পিতার স্বাস্থ্যহানী হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
দুর্গাদেবী আর রামজয়ের বড় ছেলেই ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়— আমাদের ঈশ্বরচন্দ্রের বাবা। ঠাকুরদাসের অন্য ভাইবোনেরা হলেন— কালিদাস, মঙ্গলা, কমলা, গোবিন্দমণি আর অন্নপূর্ণা। ছোট্ট বিদ্যাসাগর কলকাতা যাবার পথে এই ছোটপিসির বাড়িতে গেছিলেন আমরা যথাসময়ে দেখব। এই ঠাকুরদাসের সাত ছেলে। চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বিদ্যাসাগর জীবনীতে পরে সংশোধন করে নিলেও প্রথমে ভুল করে লিখেছিলেন বিদ্যাসাগরেরা ছয় ভাই-বোন। পরে ঈশ্বরচন্দ্রের ভাই শম্ভুচন্দ্রের পরামর্শে লেখেন সাত ভাই। ঠাকুরদাস যেমন বাবার বড় ছেলে ছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্রও তেমনই ঠাকুরদাসের প্রথম সন্তান এবং পুত্রসন্তান। তাঁর অন্য ভাই-বোনেরা যথাক্রমে দীনবন্ধু, শম্ভুচন্দ্র, হরচন্দ্র, হরিশ্চন্দ্র, ঈশানচন্দ্র, শিবচন্দ্র— তিনটি বোন পরপর মনোমোহিনী, দিগম্বরী, মন্দাকিনী। কথাপ্রসঙ্গে বলে নিই দিগম্বরীর স্বামীকে চণ্ডীচরণ ভুল করে লিখেছিলেন— অঘোরনাথ মুখোপাধ্যায়, তিনি আসলে ছিলেন চট্টোপাধ্যায়। আরও একটা কথা এই ফাঁকে বলে নিই— নইলে এঁড়ে বাছুর নাম দেওয়াটা নিরর্থক মনে হবে। রামজয় স্ত্রীর আশ্রয়ে এসে উঠলেন বটে, কিন্তু অচিরে আলাদা একটি কুঁড়েঘর তৈরি করে সেখানেই বাকি জীবনটা কাটিয়েছিলেন। প্রবল আত্মমর্যাদা ছিল তাঁর, নির্লোভ ছিলেন বলেই সংসার ত্যাগ করেছিলেন। যতই হোক এঁড়ে বাছুরের ঠাকুরদা বলে কথা!
আমরা সবাই জানি বিদ্যাসাগর মশায় একসময় আত্মচরিত লিখতে শুরু করেছিলেন, সেই অসমাপ্ত আত্মচরিত-এ বিদ্যাসাগর মশায় ভুবনেশ্বর থেকে ঠাকুরদাসের বংশপরিচয় নিজেই এই ভাষায় লিখে গেছেন: ‘প্রপিতামহ-দেব ভুবনেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের পাঁচ সন্তান। জ্যেষ্ঠ নৃসিংহরাম, মধ্যম গঙ্গাধর, তৃতীয় রামজয়, চতুর্থ পঞ্চানন, পঞ্চম রামচরণ। তৃতীয় রামজয় তর্কভূষণ আমার পিতামহ। বিদ্যালঙ্কারের দেহত্যাগের পর, জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম সংসারে কর্তৃত্ব করিতে লাগিলেন। সামান্য বিষয় উপলক্ষে, তাঁহাদের সহিত রামজয় তর্কভূষণের কথান্তর উপস্থিত হইয়া, ক্রমে বিলক্ষণ মনান্তর ঘটিয়া উঠিল। তিনি কাহাকেও কিছু না বলিয়া এককালে দেশত্যাগী হইলেন।’
