পিতার স্বাস্থ্যহানী হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
সংযত থাকা। মনে রাখতে হবে, এখন রাজনীতির সময় নয়। তার জন্য অনেক সময় পড়ে আছে। রাজনৈতিক স্বার্থে গোলমাল পাকিয়ে ফায়দা লোটার অপচেষ্টা ব্যর্থ করুন। প্রশাসন কঠোর হাতে পরিস্থিতির মোকাবিলা করুক। শান্ত বাংলাকে অশান্ত করার চেষ্টা পরাজিত হোক।
বলা বাহুল্য, এ রাজ্যের পক্ষে সময়টা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তাই সুযোগ সন্ধানীরা ইন্ধন দেবেই। একুশের বিধানসভা নির্বাচনের কাউন্ট ডাউন শুরু হল বলে। সব মিলিয়ে আর পনেরো ষোলো মাস বাকি। বাংলায় এবার মোকাবিলা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সরাসরি বিজেপির। সিপিএম, কংগ্রেস জোট হোক আর নাই হোক, আপাতত এরাজ্যে তারা নিতান্তই এলেবেলে শক্তি, তায় একে অপরের লেজুড়। আপাতত ওদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। এই মুহূর্তে ধারে ভারে সার্বিক গ্রহণযোগ্যতার নিরিখে তৃণমূল অনেকটা এগিয়ে থাকলেও এরাজ্যে লড়াইয়ের চূড়ান্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে মরিয়া হয়ে নেমেছেন অমিত শাহরা। বিজেপি নেতৃত্ব জানেন, এই মুহূর্তে সারা দেশে বাংলার জননেত্রীর মতো সোজা মেরুদণ্ডের আপসহীন লড়াকু আর একজনও নেই। হার্ভার্ড ও অক্সফোর্ডে উচ্চশিক্ষিত কংগ্রেসের তাবড় নেতা নেত্রীরাও মমতার নাছোড় লড়াইয়ের সামনে তাই ম্লান। সম্প্রতি রাজ্যের তিন বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে গেরুয়া দলের ভরাডুবিই প্রমাণ করেছে, এখনও মমতাতেই আস্থা গোটা বাংলার। দু’হাজার একুশেও মমতাকেই বাংলার সিংহাসনে বসানোর জন্য রাজ্যবাসী প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি এবং অগ্নিকন্যা মমতা শক্ত ঠাঁই বুঝেই তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার আগে সংবিধানটাকেই দুমড়ে মুচড়ে তার অন্তর্নিহিত আত্মাকে খতম করে দেওয়ার ভয়ঙ্কর খেলায় নেমেছে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন মোদি ও অমিত শাহের বিজেপি। দরকার হলে গোলপোস্টের অবস্থানটাকেই বদলে দিতেও তাঁরা যে দু’বার ভাববেন না, তাও পরিষ্কার। সেই কারণেই দেশভাগের ক্ষত বয়ে চলা বাংলায় এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন কার্যকর করার কদর্য খেলায় নেমেছে গেরুয়া শিবির। যার আসল উদ্দেশ্য, হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে একজোট করা। তবে একটা কথা বিনা দ্বিধায় বলতে পারি, হার মানার পাত্রী অগ্নিকন্যা নন। শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত আবার ধর্মের ভিত্তিতে মানুষভাগের হীন চক্রান্ত তিনি রুখবেনই রুখবেন। এখনও বাংলার মানুষের সেই বিশ্বাস আছে।
