পিতার স্বাস্থ্যহানী হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
ঔপন্যাসিক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল এক নতুন যুগের। জন্ম হল উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় নামে এক স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানের। সম্পর্কে তিনি ছিলেন কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মামা। তিনি তাঁর জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন ভাগলপুরে। তাঁর যখন বারো বছর বয়স সেইসময় তাঁর প্রথম পদ্য ‘সন্ধ্যা’ প্রকাশিত হয় ‘সখা ও সাথী’ নামে এক মাসিক পত্রিকায়। সেই প্রথম পদ্যই তৎকালীন গুণীজনদের প্রশংসা আদায় করতে সক্ষম হয়েছিল। অত্যন্ত সাহসী এই মানুষটির পরলোক, প্রেতাত্মা ইত্যাদি ব্যাপারে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস ছিল না। কোনও আড্ডায় এই ধরনের কোনও প্রসঙ্গ উঠলে তিনি হো-হো করে হেসে বক্তাকে অপ্রস্তুত করে প্রায় থামিয়ে দিতেন।
এইরকম ভূত-অবিশ্বাসী মানুষটিও একদিন তাঁদের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯০২ সালের কথা, সেইসময় তিনি সপরিবারে ভাগলপুর থেকে চলে এসেছেন ভবানীপুরের কাঁসারিপাড়া রোডের একটি ভাড়া বাড়িতে।
মাসটা ভাদ্র, উপেন্দ্রনাথের মা বাড়িতে উদ্যাপন করবেন তালনবমী ব্রত। সেই উপলক্ষে বাড়িতে বেশ কয়েকজন অতিথি এসেছেন। তাঁরা রাতের আহার করেই বাড়ি ফিরবেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন উপেনবাবুর অত্যন্ত পরিচিত শ্যামরতন চট্টোপাধ্যায় ও দ্বিজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। দ্বিজেন্দ্রনাথবাবু নাকুবাবু নামেই বন্ধু মহলে বেশী পরিচিত ছিলেন।
কাঁসারিপাড়ার বাড়ির বৈঠকখানায় তখন আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। হঠাৎই নাকুবাবু বললেন, উপেনবাবু আপনার এই বাড়িতে কিন্তু ভূত আছে।
তাঁর কথা শুনে উপেনবাবু সহ সবাই হইহই করে হেসে উঠলেন।
তাঁদের বিদ্রূপাত্মক হাসিতে একটু আহতই হলেন নাকুবাবু, তিনি উষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠলেন, এখন হাসছেন হাসুন! কিন্তু সেই ভূত যখন আপনাদের সামনে এসে দাঁড়াবে, তখন আপনাদের মুখ থেকে আর কোনও কথা বেরবে না।
অতিথিদের মধ্যে একজন তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, আপনি কী করে জানলেন এ বাড়িতে ভূত আছে?
নাকুবাবু বললেন, এক মাস, দু’মাস নয় এই বাড়িতে আমরা বছর খানেক কাটিয়ে গিয়েছি। এখানে আমরা ভাড়া থাকতাম। আমি নিজের চোখে সেই ঘটনা দেখেছি।
উৎসাহী এক অতিথি জানতে চাইলেন আপনি কী দেখেছিলেন বলুন না আমাদের?
নাকুবাবু গুছিয়ে বসে গল্প শুরু করলেন। বললেন, শুনুন তাহলে! আমাদের আগে এই বাড়িতে যাঁরা ভাড়া থাকতেন, তাঁদের বছর চারেকের একটি ছেলে ছিল। সারাটা দিন সে মার্বেলের গুলি নিয়ে বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় খেলে বেড়াত, কখনও কখনও রাতে ঘুম ভেঙে গেলেও সে তার ঘরের মেঝেতে মার্বেল গড়িয়ে দিত। সেই ছেলেটি মারাত্মক কলেরায় একদিন হঠাৎই মারা গেল। আমরা যে ঘরে বসে এখন গল্প করছি এর ওপরের ঘরটাতেই বাবা-মায়ের সঙ্গে ছেলেটি থাকত। ওই ঘরেই সে মারা যায়। তারপর থেকে প্রতিদিন রাত একটার সময় ছেলেটি ওই ঘরে একবার করে মার্বেল ছড়িয়ে দেয়। শান্ত রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে সেই মার্বেল ঠক ঠক করে গড়িয়ে যায় ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথায়। আর সেই শব্দে অতি সাহসী মানুষেরও মশাই বুকের রক্ত হিম হয়ে যাবে।
ইতিমধ্যে ভিতর বাড়ি থেকে অতিথিদের খেতে যাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছেন উপেন্দ্রনাথবাবুর ভাগ্নে সুশীলচন্দ্র। রাত তখন সাড়ে দশটা। আড্ডা ভেঙে গেল, সবাই রওনা হলেন রাতের আহার সারতে।
খাওয়া সেরে যখন প্রায় সব নিমন্ত্রিতই বিদায় নিয়েছেন ঠিক সেইসময় উপেন্দ্রনাথ তাঁর ঘনিষ্ট বন্ধু শ্যামরতন চট্টোপাধ্যায়কে বললেন, এখন তো প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। আর ঘণ্টা দেড়েক অপেক্ষা করলেই আমরা শুনতে পাব বালক ভূতের মার্বেলের শব্দ। আজ তুমি রাতটা এখানেই থেকে যাও। আজকেই প্রমাণ হয়ে যাবে সত্যি ভূত আছে কী নেই!
