুমি-বিভাসের প্রেমঘটিত। অনুঘটকের কাজে লেগেছে সেটাই।
মেয়ে শিক্ষিত এবং সুন্দরী। এক পলকে নজর-কাড়ার মতো প্লাস পয়েন্ট তার আছে। তুলনায় বিভাসের সাধারণ চেহারা ও চাকরির দিকটা তার পারিবারিক জৌলুসের সঙ্গে মিশে গিয়ে নজর কাড়ছে। তবে তার পলিশড কথাবার্তা আর স্মার্টনেস অভিভূত করার মতো। যে মুগ্ধতা থেকে রুমির প্রেমে উত্তরণ। দাম্পত্যের বেশ কতকগুলো বছর এদের কেটেও গেল দুই কন্যা নিয়ে।
তাহলে!
চুপচাপ রান্না সেরে সবিতা দু’থালা ভাত বেড়ে ঠকাস করে টেবিলে রাখলেন। অমর বসেছেন। এটাওটা আনতেই চপাচপ কাঁকড়া চোষার শব্দ উঠল। অসহ্য লাগে সবিতার। বিরক্ত হয়ে মেয়ের ফোনের বিস্তার না দিয়ে পারলেন না। কিন্তু শুনে চিবনো থামিয়ে খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠলেন অমরবাবু। পিত্তি জ্বলে ওঠে সবিতার, — হাসছ?
—হাসব না! সকালবেলার মেঘ আর স্বামী-স্ত্রী’র ঝগড়া কবে স্থায়ী হয়েছে। এ তো সবারই ব্যাপার। আমাদের হয়নি! ওফ্! ব্যাগ গুছিয়ে একাই বাপের বাড়ির ট্রেন ধরতে যাচ্ছ... মনে পড়ে? শেষে মেজবউদির মধ্যস্থতায় পাড়াপড়শির কান বাঁচল। কী এমন বলেছিলাম!
মুখে ভাত পুরে দাবড়ালেন সবিতা, থামো। আমাকে বলেছিলে চালের বস্তা। রাস্তাঘাটের বোঝা আমি। সেসব দিনকাল ভুলে যাও। এখন অন্য জমানা। নিজস্ব মেজাজের দুটো মানুষ এরা। পড়শির কান বাঁচাতে নিজের মান খোয়াবে না।
অমরবাবু নিরুদ্বেগে কাঁকড়া চুষছেন। কিন্তু সবিতার গলায় ভাত নামে না। বলেন, সবাই তোমার মতো খায়-দায় নেড়া নাচে— মানুষ নয়। তোমার নিশ্চিন্তি দেখে আমার গা জ্বলে যায়।
তাতেও গা তাতে না অমরবাবুর। বলেন, ‘ছাড়ো তো। এখন মন দিয়ে খেয়ে নাও। আহ্ কতদিন পর কাঁকড়ার ঝাল খেলাম।’ হঠাৎ জগঝম্প তুলে ঘন ঘন বেল বাজছে দরজার বাইরে।
কে রে বাবা অসময়ে!
ছুটে হাঁপিয়ে দরজা খুলে থ। দরজায় রুমি। রাস্তায় গাড়ি। গাড়িতে পর্বতপ্রমাণ লাগেজ সহ সদ্য উদ্বাস্তু এক সংসার। মাঝ মধ্যিখানে তিন্নি-টুনা।
এভাবে বিভাসহীন তো দূরের কথা, রুমির আসাই তো কম। এলেও কাঁধের ভ্যানিটি ব্যাগ স্রেফ— গায়ে হাওয়া লাগিয়ে আসা।
সবিতার চক্ষু স্থির হওয়ার সঙ্গে হুস করে মাথায় উঠে পাক খেতে থাকল সংসারের চাল-চিঁড়ে, আটা, আনাজ, মাছ, ডিমের দৈনন্দিন। তার সঙ্গে ধনী বাড়ির দুটি কচি মুখের বায়না। ধারে ধারে সদ্য ত্যক্ত তিরিক্ষি কন্যার নিন্দে-মন্দর ধারাবাহিক।
কাঁকড়া ফেলে উঠে এসেছেন অমরও। তবে তিনি এঁটো হাতেও বেশ হইচই শুরু করেছেন। সবিতা নাতনি দুটির জন্য হাত বাড়িয়েছেন। গোলাপফুলের মতো মুখ দুটি সব উদ্বেগ উড়িয়ে দিল মুহূর্তে।
নিজের মেয়েকে টেনে ডাইনিংয়ে বসালেন বাবা। — আয় আয় ভাতে বসে পড়। দিদিরা কই রে! কেমন কাঁকড়া এনেছি দেখ— অনেক এনেছি। কই গো রুমুকে ভাত দাও। গনগনে মুখে মেয়ে বলল, আমি খেয়েছি। তোমরা খেয়ে নাও বাবা। বাচ্চারা ওসব খাবে না।