নরেন্দ্র মোদির দল বিলক্ষণ জানে সোজাসাপ্টা লড়াইয়ে একুশে বাংলা দখল কোনওভাবেই সম্ভব নয়। এখানে বিগত তিন দশক ধরে মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা আন্দোলন প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে মমতাকে কেন্দ্র করেই। তিনি বাংলার অবিসংবাদিত নেত্রী। উল্টে, এনআরসির ঠেলায় জেলায় জেলায় ভয় আর আতঙ্কে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে। যেটুকু সমর্থন বিজেপি পেয়েছিল লোকসভা ভোটে, তা দ্রুত কমছে। এই পরিস্থিতিতেই ভারতীয় সংবিধানের বিবেককে বিসর্জন দিয়ে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে, মানুষে মানুষে বিভেদ ও বৈষম্য তৈরির আরও ভয়ঙ্কর খেলায় মেতেছে বিজেপির সরকার। চালু হচ্ছে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদান। তুমি হিন্দু হলে, শিখ হলে, বৌদ্ধ হলে, পার্সি হলে, খ্রিস্টান হলে, জৈন হলে শরণার্থী হয়েও নাগরিকত্ব পাবে। আর মুসলমান হলে, তোমার পরিচয় হবে ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’, বৈধ নাগরিকত্ব তুমি পাবে না। ভারতের সংবিধান যে-দর্শনের উপর দাঁড়িয়ে, তা মানুষে-মানুষে এই বিভেদ বৈষম্যের কথা কখনও বলে না। সব ধর্ম, সব সম্প্রদায়কে সমানভাবে দেখা ও প্রত্যেককে সুবিচার দেওয়ার জন্যই কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ এই সংবিধানের
মূল সুর। অথচ, আজ ৭০ বছর পর এর ঠিক
উল্টোটাই মোদি অমিত শাহদের রাজনীতির ধ্রুবপদ। ফলে ভয়ঙ্কর সঙ্ঘাত ও তার থেকে রক্তক্ষরণ অবশ্যম্ভাবী। হচ্ছেও তাই।
নোটবন্দি এবং ত্রুটিপূর্ণ তড়িঘড়ি জিএসটি চাপিয়ে দেওয়া থেকে রক্ত ঝরছে ভারতের অর্থনীতির। ৩৭০ ধারার ধাক্কায় বিচ্ছিন্ন হয়েছে গোটা কাশ্মীর উপত্যকা। আজ সেই ঘটনার পাঁচ মাস পরেও ওই রাজ্যের তিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কার্যত নজরবন্দি। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে কোনও যোগ নেই উপত্যকার বহু অংশের। আর গতকাল থেকে একই কায়দায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হয়েছে অসমে। গুয়াহাটি, তেজপুর, ডিব্রুগড় জ্বলছে। মানুষ বিপন্ন। প্রাণও হারাচ্ছে। আর ভোটব্যাঙ্কে ফায়দার হিসেব কষছেন বিজেপি নেতারা। আসল সঙ্কটের দিকে তাকানোর সময়ই নেই অমিত শাহদের। দেশজুড়ে যুবসমাজ নানা সমস্যায় দীর্ণ। চাকরি নেই, ব্যবসা নেই, উৎপাদন নেই, শিক্ষার প্রসার নেই। আর এসব নিয়ে কোনও কথা নেই, আলোচনা নেই সংসদেও। মাঝে মাঝে মহামান্য অর্থমন্ত্রী কিছু ঘোষণা করছেন। কিন্তু, তাতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। অর্থনীতি জাগছে না। পুরো সরকারটা মজে আছে শুধু ধর্ম আর তার ভিত্তিতে অবিশ্বাস, ঘৃণা ও বিদ্বেষের মিথ্যে বাতাবরণ তৈরি করতে। মানুষের ধর্ম আর বিশ্বাসকে সম্বল করে ভোট বৈতরণী পার হওয়ার স্বপ্ন বিজেপির মজ্জাগত। আর, পশ্চিমবঙ্গে দেশভাগের আগুন, সব হারানো মানুষের আর্তনাদ আজ সাত দশক পরেও ঘোর বাস্তব। শিশু কোলে শরণার্থী এরাজ্যের মানুষের স্মৃতিতে টাটকা। তাই এনআরসি এবং নাগরিকত্ব বিলের আড়ালে হিন্দুদের মনে সেই দেশভাগের স্মৃতিকে উস্কে হিন্দু ভোটকে নিজেদের পদ্মফুল প্রতীকের দিকে টানার জঘন্য খেলা শুরু হয়েছে। লক্ষ্য, বিধানসভা ভোট। এই আগুন
