বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
বিয়ের বারো বছর বাদে কন্যা সন্তানসম্ভবা হয়েছে জেনে কবি যথেষ্ট আনন্দিত হয়েছিলেন। তিনি তখন আমেরিকায়। তিনি মেজ বৌঠান জ্ঞানদানন্দিনীকে টেলিগ্রাম করে বেলার সাধভক্ষণের ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় তিনি বাড়ির খাজাঞ্চি যদু চট্টোপাধ্যায়কে পাঁচশো টাকা এই কারণে মেজ বৌঠানের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশও দেন।
তিনি আমাদের অশান্ত জীবনে বারে বারে শান্তির বারি সিঞ্চন করেছেন। অসংখ্য সুখ, দুঃখের দিনে তাঁর লেখা পাঠ করে আমরা পেয়েছি অপার শান্তি। অথচ সেই মানুষটির জীবন পথ ছিল কণ্টকময়। বারে বারে পেয়েছেন আঘাত, অসংখ্য মৃত্যু -শোক তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে, অপমানিত হয়েছেন প্রিয়জনদের কাছ থেকে।
পিতৃগৃহ পরিত্যাগ করার কিছুদিনের মধ্যেই কোনও অজ্ঞাত কারণে মাধুরীলতার সন্তানটি মারা যায়। এই ভয়াবহ খবরটি তখনও জানতেন না কবি। তিনি তখন আরবানায়। সেখান থেকে জোড়াসাঁকোর ঠিকানায় কন্যা বেলাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু কবির প্রিয় ‘বেল’ তখন চলে গিয়েছেন অন্য ঠিকানায়— ডিহি শ্রীরামপুরে। ফলে এই ঠিকানা কেটে সেই ঠিকানায় আবার চিঠিটি পুনরায় পাঠান হয়। কিন্তু সেই চিঠির কোনও উত্তর পাননি কবি।
ওদিকে মাধুরীলতা— অসংখ্য বেদনায় বিপর্যস্ত হয়ে তিনিও ক্রমশ হয়ে উঠছেন অর্ন্তমুখী। তিনিও বোধহয় তাই তাঁর পিতাকে এতবড় শোকের খবরটি জানাতে চাননি, কিংবা পিতার ওপর প্রবল অভিমানে তিনিও হয়তো ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিলেন কবির কাছ থেকে। পার্থসারথী চট্টোপাধ্যায় লিখছেন, ‘বেলার দুঃখের দিনে— প্রবাসী পিতার নীরবতা তাঁর কাছে প্রতিভাত বিস্ময়কর উদাসীনতা। কবির সুদীর্ঘদিন ইংল্যান্ড -আমেরিকা ভ্রমণের ব্যস্ততায় বেড়ে যায় বেলা-শরৎকুমারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের দূরত্ব। অভিমানহত কন্যার সঙ্গে পিতার সম্পর্ক আর কখনও স্বাভাবিক হয়নি— রবীন্দ্রনাথের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও। বিস্ময়ের বিস্ময়— ভুবনবিখ্যাত রবীন্দ্রনাথকে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে চিঠি লিখতে হয় জামাতা শরৎকুমারকে। আর কবি সে চিঠি লিখছেন এমন নত হয়ে যেন সব অপরাধ তাঁরই— যেন তাঁর আচরণই, তাঁর দুর্ব্যবহারই সব অশান্তির মূলে। অথচ কী গভীর বেদনা ও দুর্ভাগ্য কবির— জামাই তো দূরের কথা তাঁর অতি আদরের বেলাও যতদিন বেঁচে ছিলেন দুঃখের তাপস পিতাকে ভুল বুঝেই থাকলেন।’
আবার মৃত্যুর আক্রমণ! আবার পরাস্ত হবেন কবি। অভিমানিনী বেলা হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ঘুসঘুসে জ্বর ও কাশি দিয়ে শুরু হল উপসর্গ। সেই সমস্যার হাত ধরেই কবির আদরিনী বেলার শরীরে প্রবেশ করল ক্ষয়রোগ।