ড্রাইভারের নামিয়ে যাওয়া মালপত্তরের ডাঁই থেকে মেয়েদের টেনে আনা যাচ্ছে না। তারা গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অচেনার মতো।
প্রথমে তারা নামতে চায়নি। ছোটটি নিজেদের ড্রাইভার কাকুর গলা জড়িয়ে ধরে ফিরে যেতে চেয়েছিল। তাদের মা রাগত হাত ধরে টেনে নামিয়ে ঘরে ঢোকায়। সোফায় বসিয়ে দিয়ে ধমকাল, একদম অসভ্যতা করবে না। তাতে ছোটটি কেঁদে উঠল ফুঁপিয়ে— বড়টি মুখ ঘুরিয়ে নিল সরোষে।
অমরবাবুর মোবাইলে বাজছে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নারে— নারে— ভয় করব না বিদায় বেদনারে...।
অনুমানে চোখ পাকিয়ে তেড়ে এল রুমি, — বাবা, একদম না। নম্বরটা দেখে নাও। তুলবে না।
অমরবাবু হাসছেন, একবার তুলে দেখি না! তোরা পৌঁছেছিস বলে দিই!
—নো নো। নেভার। নো সম্পর্ক।
—বুঝলাম। কিন্তু সম্পর্কটা আছড়ে ভাঙার শব্দটা আগে উঠুক। তবে তো। ততক্ষণে দুটো কথা বলা যায়। জ্বলে উঠল রুমি— এটা লাইটলি নিও না বাবা। আমার জীবন আমার। আমার মান-মর্যাদার প্রশ্ন। তার সঙ্গে পুরো মেয়ে জাতটার। যে মানুষ ঠিক এইখানেই হন্ট করে। মেনে নেওয়া যায় না।
বাবা বললেন, অবশ্যই।
ততক্ষণে কাঁকড়া, ভাত, আলুভাজা, ডাল সব চলে এসেছে টেবিলে। সবিতার এতক্ষণে একটু আহ্লাদও হচ্ছে। একমাত্র তার সন্তানটিকে যে করেই হোক এত কাছাকাছি একবার পাচ্ছেন তো। দুটি মানুষের নিঃশব্দ সংসারে এ এক পরম প্রাপ্তি।
রুমি কড়া সুরে মেয়েদের ডাক দিল খাবার জন্য। তাতে বড় মেয়ে কাছে এসেও ছিটকে দূরে দাঁড়িয়ে বলল, না, ওই ডার্টি পোকা আমি খাই না— বিচ্ছিরি। আমি বাড়ি যাব।
স্থির চোখ পাকিয়ে রুমি তাকিয়ে থাকল।
সবিতা বললেন, পোকা নয়, ওটাও একটা চিকেনের মতো মাংস। আমি ছাড়িয়ে দিই, খেয়ে দেখো না। এসো আমি খাইয়ে দিই।
শুনে নাতনি দৌড় দিল উল্টো দিকে।
ছোটটি মুখে ভাত পুরে কান্না জুড়েছে হাঁ করে। উগরে ফেলে দিল সবটাই।
সবিতা বুঝলেন কেউই তারা রুমির হাতে খেতে অভ্যস্ত নয়। ছোট খায় আয়ার হাতে। বড়র লাগে ঠাকুমা।
সবিতা ব্যস্ত হয়ে বললেন, আমি দেখছি। তুই চাট্টি খেয়ে নে। মেয়ের মুখের সামনে আদর করে প্লেট ধরে দিলেন।
আবার ফোন। তবে সেটা রুমির ব্যাগের খপ্পরে বাজছে। সুইচ অফ নেই। যা রাখা উচিত ছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে বসে থাকল রুমি। অমর-সবিতা অস্থির উচ্চকিত। মেয়ের কাঁধ ছুঁয়ে প্রতিক্রিয়া খুঁজতে হাত বাড়ান, আবার পিছিয়ে আসেন। যার অর্থ, আহা তোল না মা! উত্তরও জানা, নেভার।
দুপুর গড়িয়েছে বিকেলে। বাচ্চা দুটি রুমির বয়ে আনা ড্রাইফুড আর দুধজাতীয় কিছু খেয়ে ঘুমোচ্ছে। এই ফাঁকে রুমি জিন্স পরে নিয়েছে। অফ হোয়াইটে সবুজ ফুটকি কুর্তি। কান গলা হাত শূন্যতায় মসৃণ। খাটো চুলে ব্রাশ টানছে। মেয়ে সব রূপেই অপরূপা। মুগ্ধ হয়ে দেখছেন সবিতা, কোথাও বেরবি?