‘বীরসিংহ গ্রামে উমাপতি তর্কসিদ্ধান্ত নামে এক অতি প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ছিলেন।.... রামজয় তর্কভূষণ এই উমাপতি তর্কসিদ্ধান্তের তৃতীয় কন্যা দুর্গাদেবীর পাণিগ্রহণ করেন।.... রামজয় দেশত্যাগী হইলেন, দুর্গাদেবীকে দুই পুত্র ও চার কন্যা নিয়ে পিত্রালয়ে যাইতে হইল।.... কিছুদিনের মধ্যেই.... পিত্রালয়ে কালযাপন.... বিলক্ষণ অসুখের কারণ হয়ে উঠিল.... তিনি স্বীয়বাটীর অনতিদূরে এক কুটির তাঁর পিতা নির্মাণ করে দিলে সেই কুটিরে.... অতিকষ্টে দিনপাত করিতে লাগিলেন।’
‘ঠাকুরদাস প্রথমে বনমালীপুরে ও পরে বীরসিংহে’ পড়াশোনা আরম্ভ করেন। কিন্তু সে সময়ে ইংরেজির চাহিদা হবে— এই অনুমান করে বাড়িতে শিক্ষক রেখে ইংরেজি শিখতে আরম্ভ করেন। এখানে একটি বিষয় পাঠকদের নজরে এসেছে। আমি শুরুতেই গ্রামের নাম লিখেছি বীরসিংহা, এখন দেখছি স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র লিখছেন বীরসিংহ। প্রায় সকলেই গ্রামটির নাম ‘বীরসিংহ’ বলেই জানেন। ঈশ্বরচন্দ্র নিজের উইলে গ্রামের নাম লিখেছেন বীরসিংহ— তবে কেন বীরসিংহা লিখছি? একটা বাড়তি খবর জানিয়ে রাখি, আমরা পুরনো নথিতে গ্রামের নাম ‘বীরসিঙ্গা’ও পেয়েছি। ঈশ্বরচন্দ্রের মধ্যমভ্রাতা শম্ভুচন্দ্র যখন বিদ্যাসাগরের জীবনচরিত লেখেন— তিনিই বীরসিংহা নামটি আদ্যোপান্ত লিখে গেছেন। ‘ভ্রমনিরাশ’ গ্রন্থেও তিনি ‘বীরসিংহা’ নামটি উল্লেখ করেছেন। বীরশিঙ্গা নামটি লোকোচ্চারণে বীরসিংহা হওয়া স্বাভাবিক। সম্ভবত বিদ্যাসাগরকে পুরুষসিংহ বলার সুবাদে গ্রামের নাম লোকমুখে ‘বীরসিংহ’ নামে পরিচিত হয়। এইরকম একটা অনুমান এবং শম্ভুচন্দ্রের সততার কারণে গ্রামটিকে বীরসিংহা নামে উল্লেখ করেছি। বিতর্ক উপস্থিত হলে হয়তো সত্য উদ্ঘাটিত হতে পারে। বীরশৃঙ্গা— বীর যে শৃঙ্গ বাজায়— তা থেকে বীরসিংহা শব্দ আসাটা তো স্বাভাবিকই।
পিতৃদেব ঠাকুরদাসের কথা বলতে গিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর অসমাপ্ত আত্মচরিতে দুর্গাদেবী শত দুঃখ সয়ে সন্তানদের বড় করে তুলেছিলেন তার বেদনাবিদ্ধ বর্ণনা দিয়েছেন— ‘টেকুয়া ও চরকায় সুতা কাটিয়া, সেই সুতা বেচিয়া’ দুর্গাদেবী সংসারযাপন করে বড় ছেলে ঠাকুরদাসকে চোদ্দো-পনেরো বছরের বড় করে তুললেন। ঠাকুরদাসের হাতের লেখাটি বড় পরিচ্ছন্ন ছিল। বাড়িতে আর পাঠশালায় পড়াশোনা করে বাংলা ভাষাটা ভালোই রপ্ত করেছিলেন। শিখে ফেলেছিলেন জমি-জায়গা আর জমিদারি হিসেব নিকেশের কাজ। ছেলে লায়েক হয়েছে বুঝে রামজয় তাঁকে নিয়ে কলকাতা রওনা দিলেন। মা দুর্গাদেবী আশীর্বাদ করে রওনা করে দিয়ে বলে উঠলেন মঙ্গল কামনায়— দুগ্গা দুগ্গা— মা দুর্গতিনাশিনী— তুমি ওকে রক্ষা করো—
