পিতার স্বাস্থ্যহানী হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
হরি হালদার অত্যন্ত ছাপোষা মানুষ। শিলিগুড়ি শহরের রাস্তাঘাটে বাদাম বিক্রি করে সংসার চালান। থাকেন শিলিগুড়ির আশিনগরে। আগে থাকতেন উত্তর দিনাজপুর জেলার চোপড়ায়। এনআরসির কথা তুলতেই মুখ কাঁচুমাঁচু। বলেন, কাগজপত্র চোপড়ায় দাদাদের কাছে আছে বোধহয়। তবে, সবটাই ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছি। বেশি ভাবলেই কেমন যেন...। কথা শেষ না করেই ‘বাদাম চাই, বাদাম’ হাঁক দিয়ে সরে গেলেন।
উত্তর দিনাজপুরে মাটিকুন্ডা ১ পঞ্চায়েতের নতুন ডাঙাপাড়ার হালিমুদ্দিন শেখ বলেন, এদেশেই জন্মেছি... আর এখন প্রমাণ দিতে হবে, আমরা এদেশের নাগরিক! এটা ভাবা যায়? তবে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, এরাজ্যে এনআরসি হবে না। আমরা ওঁর ভরসাতেই আছি।
রাজ্যের উপনির্বাচনে বিজেপি পর্যুদস্ত হওয়ায় কাঠগড়ায় এনআরসি। উপনির্বাচনে এনআরসি অবশ্যই একটা ফ্যাক্টর। কিন্তু, সেটাই প্রধান কারণ নয়। কালিয়াগঞ্জের ক্ষেত্রে কথাটা খাটলেও করিমপুর এবং খড়্গপুরে তৃণমূলের সাফল্যের জন্য শুধু এনআরসিকে নম্বর দিলে ভুল হবে। এনআরসি মূল ফ্যাক্টর হলে করিমপুরে বিজেপির ভোট কিছুতেই বাড়ত না। তাই কেবল এনআরসির দিকে আঙুল তুললে গেরুয়া শিবিরের রাজনৈতিক লাভ ষোলো আনা।
এই মুহূর্তে দেশের অর্থনীতির বেহাল দশা বোঝার জন্য অ্যাডাম স্মিথের ‘ওয়েল্থ অব নেশনস’ পড়ার দরকার নেই। মানুষ টের পাচ্ছে, সংসারের বোঝা দিন দিন হিমালয় হয়ে যাচ্ছে। উপলব্ধি করছে, ‘আচ্ছে দিন’ শুধুই স্লোগান। ১৫ টাকা কেজির পেঁয়াজ ১৫০ টাকা ছুঁয়েছে। ৫০০ টাকা কেজির পোস্ত ১৪০০ টাকা ছুঁয়ে সর্বকালীন রেকর্ড গড়েছে। বেকারি, রেলের মাশুল বৃদ্ধি, পেট্রল-ডিজেল, পেঁয়াজ, পোস্তর মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মানুষের জ্বলুনির অন্ত নেই। তবে, এসব কিছুর দহন ঢেকে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এনআরসিকে ময়দানে নামানো হয়েছে।
হ্যাঁ, এটাই কৌশল। ইস্যু তৈরির কৌশল। বিজেপির ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ অমিত শাহ বারবার বলছেন, এনআরসি হবেই। তাঁর যুক্তি, দেশকে মজবুত করতে গেলে এনআরসিই পথ। অমিত শাহ খুব ভালো করেই জানেন, বোতলবন্দি দৈত্যকে ছেড়ে দিলে তাকে সামলাতেই সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তাকে ঘিরেই আবর্তিত হবে রাজনীতি। এনআরসি কোনও ইস্যুকেই দানা বাঁধতে দেবে না।
রাহুল সিন্হা বাদে বঙ্গ বিজেপির প্রায় সকল নেতা উপনির্বাচনে বিপর্যয়ের জন্য এনআরসির দিকে আঙুল তুলেছেন। বলছেন, এনআরসি নিয়ে তৃণমূল মানুষকে ভুল বুঝিয়েছে।
অনেকেই বলছেন, উপনির্বাচনে খারাপ ফলের জন্য এনআরসিকে বড় করে দেখানোটা বিজেপির একটা কৌশল। কারণ এনআরসিকে ‘ভিলেন’ বানাতে পারলেই এক ঢিলে দু’টি পাখি মরবে। কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে বেশি চর্চা হবে না। আবার আলোচিত হবে না সংশোধন প্রক্রিয়ার ফলে তৃণমূলের ঘুরে দাঁড়ানোর কারণগুলি।