—হুম্।
—কোথায় রে!
—দেখি, ইলিনাদের স্কুলটায় ভ্যাকেন্সি আছে বলছিল।
—সে সব হবে। এই তো এলি। একটু রেস্ট নে।
—বুঝছ না, আর ফেলে রাখা নয়। যা কিছু এখনই করে ফেলতে হবে। তার মধ্যে প্রথম যেটা— একটা চাকরি।
হাতের ব্রাশ থামিয়ে তাকাল, এই তো মাত্র দেড় বছরের বিয়েতে গত নভেম্বরে হানিমুন সেরে আসার পর অর্না কেস ফাইল করে ফেলল।
সবিতা অবাক হয়ে বললেন। ওমা সেকি কথা! এত তাড়াতাড়ি! পরে বললেন। আর তোর সেই কুর্চি বলে বন্ধুটার কী খবর রে! বল্লাল নামের যে ছেলেটাকে বিয়ে করল! খুব মেধাবী নাকি। তোর জন্মদিনে এসেছিল। বেশ নম্র-ভদ্র ছেলে। কী ভাব দু’জনের।
—নাম্বার ওয়ান মিশ্চেভিয়াস। আদার গার্লফ্রেন্ড আছে।
—সে কী করে!
—হ্যাঁ, সেপারেশন চলছে।
চুপসে গেলেন সবিতা। রুমি বলল। তাই তো অর্না কাল ফোন করে বলছিল, ওই জাতকে কখনও মাথায় তুলে পায়ের মাটি হারাতে নেই। তো ভেবে দেখলাম, ঠিক। যত বেশি ওর ফ্যামিলিকে অ্যাডজাস্ট করি, তত বেশি একটা কুনো ব্যাঙ সাজাতে আমাকে উঠেপড়ে লেগেছে।
সবিতা নরম গলায় বললেন, চাকরি করতে চেয়েছিলি?
—সে তো চাইতেই পারি। অর্না করে না! কিন্তু আমি চেয়েছিলাম একটা ফ্যাশন শোয়ে নাম লেখাতে। বিউটি-কনটেস্টে অনেক হ্যাপা। এতে দীক্ষার হাজব্যান্ড আছে, হয়ে যেত তো।
—তো?
—তো আর কী, এই নিয়ে কথা কাটাকাটি। সেটা এক্সট্রিমে চলে গেলে, বলে কিনা, তুমি অর্না হতে চাইছ? ওয়ার্কিং লেডিদের সঙ্গে পাল্লা দিতে যেও না— তাতে আমার মেয়েদের হেনস্তা হবে।
—বললাম, নো কমেন্টস। আমার ব্যাপার আমি বুঝব। ব্যস, বেরিয়ে এলাম। ওদিক থেকে শাশুড়ি ছুটে এল।
—আর বিভাস?
—ওর মুখ পর্যন্ত দেখিনি।
—আহা রে!
রুমি ধাঁ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ওই জন্য তোমাকে কিছু বলতে চাই না— এতে আহা-রে করার কী আছে!
—না মানে...
এবার ফোন বাজছে জিন্সের পকেটে। বেজে বেজে থেমে যায়। থেমে ফের বাজে। বেজেই যায়। তাতে টুনার ঘুম ভাঙে। তিন্নি লাফিয়ে পড়ে জাপটায় মাকে, বাবার কলিং— মাম বাবার কলিং।
—নিকুচি করেছে বাবার। মেয়ের হাত ঠেলে সরিয়ে ফোন অফ করে দেয় রুমি। উপেক্ষার উঁচু মুখ তুলে সরে গেল ব্যালকনির দিকে। পিছু নিল দুই খুদে। সম্ভবত আবারও কলিং।
সবিতা নিরুপায় হয়ে অমরের ঘরে ঢুকলেন। তাঁর স্বগতোক্তি —কী যে করি!
অমর বললেন, কী আবার করবে, চা করো।
কটমট তাকালেন সবিতা, ওই একটি ব্যাপার খাওয়া ছাড়া তো কিছু বোঝ না তুমি!