শ্যামরতনবাবু বললেন, আমি তোমাদের এখানে থেকে যেতেই পারি, তবে আমাকে একবার বাড়িতে গিয়ে খবরটা দিয়ে আসতে হবে।
কিছুক্ষণের মধ্যে শ্যামরতনবাবু ফিরে এলেন বাড়ি থেকে। বৈঠকখানার ঘরের আরামকেদারায় তখন নিজের শরীর মেলে দিয়েছেন পরিশ্রান্ত সুশীলচন্দ্র। তাঁদের জন্য তৈরি করা বিছানায় দুই বন্ধু পাশাপাশি শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন সেই বালক ভূতের মার্বেল গড়ানোর শব্দ শোনার জন্য।
বাড়ির সবাই তখন যে যাঁর ঘরে শুয়ে পড়েছেন। ঢং করে একবার শব্দ করে দেওয়াল ঘড়ি জানিয়ে দিল সময় আসন্ন। দুই বন্ধুই বিছানার ওপর উঠে বসলেন। আর ঠিক তখনই ওপরের ঘরের মেঝেতে ঠক ঠক ঠক ঠক করে মার্বেল গড়ানো শুরু হল। সেই আওয়াজে দুই বন্ধু বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন। উপেন্দ্রনাথ এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। তিনি চাইছিলেন নিজের চোখে পুরো ঘটনাটি দেখতে। শ্যামবাবু বন্ধুর ডান হাতের কনুইয়ের কাছটা চেপে ধরে বললেন, এতরাতে সাহস দেখিয়ে আর কাজ নেই। চলো, শুয়ে পড়া যাক। বন্ধুর কথায় উপেনবাবু শুতে চললেন।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই উপেন্দ্রনাথ তাঁর দাদা লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়কে রাতের পুরো ঘটনাটি বললেন। তিনি সব শুনে বললেন, এটা নিয়ে অহেতুক চিন্তা করার কিছু নেই। তবে, একটা কথা মাথায় রেখো, বাড়ির মেয়েরা যেন এই ব্যাপারটা জানতে না পারে। তাহলে অহেতুক ভয় পাবে।
এই ঘটনাটি ঘটার দিন কয়েক পরে শ্বশুরবাড়িতে এলেন লালমোহনবাবুর দ্বিতীয় জামাতা সুবোধচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। পরবর্তীকালে তিনিই হবেন পাটনা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি। সেদিন রাত একটা নাগাদ তাঁর দরজার সামনে মার্বেল গড়ানোর শব্দ পেয়ে তিনি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলেন, তাঁর ঘরের দরজার সামনে একটা ছোট্ট ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সুবোধবাবু তাকে চিনতে পারলেন না। তিনি বাচ্ছাটির কাছে জানতে চাইলেন, তুই কে? এত রাতে এখানে কী করছিস?
প্রশ্ন শুনেই বারান্দার সামনে ঘন গাছটির মধ্যে ছেলেটি অদৃশ্য হয়ে গেল। শিউরে উঠলেন সুবোধচন্দ্র। ইষ্টনাম জপতে জপতে তিনি তড়িঘড়ি ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন বিছানায়। সেই রাতে তিনি দু’চোখের পাতা আর এক করতে পারেননি।
পরবর্তীকালে এই প্রসঙ্গে উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় লিখলেন, ‘সুবোধের অভিজ্ঞতা ও আমাদের অভিজ্ঞতার দুটি গল্পকে স্বতন্ত্রভাবে উড়িয়ে দেওয়া যত সহজ, একত্রে তত সহজ নয়। দুটি গল্পকে সংযুক্ত করে দেখলে মনে হয়, উভয়ের সমষ্টি থেকে কোনও এক সত্যের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।’
(ক্রমশ)
ছবি: পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সৌজন্যে
অলংকরণ: চন্দন পাল