গেরুয়া শিবিরের এক তাত্ত্বিক নেতা এখনও ২০২১ সালে এরাজ্যে ভালো ফল করা নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী। তাঁর কথায়, এখন যাঁরা এনআরসি নিয়ে লম্ফঝম্ফ করছেন, বিধানসভা নির্বাচনে তাঁরাই চোখে সর্ষে ফুল দেখবেন। কারণ আতঙ্ক দূর করার দাওয়াই আছে অমিতজির ঝুলিতেই।
বিজেপির ওই নেতার কথা শুনে বহু বছর আগের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। রাজ্যে তখন বামশাসনের স্বর্ণযুগ। উত্তর ২৪ পরগনার ভাটপাড়ায় সিপিএম আর তৃণমূল কংগ্রেসের লড়াই লেগেই থাকত। সিপিএমের এক হার্মাদ নেতাকে গ্রেপ্তারের দাবিতে থানায় তৃণমূল বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। বিক্ষোভের পাশাপাশি শুরু হল রাস্তা অবরোধ। অবরোধ তুলতে গিয়ে অফিসার আচমকা লাঠিচার্জ করায় একটি ছেলের মাথা ফেটে গেল। উত্তেজনা চরমে। দাবি বদলে গেল, অভিযুক্ত পুলিস অফিসারের শাস্তি চাই। বিক্ষোভ জোরদার হল। শুরু হল ভাঙচুর। বারাকপুর থেকে এক অফিসার বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে এসেই চারদিক দেখে নিলেন। চোখের ইশারায় পজিশন নিল পুলিস। তারপর লাঠি উঁচিয়ে রে রে করে তেড়ে গেল। সামনে যাকে পেল, তাকেই গাড়িতে তুলল। মুহূর্তে এলাকা ফাঁকা।
কিছুক্ষণ পর তৃণমূলের এক নেতা দু’-একজনকে নিয়ে থানায় গিয়ে ওই অফিসারকে বললেন, যাদের ধরেছেন, তারা নির্দোষ। দয়া করে ছেড়ে দিন। অফিসার বললেন, ‘কেস দিয়ে সবাইকে কোর্টে চালান করে দেব। ইয়ার্কি হচ্ছে! পুলিসের সঙ্গে মস্তানি।’ তখন সকলে হাতজোড় করে বলেন, স্যার, দয়া করে ছেড়ে দিন। আর এরকম হবে না। অফিসার বললেন,‘এলাকা যেন একদম ফাঁকা হয়ে যায়। ঘণ্টাখানেক পর মুচলেকা দিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে।’ নেতা সহ সকলেই পুলিস অফিসারকে ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার’ বলে গদগদ চিত্তে বিদায় নিলেন।
নেতা যেতেই অফিসার চায়ের অর্ডার দিয়ে মুচকি হেসে বললেন, দেখলেন, কী ভাবে সিচ্যুয়েশন কন্ট্রোল করলাম। ওরা যে দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিল, সেটাই ভুলে গেল। এখন লোকজনকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারলে বাঁচে। ওরা মার খেল, মাথা ফাটল, রক্ত ঝরল। আবার ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার’ বলে গেল। জেলের আতঙ্ক তৈরি করতে না পারলে থামানোই কঠিন হতো।
প্রশাসনই হোক, আর রাজনীতিই হোক, কৌশলটাই আসল। প্রয়াত অনিল বিশ্বাস দেখিয়ে গিয়েছেন, জনপ্রিয়তার তলানিতে পৌঁছেও স্রেফ কৌশলে কীভাবে ক্ষমতায় থাকা যায়। ২০০১ সালে ভাঙনের মুখে অনিলবাবু দলের ‘বিদ্রোহী’ নেতাদের আলিমুদ্দিনে ডেকে বলেছিলেন, ক্ষমতাচ্যুত হলে তাঁদের তৃণমূল কী হাল করে ছাড়বে! দোদুল্যমান নেতাদের আতঙ্কিত করে তিনি এককাট্টা করেছিলেন। তা না হলে ২০০১ সালেই ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো।