রামজয়ের বড় ভরসা ছেলের ওপর— কত যত্ন করে ব্যাটা সংক্ষিপ্তসার ব্যাকরণ পড়ে শেষ করেছে। ন্যায়ালঙ্কারের চতুষ্পাঠীতে পড়ে সংস্কৃতে বেশ তুখোড় হয়ে উঠেছে, ইংরেজিটাও পড়ে নিয়েছে কাজচলা গোছের শিখেছে, এটার আরও একটু উন্নতি না করলে চলবে না। একজন শিপ সরকার— জাহাজিবাবুকে খুঁজে বের করে দিলেন বাগবাজারের সভারাম বাচস্পতি— তাঁর বাড়িতেই আপাতত উঠেছেন বাপ-ব্যাটায়। একদিন তাঁর শিক্ষক তাঁকে জিগ্যেস করলেন, এমনিতেই তুমি রোগা-পটকা, তারপর দেখছি তুমি দিন দিন হাড়জিরজিরে হয়ে পড়ছ— কী ব্যাপার? ঠাকুরদাস বললেন, বাবা আমাকে রেখে আবার তীর্থভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছে। দুপুরে একবার খাবার জোটে, রাতে একেবারে উপোসি থাকি— তাতেই এত দুর্বল হয়ে পড়ছি। কথাটা এক অব্রাহ্মণ ভদ্রমানুষ শুনে বললেন, তুমি যদি নিজের হাতে রেঁধে খেতে পার— আমি তোমাকে প্রতিদিন সিধে দেব। ঠাকুরদাস যেন হাতে চাঁদ পেলেন। কিন্তু তবুও সব দিন সামলে উঠে রাঁধতে পারেন না। অভুক্ত থাকতেই হয়। এবার বাকি অবস্থাটা ঈশ্বরচন্দ্রের কলমের লেখা থেকে পড়ে নিন।
‘একদিন, মধ্যাহ্ন সময়ে ক্ষুধায় অস্থির হইয়া, ঠাকুরদাস বাসা হইতে বহির্গত হইলেন এবং অন্যমনস্ক হইয়া, ক্ষুধার যাতনা ভুলিবার অভিপ্রায়ে, পথে পথে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ ভ্রমণ করিয়া, তিনি অভিপ্রায়ের সম্পূর্ণ বিপরীত ফল পাইলেন। ক্ষুধার যাতনা ভুলিয়া যাওয়া দূরে থাকুক, বড়বাজার হইতে ঠনঠনিয়া পর্যন্ত গিয়া, এত ক্লান্ত এবং ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় এত অভিভূত হইলেন যে, তাহার আর চলিবার ক্ষমতা রহিল না। কিঞ্চিৎ পরেই, তিনি এক দোকানের সম্মুখে উপস্থিত ও দণ্ডায়মান হইলেন; দেখিলেন এক মধ্যবয়স্কা বিধবা নারী ওই দোকানে বসিয়া মুড়ি মুড়কি বেচিতেছেন। তাঁহাকে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া, ওই স্ত্রীলোক জিজ্ঞাসা করিলেন, বাপাঠাকুর দাঁড়াইয়া আছ কেন। ঠাকুরদাস, তৃষ্ণার উল্লেখ করিয়া পানার্থে জল প্রার্থনা করিলেন। তিনি, সাদর ও সস্নেহ বাক্যে ঠাকুরদাসকে বসিতে বলিলেন এবং ব্রাহ্মণের ছেলেকে শুধু জলে দেওয়া অবিধেয়, এই বিবেচনা করিয়া, মুড়কি ও জল দিলেন। ঠাকুরদাস যেরূপ ব্যগ্র হইয়া, মুড়কিগুলি খাইলেন, তাহা এক দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করিয়া, ওই স্ত্রীলোক জিজ্ঞাসা করিলেন, বাপাঠাকুর আজ বুঝি তোমার খাওয়া হয় নাই।’