পিতার স্বাস্থ্যহানী হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
হিমালয়ের পবিত্র দেবস্থানগুলি বারে বারে পরিব্রজন করলেও গুপ্তকাশীর অদূরে কালীমঠে আর যাওয়াই হয় না। তাই সেবার গৌরীকুণ্ডের পথে ত্রিযুগীনায়ারণ হয়ে গুপ্তকাশীতে এসে রাত্রিবাস করলাম।
আগে পঞ্চকেদারের যাত্রীরা কালীমঠ হয়েই মদমহেশ্বরে যেতেন। এখন সে পথ রুদ্ধ। তাই গুপ্তকাশী থেকে কালীমঠ দর্শন করে আবার গুপ্তকাশীতেই ফিরে উখীমঠ হয়ে যেতে হয়। কেউ কেউ সরাসরি উখীমঠ দিয়েই যান।
গুপ্তকাশী থেকে কালীমঠের দূরত্ব ১১ কিমি। ঘন ঘন জিপ বা ট্রেকারের ব্যবস্থা আছে। প্রবল প্রবাহ সরস্বতী নদীর তীরে কালীমঠে আসতেই সেখানকার নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে মোহিত হয়ে গেলাম। এই নদীর ওপর পাকা সেতু পার হয়ে কালীমঠে প্রবেশ করতেই দেহ মন যেন অন্যরকম হয়ে গেল। কালীমঠের উচ্চতা ৩ হাজার ৯৬০ ফুট।
হিমালয় তীর্থভূমিতে খুবই ছোট্ট জায়গা এই কালীমঠ। এখানে ত্রিগুণাত্মিকা দেবীর অধিষ্ঠান। দেবী এখানে মহাকালী। ইনি ৫১ পীঠের এক দেবী। সতীর বাম চরণের সমস্ত অঙ্গুলিই এখানে পড়েছিল। এখানকার মন্দির মহাকালী মন্দির নামেই প্রসিদ্ধ। এখানে বেশ কয়েকটি ধর্মশালা ও যাত্রীনিবাসও আছে।
মন্দিরে প্রবেশ করে কোনও মূর্তির দর্শন পেলাম না। তবে পাষাণে ঢাকা একটি সুড়ঙ্গ আছে। সেটিই দেবীস্থান। সুড়ঙ্গমুখের সেই পাথরটিকে দেবীজ্ঞানে পুজো করা হয় এখানে। শুধুমাত্র শারদ ও বাসন্তী নবরাত্রে সেই পাথর সরিয়ে স্থানটি অনাবৃত করা হয়। ওই সময় এখানে সওয়া লক্ষ আহুতি দ্বারা মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান হয়। বর্তমানে এই স্থানে একটি প্রকাণ্ড খাঁড়া ও কয়েকটি ত্রিশূল দেবীর অস্ত্র হিসাবে রাখা আছে। আর চারদিকে ঝোলানো আছে অজস্র চামর ও ঘণ্টা।
মহাকালীর মন্দির দর্শনের পর আমি এখানকার অন্যান্য মন্দিরগুলিও দর্শন করতে চললাম। এখানে আছেন মহালক্ষ্মী, মহাসরস্বতী, গৌরীশঙ্কর ও মহাদেবজির মন্দির। তবে সবই অতি প্রাচীন ও ভগ্নদশাপ্রাপ্ত। অন্যান্য তীর্থের মতো যাত্রীসংখ্যাও এখানে খুবই কম। আজ এই মহাতীর্থে আমিই একমাত্র যাত্রী। তা হোক, এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ আমার এত ভালো লাগল, যে তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।