আবার কৌশলী না হলে উন্নয়ন করে, চাকরি দিয়েও ক্ষমতা ধরে রাখতে না পারার উদাহরণ সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সরকার। প্রচুর চাকরি দিয়ে, উন্নয়ন করেও পাঁচ বছরের বেশি টিকতে পারেনি। নিজের দ্বন্দ্ব, মারামারি রুখতে মূলত সিদ্ধার্থশঙ্করবাবুর পরামর্শে জরুরি অবস্থা জারি করেও নয়। উল্টে জরুরি অবস্থার জন্যই কংগ্রেসকে গোটা দেশ থেকে সমূলে উৎখাত হতে হয়েছিল। সুতরাং ক্ষমতায় টিকে থাকার শর্ত, হতে হবে কৌশলী।
২০২১ সালে এরাজ্যের নির্বাচনে এনআরসিই প্রধান ইস্যু হতে চলেছে। বিশেষ করে উপনির্বাচনের এই ফলাফলের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সিপিএম নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী সকলেই এনআরসিকে মূল হাতিয়ার করতে চাইবেন। কিন্তু, একটা কথা মনে রাখতে হবে, দৈত্য যত ভয়ঙ্করই হোক, সে মালিকের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। কারণ দৈত্য মালিকের কেনা গোলাম।
অনেকেই বলছেন, এনআরসি নিয়ে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ জুটির রয়েছে নিখুঁত পরিকল্পনা। চেষ্টা করলে অনুপ্রবেশ ঠেকানো হয়তো সম্ভব। কিন্তু, লক্ষ লক্ষ মানুষকে ‘ডিটেনশন ক্যাম্পে’ রাখা বা তাদের নিজের দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়। এটা তাঁরা খুব ভালো করেই বোঝেন। তবুও এনআরসির কথাই বলছেন। কারণ তাঁরা বিরোধীদের এনআরসি ইস্যুতেই বেঁধে রাখতে চাইছেন। তাঁরা মনে করছেন, ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলই হবে তাঁদের তুরুপের তাস। ওই বিলে শুধু আতঙ্কের ক্ষতে মলমের ব্যবস্থাই নেই, আছে বিরোধীদের ঘায়েলের অস্ত্রও।
তাঁরা মনে করছেন, সংশোধনী বিলের যারা বিরোধিতা করবে, মুসলিম ছাড়া সকল সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে তাদের ‘ভিলেন’ বানানো সহজ হবে। এরাজ্যে তারা বলবে, তৃণমূল শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দিতে চায় না বলেই বিলের বিরোধিতা করছে। এনআরসি আতঙ্কে ভোগা মানুষের একটা বড় অংশ বিজেপির প্রচার বিশ্বাসও করবে। কথায় আছে, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। আর তখনই অমিত শাহের এনআরসি ইস্যু বৃত্ত সম্পূর্ণ করবে।
যে কায়দায় পুলিস নিরীহদের হাজতে ভরে আতঙ্ক তৈরির পর মুক্তি দিয়ে ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার’ পায়, একইভাবে এনআরসি আতঙ্ক থেকে মুক্তি দিয়ে মোদি-অমিত শাহ জুটি ‘স্যালুট’ কুড়াবেন। আর তখন বিরোধীরা সরকার বিরোধী ইস্যু তৈরি করতে নাকানি চোবানি খাবে। তাই এনআরসি সত্যিই দেশ গড়ার পথ, নাকি ক্ষমতায় পৌঁছনোর ইস্যু, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। মনে রাখতে হবে, ছলনা শুধু দুর্জনের অস্ত্র নয়, রাজনীতির কৌশলও।