পিতার স্বাস্থ্যহানী হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
‘তিনি বলিলেন, না মা, আজি আমি, এখন পর্যন্ত কিছুই খাই নাই। তখন সেই স্ত্রীলোক ঠাকুরদাসকে বলিলেন, বাপাঠাকুর জল খাইও না, একটু অপেক্ষা কর। এই বলিয়া নিকটবর্তী গোয়ালার দোকান হইতে, সত্বর দই কিনিয়া আনিলেন এবং আরও মুড়কি দিয়া, ঠাকুরদাসকে পেট ভরিয়া ফলার করাইলেন। পরে তাঁহার মুখে পরিশেষ সমস্ত অবগত হইয়া, জিদ করিয়া বলিয়া দিলেন, যে দিন তোমার এরূপ ঘটিবেক, এখানে আসিয়া ফলার করিয়া যাইবেক।’ এরপরে যেদিন ঠাকুরদাসের এমন অনাহার ঘটত— সেদিন তিনি ওই মহিলার কাছে গিয়ে পেট ভরে খেয়ে নিতেন।
এমনি করে দিন যেতে লাগল। ঠাকুরদাস একটা সাধারণ ধরনের কাজ পেলেন— মাইনে মাসে দু’ টাকা। কোনওক্রমে পেট চালিয়ে নিয়ে ঠাকুরদাস মাইনের পুরোটা মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিতে লাগলেন। বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তি একটা প্রবাদে পরিণত হয়েছিল, তা নিয়ে গল্প পর্যন্ত তৈরি হয়ে গেছিল— তা যে তাঁর বাবার কাছ থেকে পাওয়া উত্তরাধিকার সূত্রে— তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দু’-তিন বছর পরে মাইনে বেড়ে হল পাঁচ টাকা। এর সিংহভাগটি মা দুর্গাদেবীর কাছে দিতেন— তাঁর দুর্গতি এবারে অনেক কমে গেল। মনের আনন্দে ঠাকুরদাস কাজ করতে লাগলেন— মন দিয়ে। এই সময়ে তাঁর বাবাও ফিরে এলেন— বনমালীপুরে স্ত্রীর সন্ধান না পেয়ে লোকের কাছে শুনে বীরসিংহায় এলেন। সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। দুর্গাদেবীর সংসারে আবার হাসির মুখ দেখা দিল। বড় ছেলের ততদিনে বাইশ-তেইশ বছর বয়স, তাঁকে দেখবার জন্যে রামজয় কলকাতায় এলেন বড়বাজারের ভাগবতচন্দ্র সিংহের বাড়ি। ততদিনে ঠাকুরদাসের মাইনে পাঁচ থেকে বেড়ে আট টাকা হয়েছে। কোথাও যদি পাঠক দেখতে পান তাঁর মাইনে বাড়তে বাড়তে দশ টাকা হয়েছে— ভেবে নেবেন দশচক্রে ভগবান ভূত হয়েছেন— অষ্ট তঙ্কার বেশি মাইনে তাঁর কোনও দিন হয়নি— কেবল কর্মত্যাগের আগে শেষবার বেড়ে হয়েছিল দশ। বাড়িয়ে বলা বাঙালিরা সেটাকে একেবারে দ্বিগুণ করে কুড়িতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁদের উদ্দেশ্যে ঠাকুরদাসের আর এক পুত্র শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন তাঁর ‘ভ্রমনিরাশে’ লিখে গিয়েছেন— ‘তাঁহার বেতন দশ টাকা ছিল। তাঁহার বেতন কখনও দশ টাকার ঊর্ধ্ব হয় নাই।’ শেষের দিকে বড়িশার এক না-বালকের সম্পত্তি দেখাশোনা করার চাকরি করেছিলেন— তারানাথ বাচস্পতি তাঁকে একদা যে চাকরিটির জোগাড় করে দিয়েছিলেন, তার সেই দু’ টাকা মাইনে বেড়ে দশ টাকা— ভাবাই যায় না সেকালে। আর যখন পাঁচ টাকা মাইনে ছিল— তখন ঠাকুরদাস ঈশ্বরচন্দ্রকে হিন্দু কলেজে পড়িয়ে ওই পাঁচ টাকাই খরচ করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। সাধে কি কাশীবাসী বাবাকে তিনি কাশীর বিশ্বনাথের সমান মর্যাদা দিতেন। দু’ টাকা মাইনে বেড়ে পাঁচ হয়ে গেছিল ভাগবতচরণ সিংহের বাড়িতে কাজ করতে করতেই। তিনি মারা গেলে তাঁর ছেলে জগদ্দুর্লভ সিংহ মশায় ঠাকুরদাসকে পূর্ণমর্যাদায় বহাল রেখেছিলেন। বড়বাজারের দ’য়েহাটায় তাঁদের বিশাল বাড়িতে ছেলেকে দেখবার জন্যে রামজয় যে এতটুকু ইতস্তত করেননি— তার কারণ তর্কভূষণ মশায়ের সঙ্গে এই বাড়ির পরিচয় ছিল আগে