এখান থেকে চার-পাঁচ কিমি দূরে কালী নদীর তীরে কালী শিলা বা মাতঙ্গশিলায় চৌষট্টি যোগিনী বিরাজিত। সঙ্গে স্থানীয় কাউকে না নিয়ে সেখানে যাওয়া উচিত নয়। কেন না স্থানটি অতি দুর্গম। সেখানেই একটি উচ্চ পর্বতে বসে দেবগণ শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করার জন্য মহাকালীর আরাধনা করেছিলেন। দেবী মহাকালী দেবগণের আরাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে চামুণ্ডাক্ষেত্রের কাছে আরও একটি উচ্চ পর্বতে বধ করেন শুম্ভ-নিশুম্ভকে। পরে মহাষ্টমীর পুণ্য তিথিতে এই কালীশিলায় বধ করেন রক্তবীজকেও। খরস্রোতা কালী গঙ্গার বুকে অর্ধনিমজ্জমান বৃহৎ একটি শিলাকে রক্তবীজের মুণ্ড বলে মনে করেন স্থানীয়রা। আজও সেই শিলা বেয়ে রক্তের ধারা বয়ে চলেছে। আঠার মতো চ্যাটচ্যাটে কালো রক্ত। তাই ওই স্থানটি কালীশিলা বা কালশিলা নামে পরিচিত।
হিমালয় তীর্থ যাত্রীরা সবাই কেদার দর্শন করে বদ্রীনারায়ণের পথে রওনা দেন। তাই কালীমঠ অবহেলিতই রয়ে যায়। ফলে এই মহাতীর্থ দর্শনে অনেকেই যেমন বঞ্চিত হন তেমনই প্রকৃতির নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখারও সুযোগ হারান।
কালীমঠে বেশ কিছুটা সময় কাটানোর পর একবার ভাবলাম এতদূর এসেছি যখন একরাত থেকেই যাই এখানে। ধর্মশালার ঘরের ভাড়া তো ১৫০ টাকা। কিন্তু আকাশের অবস্থা ভালো নয় বুঝে আবার গুপ্তকাশীতেই ফিরে যাওয়ার মন করলাম। কেন না এ পথে ধস নামার সম্ভাবনা খুব বেশি।
যাওয়ার আগে আরও একবার মহাকালীর মন্দিরে সেই সুড়ঙ্গমুখে এসে চাপা দেওয়া পাথরে মাথা রেখে ‘চণ্ডিকা মহামন্ত্র’ জপ করলাম। শারদ ও বাসন্তী নবরাত্রে এখানে এসে সওয়া লক্ষ আহুতি দ্বারা মহাযজ্ঞে শামিল এ জীবনে হয়তো কখনও হতে পারব না, তবে রুদ্রপ্রয়াগে তো আমি মাঝে মধ্যেই আসি। তখনই আরও একবার এখানে এসে একটা রাত্রি কালীমঠে অতিবাহিত করে যাব, এমনই মন করলাম।
কালীমঠকে কেন্দ্র করে এবার থেকে হিমালয়ের অন্য তীর্থ দর্শন করব। এও আমার বাসনা। এর আশপাশে শৈবতীর্থ ছাড়া দেবী তীর্থও তো খুব একটা কম নেই। মা মহাকালীর কৃপা হলে এর সর্বতীর্থে আমি পরিব্রজন করব। কালীমঠের দুই প্রান্তে আছে কোটি মাহেশ্বরী ও রাকেশ্বরীর দুটি মন্দির। সেও দারুণ মহিমান্বিত। গুপ্তকাশীর অর্ধক্রোশের মধ্যে আছ ললিতাদেবীর মন্দির। কেদারের পথে মৈখচণ্ডীতে আছে মহিষমর্দিনীর মন্দির। রামসু গ্রামের শ্রীদুর্গার মহামন্দিরও প্রসিদ্ধ। কুম্ভমেলার সময় হরিদ্বারে যখন মেলা হয় এখানেও তখন মেলা বসে। অতএব কালীমঠের এই মহা সতীপীঠে আশ্রয় নিয়ে হিমালয়ের পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দই যে আলাদা।
তাই অনেক আনন্দ বুকে নিয়ে আরও একবার মহাকালীকে প্রণাম জানিয়ে আবার গুপ্তকাশীর পথে রওনা হলাম। যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হয় তাহলে আজই রুদ্র প্রয়াগে গিয়ে অলকানন্দা ও মন্দাকিনী সঙ্গমে নারদশিলায় জলতর্পণ করব। রাত্রিবাসের জন্য আমার প্রিয় সাটি লজ তো আছেই।
(সমাপ্ত)
অলংকরণ : সোমনাথ পাল