যে কোনও পিতার কাছে কন্যার স্থান সবার ওপরে। কন্যারা হলেন পিতার জীবনের অ্যাঞ্জেল। কন্যার প্রবল অসুস্থতার খবর পেলেন পিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর আবার মনে পড়ল কন্যা রেণুকার কথা। বিদায়ের আগে সেই মেয়েও তো হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তাঁর দিকে— ক্ষীণ, অতি ক্ষীণ স্বরে বলেছিল— বাবা, সব অন্ধকার হয়ে আসছে। কিছুই আর দেখতে পাচ্ছি না। তুমি পিতা নোহসি মন্ত্র পড়ে শোনাও আমাকে। আর আজ! আদরের বেলি মিশে যাচ্ছে রোগশয্যায়, আর দেরি নেই । বেলাও হয়তো শুনতে পাচ্ছে তাঁর পদশব্দ। শীতল পদশব্দ! তাই ছোটবেলার মতো বাবার হাত ধরে আবদার করছে, বাবা, আমাকে গল্প শোনাও। কঠিন কঠোর কবির হৃদয়ে তখনই শুরু হচ্ছে অঝোরে রক্তক্ষরণ। অদৃশ্য সেই রক্তক্ষরণে বারে বারে কবি-জীবন পিচ্ছিল হয়েছে। তবু তিনি থেকেছেন শান্ত, সৃষ্টির উল্লাসে ডুবেছেন বারে বারে।
রবীন্দ্রনাথ আদরের কন্যাকে গল্প শোনাতেন। কারণ তিনি প্রায় প্রতিদিনই দেখতে আসতেন কন্যাকে। লক্ষণ বুঝে হোমিওপ্যাথি ওষুধও দিতেন, আর শোনাতেন গল্প।
সাল ১৯১৮। মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে ঝরে গেলেন অভিমানিনী মাধুরীলতা। প্রতিদিনের মতো সেদিনও কবি কন্যাকে দেখার জন্য যাত্রা শুরু করেছিলেন, পৌঁছে খবর পেলেন বেলি আর নেই। তিনি আর গাড়ি থেকে নামলেন না। ফিরে এলেন কলকাতায়।
পুত্র রথীন্দ্রনাথ তাঁর পিতৃস্মৃতি গ্রন্থে লিখছেন,‘... শেষদিন পর্যন্ত রোজ দুপুরে দিদির কাছে যেতে লাগলেন। সেদিন ২রা জ্যৈষ্ঠ— যখন ডিহি-শ্রীরামপুর রোডের বাড়ি পৌঁছলেন, তিনি বুঝতে পারলেন, যা হবার তা হয়ে গেছে, গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন।
সেদিন সন্ধেবেলায় ‘বিচিত্রা’র বৈঠক ছিল। বাবা সকলের সঙ্গে হাসিমুখে গল্পসল্প যেমন করেন, সেদিনও তাই করলেন। তাঁর কথাবার্তা থেকে একজনও কেউ ঘুণাক্ষরে জানতে পারল না যে, মর্মান্তিক দুর্ঘটনা হয়ে গেছে, মনের কী অবস্থা নিয়ে বাবা তাঁদের সঙ্গে সদালাপ করেছেন।’
মাধুরীলতার মৃত্যুর এগারো বছর পর, কবি সেদিনও বসেছেন পরলোকচর্চায়। পিতা আহ্বান করলেন তাঁর প্রাণাধিক প্রিয়া কন্যা মাধুরীলতাকে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা। কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠলেন মিডিয়াম। রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারলেন ঘরে কোনও অতিথি এসেছেন। তিনি মৃদু স্বরে জানতে চাইলেন ‘ কে তুমি?
—বেল।
বেলা? ভালো আছিস?
—হ্যাঁ, বেশ আছি।
পৃথিবীর সব কথা মনে আছে? এখানের সঙ্গে তোর যোগ আছে?
—আছে বৈকি।
শমীর (শমীন্দ্রনাথ) সঙ্গে দেখা হয়? তাকে পাস কাছে?
—হ্যাঁ, এই তো কাছেই ছিল। এখনও আমার কাছেই রয়েছে।
সে ভারী চঞ্চল, না? শমী?
—হ্যাঁ, ভারী চঞ্চল।
এখনও সে কি বড় হয়নি? তার চঞ্চলতা কি ঘুচল না?
—না, এখনও কেউ ওকে সামলাতে পারে না। সবারই প্রিয় ও।
আগে মনে আছে তো, কবিতা শুনতে ভালোবাসত— পঞ্চনদীর তীরে— এখনও সেই ভাব আছে ওর?
—কবিতা যখনই পড়, ও ছুটে যায়, আমাদেরও টেনে আনে।
ভালো লাগে? আমার কবিতা শুনিস?
—বেশ সুন্দর।
সেদিন যে অভিনয় হয়েছিল তপতী, শুনেছিলি?
—বাঃ, ছিলুম যে সেইদিন।
ভালো লেগেছিল?
—বড়ো সুন্দর। শুধু দেখা নয়, পাওয়া জানা অনুভব করা।
আমি যুবা সেজেছিলুম। আমাকে দেখেছিলি?
—মানিয়েছিল সুন্দর।
অমিতাকে কেমন লাগল?
—ভালো।
শান্তিনিকেতনকে মনে পড়ে?
—পড়ে বৈকি।
এই যে এখন এখানে আছি— সব জানতে পারছিস, বুঝতে পারছিস?
—জানি সব, আর এত বেশি জানি। যখন বিদেশে থাকতুম, তখন এত কি সম্ভব হতো?
শমী তোর কাছেই আছে এখন?
—হ্যাঁ।
বিদায় নিলেন মাধুরীলতা। তিনি তাঁর প্রিয় পিতার কাছে এসেছিলেন একবার, দিনটি ছিল ২৮ নভেম্বর।
(ক্রমশ)
অলংকরণ: চন্দন পাল