থেকেই। তিনি এসেছেন দেখে ভাগবতচরণ রামজয়কে বলেছিলেন আপনি ছেলেকে আমার কাছে নিশ্চিন্তে রেখে যান। সেই প্রস্তাবেই ঠাকুরদাসের এ বাড়িতে থাকা খাওয়ার সুবন্দোবস্ত হয়েছিল। রামজয় নিশ্চিন্তে বীরসিংহায় ফিরে গেলেন। তাঁর কাছে ঠাকুরদাসের মাইনে ভালো হয়েছে জেনে দুর্গাদেবীর আনন্দের আর অবধি রইল না। বাপ-ঠাকুরদার সূত্রে পাওয়া তেজস্বিতা ও আত্মমর্যাদা বিদ্যাসাগরকে এত মহীয়ান করে তুলেছিল। স্বাধীনতাপ্রিয়তা ও সত্যবাদিতাও তাঁর এই উত্তরাধিকার সূত্রেই পাওয়া। বিদ্যাসাগরের বগ্ভঙ্গিও তাঁর ঠাকুরদা তাঁকে বকলমে দিয়েছিলেন। রামজয় গলা উঁচু করে বলতেন— ‘এদেশে মানুষ নেই, সব গোরু।’ একবার রামজয় পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, জনৈক পথচারী তাঁকে ডেকে বললেন— ও পথটা দিয়ে যাবেন, গোটা পথেই মল-মূত্র ছড়িয়ে আছে। শুনে রামজয় বললেন— পথে তো দেখছি সব গোরু! একবার গাঁয়ের জমিদার তাঁকে কিছু জমি দান করে সেখানে থাকার প্রস্তাব দিলে রামজয় ভিক্ষার দান নিতে অস্বীকার করেন। তাঁর মতে অন্যের খোশামুদি করে কিছু নেওয়ার চেয়ে মরে যাওয়াটা অনেক ভালো। শরীরেও তাঁর প্রবল বল। একবার একটা ভালুককে গাছের উল্টো দিক থেকে ধরে গাছের গায়ে এমন করে ঘষে ছাল-চামড়া তুলে দেন যে ভালুক শাঁখআলু চিনতে পেরেছিলেন। ঠাকুরদাস দুটো পয়সা রোজগার করছেন দেখে রামজয়ের বিপুল স্বস্তি। চিরকালের ভবঘুরে স্বভাবের রামজয় এর মধ্যে তীর্থ ভ্রমণে বের হয়ে গেলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের জন্মের আগে আবার গ্রামে ফিরে আসেন। ততদিনে ঠাকুরদাস বিয়ে করেছেন ভগবতীদেবীকে।
রামজয় যখন ফিরে এলেন তখন গর্ভবতী দুর্গাদেবী আসন্নপ্রসবা। আপাতত গর্ভজনিত উন্মাদরোগে পীড়িতা। নানা টোটকা নানান জনে ব্যবস্থা দিলেন। শেষ অবধি সন্তান জন্মের পরে পরেই তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। এঁড়েবাছুরকে পাগলেও ভয় পায়। ঘটে গেলও তাই। ভগবতীদেবীর কথা আমাদের বলতেই হবে— এমন মা না হলে কি এমন ছেলের জন্ম হয়!
ঠাকুরদাস বাঁড়ুয্যে যেভাবে বড় হয়েছেন, তার বাবা বাউন্ডুলে রামজয় তর্কভূষণ যেভাবে সংসারের ‘দায়িত্ব’ পালন করেছেন— তা যেটুকু ছবি পাঠক মহোদয়েরা এখানে দেখতে পেয়েছেন— তাতে তো তাঁদের আর্থিক অনটন নিয়ে পাঠকদের মনে সংশয় নেই যে তাঁদেরকে হাড়-হাভাতে না বলতে পারলেও আজকের ‘রেশন’-এর পরিভাষায় বিপিএল শ্রেণীভুক্ত সহজেই বলতে পারা যায়— অর্থাৎ বিলো প্রভার্টি লেভেল— গরিবদের চেয়েও একধাপ নীচে— সাধুভাষায় অকিঞ্চন বলতে পারব হয়তো! নামে দুর্গা কিন্তু দুর্গতির চরমতর অবস্থায় দিন কেটেছে। কুটিরে বাড়তি একটা লোক এলে বসতে-শুতে দেবার জায়গা নেই। লোক বলে বাপ কা বেটা, কেউ বলেন না— শাশুড়ি কি বহু। তো তাই হল ভগবতী দেবীর ক্ষেত্রেও। সেকালে বাঙালির সংসারে বারো বছরের এপাশ ওপাশেই বেটাছেলেরা বিয়ে করতেন। অথচ বাইশ-তেইশ বছরেও ঠাকুরদাসের বিয়ে হয়নি। দু’ টাকা মাইনে থেকে বেড়ে পাঁচ, পাঁচ থেকে আটে গিয়ে পৌঁছলেও স্ত্রীকে একখান শাড়ি কিনে দেবার সামর্থ্য কোনও পুরুষ মানুষের থাকে না। কাজেই বিয়ের বয়স পার হয়ে ঠাকুরদাসকে বিয়ে করতে হল। রোজগারটা আহামরি কিছু নয়, কিন্তু সংস্কৃত জানেন ভালো, দু’ কলম ইংরেজিটাও রপ্ত করেছেন মন্দ নয়। সচ্চরিত্র, যাকে বলে সাত্ত্বিক। পাত্র হিসেবে খুব একটা ফেলনার নয়।
অলঙ্করণ: সোমনাথ পাল