নিয়ে খেলা বন্ধ করতে না-পারলে এরাজ্যও অন্ধকারে ডুবে যাবে। বিভেদ আর চূড়ান্ত ধর্মীয় মেরুকরণ আখেরে মূল সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টিকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ারই চেষ্টা। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা তুলে নিয়ে রাজ্যকে দ্বিখণ্ডিত করার পর তাই বিজেপির পরবর্তী লক্ষ্য গোটা উত্তর-পূর্বের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গও। আর, বিজেপির এই সাম্প্রদায়িক দাপাদাপি থামাতে পারেন একমাত্র মা-মাটি-মানুষের নেত্রীই।
বাংলায় সিপিএমের দিন গিয়েছে অনেকদিন হল। জাতীয় রাজনীতিতেও বামেদের আর তাৎপর্য নেই। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যপাট হারানোর পর বামেদের সেই যে ভোটব্যাঙ্কের ক্ষয় শুরু হয়েছে তা অতি সম্প্রতি রাজ্যের তিন বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনেও জারি আছে আমরা দেখলাম। কংগ্রেসের অবস্থা আরও করুণ। কার্যত দু’দলই এরাজ্যে অস্তিত্বের তীব্র সঙ্কটে ভুগছে। জোট করেও একে অপরকে জাগাতে পারছে না। নেতৃত্বের সঙ্কটের কারণে জাতীয় স্তরেও কংগ্রেসের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে জোট করে এরাজ্যে সিপিএম-কংগ্রেস দু’তরফেরই ভরাডুবি হয়। ভুললে চলবে না, তখনও বিজেপি এত প্রবলভাবে রাজ্য-রাজনীতিতে মাথা তোলেনি। কিন্তু ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের ফল সংসদীয় রাজনীতিটাকেই চূড়ান্ত একপেশে করে দিয়েছে। বামেদের কার্যত সংসদে দূরবিন দিয়েও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সংখ্যার বিচারে কংগ্রেস আর তেমন কোনও চ্যালেঞ্জ দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। এর বাইরে অধিকাংশ দলই চূড়ান্ত সংশয় ও দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে। যার জেরে লোকসভা তো বটেই রাজ্যসভাতেও বিজেপিকে কোনও বিল পাশ করাতে আর বেগই পেতে হচ্ছে না। বিতর্কের মানও অত্যন্ত দুর্বল। আরও কত কী যে হতে পারে, আগামী পাঁচবছর তা একমাত্র মোদি-অমিত শাহই জানেন। গত মে মাসে ক্ষমতায় আসার পর থেকে একের পর এক বিতর্কিত বিল আইনে পরিণত করে চলেছেন মোদি-শাহ জুটি। তাঁদের যেন বিরাম বিশ্রাম নেওয়ার অবকাশই নেই! লোকসভা তো বটেই রাজ্যসভাও এখন পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। তাই সংসদে বিল পাশ করানো এখন আর কোনও চিন্তার বিষয়ই নয়। তবে, সরকারেরও মনে রাখা দরকার যে ঘৃণা ছড়িয়ে কিন্তু শেষরক্ষা সম্ভব নয়। পাকিস্তান ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল বলেই তার অগ্রগতি ও সামগ্রিক বিকাশ ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের মতো হয়নি। ধর্ম, সম্প্রদায়কে অন্তরাত্মা করলে কোনও রাষ্ট্রই এগতে পারে না। এবার বিজেপি যদি ভারতকে একটি ‘হিন্দু-পাকিস্তান’-এ পরিণত করার কথা ভেবে থাকে তবে ভুলই করবে। এই উন্নত বিশ্বে মাথা উঁচু করে চলার যে পরিসর আমরা অনেক কষ্টে তৈরি করেছি, পরিণামে, সেটুকুও হারাব। আত্মহত্যা কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের ‘চয়েস’ হতে পারে না।