উঠে বসেছেন অমর, না না একটু পর বাজার বেরব। ওরা কিছু খেল না, মাংস আনব ওদের জন্য। সকালের জন্য কিছু ফল-মিষ্টিও আনতে হবে। ওরা তো যা তা খায় না। কাঁকড়া দেখে কেমন ডার্টি পোকা বলে পালাল। রুমু বোধহয় পার্শে পছন্দ করে। নাকি চিংড়ি? ওসব সকালে আনব। ইলিশও আনতে পারি। পরে গলা নামিয়ে বললেন, অত কী ভাবছ? থাক না রুমু। মেয়ে তো আমাদেরই।
সবিতা নিরুত্তর থাকেন। বুঝতে পারেন, রুমির দুই মেয়ে উঠে-পড়ে মা’র বেরনো আটকে দিয়েছে। নাতনিদের এ পরিবেশ পছন্দ নয়। না হলে শিশুদের কাছে টেনে মেয়েকে একটু স্বস্তি দিতে পারতেন।
কিছুই না পেরে শেষে চা করতেই উঠলেন।
সময়ের আগেই রান্না চাপিয়ে দিলেন সবিতা। ওদের তো খাওয়াই হয়নি। রুমি একটু ঝাল পছন্দ করে। মাংসটা গায়ে গায়ে করবেন। অমর কালকের জন্য ইলিশ, পার্শে দুটোই এনেছেন। বিকেলে কিছুটা দাম সুবিধা পেয়ে। কেটে-কুটে ফ্রিজে ভরেছেন সবিতা। বাচ্চা দুটো নিজেদের মধ্যে খেলছে। রুমি এখনও নামেনি। চা ধরে দিতে গিয়ে দেখেছেন, যা চলছে নারদ... নারদ।
রান্না সেরে টিভি খুলবেন! নাকি এসময় যেটা উচিত, মেয়েকে কাছে বসিয়ে বোঝাবেন, ভাবনা কী! আমরা তো আছিই।
ভাবতে ভাবতেই দেখলেন, মেয়ে নেমেছে। পাশে তার মেয়েরাও। রুমির মন-মরা মুখের দিকে সবিতা তাকাতেই পারেন না। হায়, কোথা থেকে কী হয়ে গেল!
বললেন, আয়... আয়... বোস। ছোট নাতনিকে জড়িয়ে একটা হামি খেয়ে বললেন, দিদিরা কিচ্ছু খায়নি। খেতে দিয়ে দেব? আর হ্যাঁ, শোন, তোর ছোটকাকি ফোন করেছিল। তুই আছিস শুনে খুব খুশি। তোকেও ফোন করবে। কাল ওর বাড়ি যেতেই হবে— গুরু পূর্ণিমা।
ভ্রু কোঁচকায় রুমি, — কাল! কী করে বলছ মা? আমি তো এই বেরচ্ছি।
—কোথায়?
—কেন, লেকগার্ডেন্স-এ।
আকাশ থেকে পড়লেন সবিতা। বরাবরের থাকার কথা! আর বারো ঘণ্টাও যে কাটল না! বললেন, ওমা সেকি কথা। তোর বাবা তোদের জন্য কত কী এনেছে। এমন তো কথা ছিল না। অন্তত রাতটুকু তো থাকবি। এই যে বললি...।
রুমি দ্রুত কথা সারার তাগিদে বলল, ওসব থাকাথাকি ছাড়ো তো! আমার কি সময় আছে! কাল তিন্নির ক্লাস। এগজাম প্লাস নাচের স্কুল। টুনার ড্রয়িং। বিভাস পুনে যাবে বিকেলের ফ্লাইটে, আর আমারও একটা ভাইবা আছে বারোটায়, বিভাসই বলল।
আনুপূর্বিক ঘটনা নস্যাৎ করে, সবিতাকে থ বানিয়ে বয়ে আনা বিশাল লাগেজ সামলাচ্ছে রুমি। বলল, গাড়ির আওয়াজ উঠল না? ওই তো বিভাস এসে গেছে।
হাসছে রুমি। বলল — তোমরা সব ঠিকঠাক থেকো। বাবা কই, বাবা? রুমি এগচ্ছে, জামাই সমাদরে বাবা আগেই ছুটে গিয়েছেন এবং ঘোষণা করেছেন, খেয়েদেয়ে না গেলে শেষতক যাওয়াটাই আটকে দেবেন। সবিতার হাসি দেখে বোঝা যাচ্ছে, মনের মতো কথাটি বলেছেন অমরবাবু।